মোদীর ইস্তাহার : প্রতারণার বয়ান ও বাস্তব
deception-and-reality

ভারতবাসী লোকসভা নির্বাচনের সাত দফা দীর্ঘ ভোটের প্রথম দফার ভোট দিতে যাওয়ার ঠিক পাঁচ দিন আগে শাসন ক্ষমতায় থাকা দল বিজেপি তাদের ৭৬ পৃষ্ঠার ইস্তাহার প্রকাশ করেছে। ২০১৪ সাল থেকে মোদী সরকারের নিজেদের দেওয়া প্রতিটি প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ব‍্যর্থতা ও প্রতারণা বিষয়ে ইস্তাহারে কিছুই বলা হয়নি, জনসাধারণের এজেন্ডায় মূল মূল যে বিষয়গুলি সবার ওপরে রয়েছে সেগুলো সম্পর্কেও ইস্তাহার কিছু বলেনি, ভারতের জন্য কেবল ২০৪৭ সালের এক গুলাবী স্বপ্নজাল বোনা হয়েছে! ভারতের রাজনীতিতে বিজেপি দলটিই ‘জুমলা’ শব্দটি চালু করে। ২০১৪ সালের নির্বাচনী প্রচারে প্রত্যেকের একাউন্টে ১৫ লাখ টাকা ঢোকার প্রতিশ্রুতিকে অমিত শাহ ভোটের পর জুমলা বলে অভিহিত করেছিলেন। জুমলা শব্দটি এখন যখন মিথ্যা প্রতিশ্রুতির সমার্থক শব্দ হিসেবে সর্বত্র চালু হয়েছে, বিজেপি তখন নতুন শব্দবন্ধ আবিষ্কার করেছে, ‘মোদীর গ্যারান্টি’। কিন্তু নাম যাই দেওয়া হোক জুমলা তো জুমলাই!

২০১৪’র নির্বাচনে বছরে দু’কোটি চাকরি দেওয়ার ও কালাধন ফেরত আনার যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল তা অস্বীকার করার পর মোদী সরকার ২০২২ সালের ভারতের জন্য এক নতুন প্রতিশ্রুতির তালিকা বানাতে ব্যস্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকীকে বিজ্ঞাপিত করা হয়েছিল অনেকগুলি বিষয় অর্জন করার সময়সীমা হিসেবে : শৌচালয় ও প্রবাহী জল সহ সর্বজনীন আবাস, কৃষি উপার্জন দ্বিগুণ হওয়া, এক শত স্মার্ট সিটি, দশটি নতুন বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়। ২০২২’র পর আরো দু’বছর পেরিয়ে গেছে। দেশকে নতুন নতুন প্রতিশ্রুতির বন্যায় ভাসিয়ে না দিয়ে সরকার তো ২০২২’র প্রতিশ্রুতিগুলির কী হল না হল সেই হালখাতা প্রকাশ করতে পারত! কিন্তু আরো একবার গোলপোস্ট সরিয়ে দেওয়া হল — এবারে ২০৩৬-এ অলিম্পিক আয়োজন আর ২০৪৭-এ বিকশিত দেশ!

মার্চের শেষ ও এপ্রিলের শুরুর দিনগুলিতে ১৯টি রাজ্যের ১০,০১৯ জনের মধ্যে চালানো সিএসডিএস লোকনীতি প্রাকনির্বাচনী সমীক্ষা সাধারণ মানুষকে যে ইস্যুগুলি ভাবাচ্ছে সে বিষয়ে একটি স্পষ্ট ছবি আমাদের সামনে হাজির করেছে। যে দুটি বিষয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ ব‍্যক্ত হয়েছে তা হল বেকারত্ব (২৭ শতাংশ মানুষ বলেছেন) ও মূল্যবৃদ্ধি (২৩ শতাংশ মানুষ বলেছেন)। এই চিত্রের সম্পূর্ণ বিপরীতে, মোদী সরকার তার অর্জন হিসেবে যে দুটি বিষয় তুলে ধরেছে — অযোধ্যায় রামমন্দির বানানো আর মোদী জমানায় আন্তর্জাতিক মহলে ভারতের ভাবমূর্তি ভালো হওয়া —এই দুটির গ্রহণ যোগ্যতা খুবই কম, যথাক্রমে ৮ শতাংশ ও ২ শতাংশ। বিজেপি তার অর্জন হিসেবে যে আইন-পরিবর্তনগুলিকে বা পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতিগুলিকে তুলে ধরেছে সেই সিএএ, ইউসিসি, নতুন ফৌজদারি আইন অথবা শ্রমকোড — এগুলো সাধারণ মানুষ ভালো চোখে দেখছে না। বস্তুত উত্তরাখণ্ডে ইউসিসি’র যে নমুনা প্রণীত হয়েছে তা মানুষের মাঝে যথেষ্ট সমালোচিত হয় তার ‘আনসিভিল’ চরিত্রের কারণে, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও নাগরিকের পছন্দ অপছন্দকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ও রক্ষণশীল সামাজিক হস্তক্ষেপের অধীনস্ত করা হয়েছে।

