বেলা-অবেলার বাতাসে স্মৃতির আখরেরা
day-and-night

ডি এল রায় সরণী (তখন রাস্তার এই নামকরণ হয়েছিল কিনা জানা নেই)। কিন্তু বাবার হাত ধরে যতবার মহানন্দা পাড়ার ঐ নির্দিষ্ট রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেছি, বাবা অদ্ভুতভাবে গলা নামিয়ে সরু গলায় বলতেন, ঐ যে, ঐ দেখ চারু মজুমদারের বাড়ি। তখন ক্লাস টু থ্রি হবে। কি বুঝতাম কে জানে, কিন্তু চুপ করে থাকতাম। পরের দিকে দেখতাম, ২৮ জুলাই দার্জিলিং জেলায় হরতাল হয়। ফলে স্কুল বন্ধ থাকত। আর আমার স্কুল কালেচক্রে জলপাইগুড়ি জেলাতে, ফলে ছুটি নাই। মনে মনে খুব রাগ হতো চারু মজুমদারের ওপর। তখন বার কয়েক ‘নকশাল’ শব্দটি কান অব্দি এসেছে, কিন্তু মাথাতে তখন মার্ক্স, লেনিনের পরেই জ্যোতি বসুর নিত্য যাতায়াত! কিন্তু ছুটি পাইনি বলে যার ওপর একসময় ভীষণ রাগ হতো! বাবার সরু গলার উৎস সন্ধানে গিয়ে কখন যে নিষিদ্ধ ইস্তাহারের মতো কমরেড চারু মজুমদার আমার টিনএজের অনেকটাই দখল করে নিয়েছিলেন, না, তখনও বুঝতে পারিনি!

কেমন ছিল সত্তরের সেই স্বপ্নদর্শীরা — কেমন ছিলেন আমার বেড়ে ওঠার শহরের আরেক প্রান্তের মানুষটি, আটটি দলিল আর একটি ছোট্ট অচেনা জোত, জনপদ নকশাল বাড়ির নাম পৃথিবীর বুকে খোদাই করার কারিগর চারু মজুমদার! ‘কালবেলা’ থেকে ‘মহাকালের রথের ঘোড়া’ থেকে ‘ইন দ্যা ওয়েক আপ অফ নকশালবাড়ি’ হাতড়ে খুঁজে ফিরেছি আন্দোলনের পরতে পরতে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব চারু মজুমদারকে — কিন্তু সাফল্য, ব্যর্থতার অন্ত্যমিলে ‘পারিবারিক’, ‘ব্যক্তি মানুষ’ চারু মজুমদার? ওনার মতো মানুষদের নিয়ে কিছু ‘মিথ’ তো তৈরি হয়েই যায় — তবুও তার পরে — কলেজ শেষ হতে হতেই স্বাধীনতা, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্রের সাদা পতাকাটি নামিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছিলাম! ততদিনে নকশালবাড়ি সম্পর্কে খানিক জানা বোঝার চেষ্টা করে চলছি। স্যারের (অভিজিৎ মজুমদার) কাছে শোনা টুকরো টুকরো আলাপচারিতা ক্রমেই জানার খিদেকে আরও আরও উস্কে দিচ্ছে।

