( গাজা ভূখণ্ডের ব্যাপক অংশকেই গুঁড়িয়ে ধূলিসাৎ করা হয়েছে। সেখানকার অর্থনীতিকে ধ্বংস করা হয়েছে। জনসংখ্যার এক বড় অংশকে বাস্তুচ্যুত হয়ে চলে যেতে হয়েছে দক্ষিণের রাফায়। খাদ্যদ্রব্য নিয়ে যাওয়া ট্রাককে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। দুর্ভিক্ষ আর খুব দূরে নেই। গাজা পরিস্থিতির বিশ্লেষণে কলম ধরেছেন স্ট্যানলি জনি। নিবন্ধটির গুরুত্ব বিবেচনা করে সেটির বঙ্গানুবাদ আমরা এখানে রাখছি। – সম্পাদক, আজকের দেশব্রতী )
গাজার বিরুদ্ধে ইজরায়েলের যুদ্ধ প্রবেশ করেছে ছ’মাসে, আর ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের বিদেশ নীতির প্রধান যোশেফ বোরেলের কথায় স্থলবেষ্টিত প্যালেস্তাইন হয়ে উঠেছে ‘বৃহত্তম উন্মুক্ত সমাধিস্থল’। রাষ্ট্রপুঞ্জ সতর্ক করে বলেছে যে, ২৩ লক্ষ মানুষের বসবাসের স্থল ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে দুর্ভিক্ষ ‘আগতপ্রায়’। আন্তর্জাতিক স্তরে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জোরালো হয়ে ওঠা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সরকার জেদ ধরে রয়েছে যে ‘হামাসকে নিঃশেষ’ না করা পর্যন্ত সামরিক অভিযান চালিয়ে যাওয়া হবে।
বর্তমান যুদ্ধ শুরু হয় ২০২৩’র ৭ অক্টোবর ইজরায়েলের বিরুদ্ধে হামাসের সামরিক অভিযানের মধ্যে দিয়ে, যে অভিযানে অন্তত ১২০০ মানুষ নিহত হয়েছিল। এই যুদ্ধ গাজার ব্যাপক অঞ্চলকেই ধ্বংস করেছে এবং ভূখণ্ডের অধিকাংশ জনগণকেই অপসারিত করে নিয়ে গেছে দক্ষিণের শহর রাফায়। গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের বয়ান অনুযায়ী পাঁচ মাসেরও অধিক সময়ের ইজরায়েলি আক্রমণে নিহত হয়েছে অন্তত ৩২,০০০ মানুষ, যার এক বড় অংশই নারী ও শিশু। আহতের সংখ্যা ৭৪০০০’রও বেশি। আহতদের চিকিৎসার জন্য যথেষ্ট সংখ্যক হাসপাতাল, ডাক্তার, ওষুধ, যথেষ্ট পরিমাণ পরিশ্রুত জল ও স্বাস্থ্য পরিষেবার অন্যান্য সুযোগসুবিধা গাজার নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, “আমরা দেখতে পাচ্ছি, যে সমস্ত রোগী মৃত্যু থেকে বাঁচার শল্য চিকিৎসা ও অঙ্গহানি থেকে, অথবা ক্যান্সার ও ডায়াবেটিস থেকে সুস্থ হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছেন, যে মায়েরা সদ্য সদ্য সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, অথবা নবজাতক শিশুরা — সবাই বুভুক্ষায় এবং তার থেকে জন্ম নেওয়া ব্যাধিতে আক্রান্ত।”
অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে বাস্তুচ্যুত হওয়া প্রায় ২০ লক্ষ মানুষের অধিকাংশই দক্ষিণে কাজ চালানোর মতো অস্থায়ী শিবিরগুলোতে থাকছেন। রাষ্ট্রপুঞ্জ জানিয়েছে, যে সমস্ত স্কুলে শরণার্থীরা থাকছেন সেখানে এক একটা বাথরুম আর শাওয়ার ব্যবহার করছেন শতাধিক মানুষ। নিকৃষ্ট নির্মলীকরণ ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হেপাটাইটিস এ, আন্ত্রিক ও অন্যান্য সংক্রামক রোগের প্রাবল্য দেখা যাচ্ছে। ইনটিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ বর্গবিন্যাসের সাম্প্রতিকতম রিপোর্ট অনুসারে গাজার পরিস্থিতি ‘সর্বনাশা’। যুদ্ধের আগে গাজার জনগণের খাদ্যের প্রয়োজন মেটানোর জন্য যথেষ্ট খাবার সেখানে ছিল। অপুষ্টির অস্তিত্ব বলতে গেলে ছিল না। আর এখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডিরেক্টর জেনারেল টেড্রস আধানম ঘেব্রিয়েসাস বলছেন, “গাজায় যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্য ঢুকতে না দিলে দশ লক্ষরও বেশি মানুষ বিপর্যয়কর বুভুক্ষার মুখে পড়বেন।”
ইনটিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ’এর রিপোর্টে বলা হয়েছে যে বিশ্বের যে কোনো স্থানের চেয়ে গাজায় অনাহারের সংকট এখন সবচেয়ে তীব্র। ৭ অক্টোবর ২০২৩’র আগে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে তীব্র অপুষ্টির হার ছিল ০.৮ শতাংশ, সেটাই বেড়ে ফেব্রুয়ারি ২০২৪-তে দাঁড়িয়েছে ১২.৪ থেকে ১৬.৫ শতাংশ। ঐ রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, গাজায় খাদ্য, জল এবং অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যের সরবরাহকে অবিলম্বে বাড়িয়ে তুলতে হবে। অপুষ্টি এবং ব্যাধি, উভয়ের মিলিত প্রভাব শিশুদের মৃত্যুমুখে ঠেলে দিচ্ছে। গত পাঁচ মাসে পরিস্থিতি ক্রমাগতই খারাপ হতে থেকেছে। গাজায় ফেব্রুয়ারিতে অনাহারগ্ৰস্ত মানুষের হার যেখানে ছিল ৩০ শতাংশ, মার্চ মাসের মাঝামাঝি সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ৫০ শতাংশে। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, উত্তর গাজায় ২৭ জন, যাদের অধিকাংশই শিশু, অপুষ্টি এবং দেহে জলের ঘাটতির জন্য মারা গেছে। উত্তর গাজায় যেখানে এখনও ৩,০০,০০০ মানুষ থাকছেন, ইজরায়েল সীমানা বন্ধ করে দেওয়ায় (একটা মাত্র চেকপয়েন্ট খোলা রেখেছে) সেখানে সরবরাহ ছিন্ন হয়ে গেছে। গাজায় এখন যে সাহায্য পৌঁছচ্ছে তা ঢুকছে দক্ষিণের দুটো চেকপয়েন্ট দিয়ে।
দুর্ভিক্ষ নির্ধারণে বিশেষজ্ঞরা সাধারণত তিনটে মানদণ্ডকে বিবেচনায় রাখেন — খাদ্যের লভ্যতার প্রচণ্ড অভাব, তীব্র অপুষ্টির উচ্চ মাত্রা ও শিশু মৃত্যু। উত্তর গাজায় খাদ্যের অভাব চরম মাত্রায় পৌঁছেছে, অপুষ্টির মাত্রা এবং শিশু মৃত্যুও বেড়ে চলেছে। আর এ’জন্যই রাষ্ট্রপুঞ্জ এবং বিশ্বের কয়েকটি শক্তিশালী রাষ্ট্র অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি এবং গাজার জনগণের কাছে আরও বেশি পরিমাণে খাদ্যদ্রব্য সরবরাহের আহ্বান জানিয়েছেন।
৭ অক্টোবরের আগে গাজায় প্রতিদিন ৬০০ ট্রাক ঢুকত যার মধ্যে ১৫০টা ট্রাক হতো খাদ্যদ্রব্যের। এর পর থেকে যুদ্ধের পরিণামে গাজার অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে গেছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের খাদ্য ও কৃষি সংগঠন জানিয়েছে, গাজা ভূখণ্ডের খাদ্য উৎপাদন ভূমি উত্তর গাজার অর্ধেক কৃষিজমি যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইজরায়েলের নিরবচ্ছিন্ন বোমাবর্ষণ গাজার বন্দরটাকেও ধ্বংস করেছে, যার ফলে মাছ ধরে জীবিকা অর্জনের ক্ষেত্রটিও ধ্বংস হয়ে গেছে, যেটি ছিল গাজাবাসীর আয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে এবং নির্মাণ ও অন্যান্য কাজকর্ম সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে রয়েছে। এর ফলে প্রায় সমগ্র জনগণই সাহায্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন এবং সরবরাহের প্রয়োজনও বেড়ে গেছে বহুগুণ। রাষ্ট্রপুঞ্জর দেওয়া হিসাব অনুযায়ী অক্টোবরে গাজায় প্রতিদিন যেখানে ৬০০ ট্রাক ঢুকত, সেই সংখ্যাটা আজ নেমে এসেছে ২০০-তে। এই কারণেই সংকট তীব্রতর পর্যায়ে পৌঁছেছে, গাজার অর্থনীতি ধ্বংস হওয়ায় যে সংকটের উন্মোচন আগেই শুরু হয়েছিল। ফেব্রুয়ারির শেষে ইজরায়েলি সেনারা সাহায্য দ্রব্য নিয়ে পৌঁছানো এক কনভয়ের কাছে জড়ো হওয়া জনগণের ওপর গুলি চালায়, সঙ্গে সঙ্গেই জড়ো হওয়া লোকজন পড়ি কি মরি করে দৌড়তে থাকেন এবং ঐ সামরিক হানাদারিতে মারা যায় ১০০ প্যালেস্তিনীয়। সংকট প্রশমনের সহায়তায় আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আরব দুনিয়ার কিছু দেশ গাজায় বিমান/হেলিকপ্টার থেকে খাদ্যদ্রব্য ফেলাকে বাড়িয়ে দেয়। এমন একটা ঘটনা ঘটে যে খাদ্যদ্রব্য বহন করা আধারের প্যারাশুট না খোলায় সেটি খাবারের জন্য অপেক্ষারত জনগণের ওপর এসে পড়ে এবং তাতে অন্তত পাঁচজন মানুষ মারা যান। ইজরায়েল গাজায় আরও সাহায্য ঢুকতে না দেওয়ায় সংকটের তীব্রতা বেড়ে চলে, আর তাই সেবা সংস্থা ওয়ার্ল্ড সেন্ট্রাল কিচেন সমুদ্র পথে সহায়তা পাঠায়। আমেরিকা সাহায্য পাঠানোর জন্য গাজার উপকূলে একটা পাটাতন বা জেটি নির্মাণের পরিকল্পনা করছে, কিন্তু ঐ পরিকল্পনার রূপায়ণে কয়েক মাস লেগে যাবে। রাষ্ট্রপুঞ্জ গত সপ্তাহে বলেছে যে, গাজায় আরো সাহায্য ঢুকতে না দেওয়াটা অনাহারকে ‘যুদ্ধের অস্ত্র হিসাবে’ ব্যবহার করারই শামিল। রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার প্রধান ভল্কার টার্ক বলেছেন, “বুভুক্ষা, অনাহার ও দুর্ভিক্ষের এই পরিস্থিতি মানবতাবাদী সাহায্য ও বাণিজ্যিক দ্রব্য ঢুকতে দেওয়াকে ইজরায়েলের ব্যাপকভাবে আটকানোরই পরিণাম।”
রাষ্ট্রপুঞ্জের বিভিন্ন সংস্থাই সুস্পষ্টভাবে জানিয়েছে যে, পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতির জন্য যুদ্ধের অবসান একান্তই জরুরি। গাজা তার মানবতাবাদী সংকটের সবচেয়ে যন্ত্রণাদগ্ধ পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে চলেছে। গাজার অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে গেছে; জনগণকে বিধ্বস্ত করা হয়েছে; সাহায্যের সরবরাহ যথেষ্ট পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে; এমনকি যেটুকু সাহায্য সেখানে পৌঁছচ্ছে, চলমান যুদ্ধের কারণে সৃষ্টি হওয়া ব্যাঘাতের জন্য সেটুকুও ঠিকমতো বিতরণ করা যাচ্ছে না। রাষ্ট্রপুঞ্জেরও ১০০ জনের বেশি কর্মী নিহত হয়েছেন, ফলে তার কর্মীসংখ্যা অপ্রতুল এবং রাষ্ট্রপুঞ্জের কর্মীদেরও অনাহারে থাকতে হচ্ছে।
পশ্চিমে ইজরায়েলের যে মিত্ররা রয়েছে তারাও পরিস্থিতির বিপন্নতাকে স্বীকার করেছে। আমেরিকার বিদেশ সচিব অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন গত সপ্তাহে বলেছেন, “গাজার সমগ্র জনগণই চরম মাত্রার খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ভোগ করছেন।” কিন্তু তাদের সংকটের সমাধানের জন্য অবরোধ তুলতে ইজরায়েলকে বাধ্য না করে সরবরাহ বাড়িয়ে তোলার বিকল্প পথ বার করতে হবে; তবে এই বিকল্প সংকট প্রশমিত করতে পারবে বলে মনে হয় না। গাজার প্রয়োজন অবিলম্বে যুদ্ধ বিরতির। কিন্তু পাঁচ মাস যুদ্ধ চালানোর পরও ইজরায়েল তাদের ঘোষিত লক্ষ্য অর্জনে সফল হয়েছে বলে মনে হয় না, যথা, যুদ্ধ বন্দিদের মুক্ত করা বা হামাসকে ধ্বংস করা। কাতার, মিশর ও আমেরিকার মধ্যস্থতায় আপস আলোচনা চলছে, কিন্তু হামাস ও ইজরায়েল কোনো সমঝোতায় পৌঁছতে পারেনি। ইজরায়েল যুদ্ধবন্দিদের মুক্তির বিনিময়ে যুদ্ধে সাময়িক বিরতিতে আগ্ৰহী বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু হামাস চাইছে স্থায়ী যুদ্ধবিরতি এবং তারা ইজরায়েলের জেলে বন্দি কয়েকজন বড় মাপের প্যালেস্তিনীয়র মুক্তির দাবিও জানিয়েছে, যার মধ্যে দু’দশকেরও বেশি ইজরায়েলের জেলে বন্দি ফাতাহ নেতা মারওয়ান বারঘৌটিও রয়েছেন। দুই পক্ষ স্বীকৃত কোনো ভিত্তিতে পৌঁছতে না পারায় যে ইজরায়েল আমেরিকার কাছ থেকে অস্ত্র সাহায্য পেতে থাকছে, তারা আপাতত যুদ্ধটাকেও চালিয়ে যাচ্ছে।
- জয়দীপ মিত্র