modi-manifesto-deception

বহু সংখ্যক সমীক্ষা ও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে যেগুলি আজকের ভারতে বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের নিদারুণ অবস্থা আমাদের সামনে হাজির করেছে। সম্প্রতি আইএলও এবং ইন্সটিটিউট অব হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট প্রকাশিত ২০২৪’র ইন্ডিয়া এমপ্লয়মেন্ট রিপোর্ট দেখিয়েছে ভারতের বেকারদের অধিকাংশই যুব। ৮০ শতাংশের বেশি সংখ্যক কর্মহীনেরা যুব। তাদের মধ্যে ৬ শতাংশের বেশির মাধ‍্যমিক বা তার বেশি ডিগ্রি আছে। তরুণ শিক্ষিত মহিলাদের মধ্যে বেকারত্বের হার আরো বেশি। মোদীর বিলিয়নেয়ার রাজত্বে অসাম্য এমনকি ঔপনিবেশিক যুগের থেকেও গভীর, মাত্র ১ শতাংশ ধনী ব্যক্তির হাতে দেশের মোট সম্পদের ৪০ শতাংশেরও বেশি জমা হয়েছে এবং তাঁরা মোট জাতীয় বার্ষিক উপার্জনের ২২ শতাংশ পকেটস্থ করেন। গরিব ও মধ্যবিত্তদের উপার্জন এক জায়গায় আটকে আছে আর ঋণগ্রস্ততা বিপজ্জনক মাত্রা নিয়েছে। এই চরম আশঙ্কাজনক অর্থনৈতিক বাস্তবতা প্রসঙ্গে বিজেপির ইস্তাহার চোখ বন্ধ করে আছে।

নরেন্দ্র মোদী সবসময় আমাদের বলেই চলেছেন যে ১৪০ কোটি ভারতীয়র আশা আকাঙ্খা পূরণ করাই তাঁর মিশন। একদিকে মোদী সরকার কোটি কোটি ভারতীয়কে দারিদ্র্য থেকে টেনে তুলেছে বলে দাবি করছে, অন্যদিকে আবার তাঁর সরকার ৮০ কোটি মানুষকে বিনা পয়সায় ৫ কেজি করে খাদ্যশস্য সরবরাহ করছে বলে কৃতিত্ব নিচ্ছে। এর থেকে সহজেই প্রমাণ হয়ে যায় যে দারিদ্র দূরীকরণ বা ১৪০ কোটি ভারতীয়ের আকাঙ্খা পূরণের দাবি সর্বৈব মিথ্যা। আসলে দেশে দ্রুত বর্ধমান অর্থনৈতিক অসাম্য মোদী সরকার ও তার নীতিনির্ধারক ও প্রচারকদের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা ও সোৎসাহ উদযাপনের মধ্যে দিয়েই ঘটছে। সরকার ‘সম্পদ সৃষ্টিকারী’ শব্দবন্ধটি সংরক্ষিত রেখেছে সম্পদ আহরণকারী বিলিয়নেয়ার শ্রেণীর জন্য, আর ৮০ কোটি মানুষকে কেবল প্রতি মাসে বিনামূল্যে ৫ কেজি খাদ্যশস্য পাওয়ার যোগ্য বানিয়ে রেখেছে।

এই সরকারের চাপিয়ে দেওয়া অঘোষিত জরুরি অবস্থার মতোই বিজেপির ইস্তাহারের প্রকৃত লক্ষ্য অফিসিয়ালি অঘোষিত। কিন্তু বিজেপি নেতৃত্ব এবং অনন্ত হেগড়ে, জ্যোতি মির্ধা, লালু সিং ও অরুণ গোভিলদের মতো প্রার্থিরা প্রতিদিন ক্রমবর্ধমান মাত্রায় সমস্বরে সংবিধান বদলে দেওয়ার কথা বলে আসল লক্ষ্য প্রকাশ করে দিচ্ছেন। তাঁরা বলছেন যে এই কারণেই মোদী ৪০০ আসনসীমা অতিক্রম করার লক্ষ্য স্থির করে দিয়েছেন। বাবাসাহেব আম্বেদকর রচিত সংবিধানকে কেন্দ্র করে গণতান্ত্রিক ভারতের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনায় ভীত হয়ে মোদী এখন ‘গ্যারান্টি’ দিচ্ছেন যে এমনকি আম্বেদকরের পক্ষেও সংবিধান ধ্বংস করে দেওয়া সম্ভব নয়। যদি তিনি সত্যিই ভারতকে সংবিধান সম্পর্কে আশ্বস্ত করতে চাইতেন তাহলে তো তাঁর উচিৎ ছিল গোলওয়ালকরের নাম উল্লেখ করা কারণ আরএসএস কোনোদিনই সংবিধানকে স্বীকৃতি দেয়নি এবং তার জায়গায় মনুস্মৃতি প্রণয়ন করতে চেয়েছে।

বাবাসাহেব বস্তুত জনসাধারণকে সতর্ক করেছিলেন সংবিধান সম্পর্কে আত্মতুষ্ট না থাকতে এবং তার বদলে বরং যারা সংবিধান কার্যকর করছে সেইসব ব্যক্তিবর্গের গুণমান ও উদ্দেশ্যের দিকে ধ্যান দিতে। খারাপ হাতে পড়ে একটা ভালো সংবিধানও বিপর্যয়কর ফলাফল দিতে পারে। এ’কথাটি স্বাধীন ভারতে ‘বাদামি ইংরেজ’এর ক্ষমতা দখল করে নেওয়া সম্পর্কে ভগৎ সিংহের সতর্কবাণীর সাথে মিলে যায়। বাবাসাহেবই দেখিয়ে গিয়েছেন যে ‘এক ব্যক্তি এক ভোট’এর সমতা অর্থহীন হয়ে যাবে অনিয়ন্ত্রিত আর্থিক ও সামাজিক অসাম্যের ফলে। আজ ভারতকে আম্বেদকরের সতর্কবাণী স্মরণে রেখে গণতন্ত্র ও তার সাংবিধানিক ভিত্তিকে বাঁচাতে সংবিধান-বিরোধী ফ্যাসিস্ট শক্তিকে ভোটে পরাস্ত করতে হবে।

- এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ১৬ এপ্রিল ২০২৪

খণ্ড-31
সংখ্যা-14