ততদিনে আমার চলার পথে সিপিআই(এম)-এর সাথে ‘এল’ জুড়ে গেছে অনায়াসে। স্যারের ফ্ল্যাটে পড়া বোঝার অজুহাতে বার কয়েক গেলেও ছোটবেলায় দূর থেকে দেখা কাঠের বাড়িটি তখনও অধরা — সুযোগ হল ২০১৬’র সেপ্টেম্বরে এক বৃষ্টি মুখর সন্ধ্যায়! ঘরে ঢুকে আবেগ, আবেশ, অনুভূতি সবটা মিলিয়ে — বেশ মনে আছে, অনেকক্ষণ কিছু বলতেই পারিনি। তারপর কখন আর কবে যেন দিদিরা সবটাই নিজের মতো করে নিলেন — ততদিনে পড়েছি মিতুদির (মধুমিতা মজুমদারের) ছোট গল্পের সংকলন থেকে ছড়ার বই। যখন ভেবেছি আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে ছোটদের কথা সহজভাবে আর কজন এরকম করে ভাবেন? মিতুদি মাথার দরজাতে সজোরে ধাক্কা দিয়ে বলেছেন, আছি তো আমি! আবার পরক্ষণেই কিডনি, বিয়েবাড়ি, ফিনিক্স পাখিরা, ছাঁট, অতসী, সোনালীর স্বপ্ন’র মতো অণুগল্প, ছোটগল্পের মধ্য দিয়ে ওনার সামাজিক বীক্ষণের প্রসারতাকে আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন।

তবে ওনার কাছে সব থেকে সহজ ছিল তো একজন ‘বাবা’ হিসেবে চারু মজুমদারকে উপস্থাপন করা। পাশাপাশি অবশ্যই একজন মা, একজন সবসময়ের সহযোদ্ধা হিসেবে লীলা মজুমদারকে তুলে আনা। যার যথার্থ সূত্রায়ণ ‘লীলা মজুমদার : এক অন্য রাজনৈতিক যাপন’এ ওনারা করেছেন। কিন্তু যে চারু মজুমদার শুধু লোক দেখবেন বলে উৎসবের রাতে সেদিনের ছোট্ট শহর শিলিগুড়িতে পরিবারের সঙ্গে বেড়িয়ে পড়তেন রিকশা করে, আপন মনেই ‘যেতে যেতে একলা পথে’ গাইতে গাইতে পাড়ি জমাতেন রাহুল দেব বর্মনের ‘ফিরে এসো অনুরাধা’তে! যার রান্নার হাত রীতিমতো প্রশংসার দাবি রাখতো! পাজামা’র ওপর শার্ট চাপিয়ে যিনি হাসিমুখে জেল যাত্রার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে যেতেন। সময় পেলেই পরিবারের সকলের সাথে আনন্দে রসিকতায় মেতে উঠতেন। আমৃত্যু স্বপ্ন দেখতেন চলমান ব্যবস্থার খোল নলচে বদলে দিয়ে এক নতুন ‘আগামী’র! সন্তানদের উৎসাহিত করতেন একজন ‘বাবা’ হিসেবে! আবার কমরেড বাবুলাল বিশ্বকর্মকারের শহীদ হওয়ার খবরে শীর্ণকায় দৃঢ়চেতা মানুষটির চোখের জল বাঁধ মানেনি।

‘বেলা-অবেলার স্মৃতিলেখা’তে মিতুদি সহজাতভাবে কলস্বনার মতো বলে গেছেন সেই মানুষটির যাপনের কথা, সেই মানুষটিকে নিয়ে যাপনের কথা। মিতুদির শারীরিক অসুস্থতা তার লেখাতে কোনও বিষাদ চিহ্ন এঁকে দিতে পারেনি। বরং নকশালবাড়ির পথ নিয়ে নিশ্চিতভাবেই আছে আশাবাদের প্রতিস্পর্ধী উচ্চারণ। যা চারু মজুমদার ও লীলা মজুমদারের সেদিনের দৃপ্ত পদচারণা ও পাড়া প্রতিবেশীদের সদর্থক সমর্থনের মধ্য দিয়েই আজও ছড়িয়ে আছে দেশ থেকে দেশান্তরে। মিতুদির অভিযাত্রা এগিয়ে চলুক দুর্বার গতিতে — আমরা সকল প্রকার ঔদাসীন্য কাটিয়ে সাড়া দেবো পূব আকাশ লাল হয়ে ওঠার চির আঙ্খাকাকে সঙ্গী করেই।

- শাশ্বতী সেনগুপ্ত

খণ্ড-31
সংখ্যা-14