মোদী সরকারের দ্বিতীয় দফায় খুচরো বাজারে মূল্যবৃদ্ধির হার প্রথম দফার দেড়গুণ
one-and-a-half-times-that-of-the-first-phase

কেন্দ্রে সমাসীন সরকারের ধারণা মনে হয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের নিত্য মূল্যবৃদ্ধি সহ্য হয়ে গিয়েছে জনসাধারণের। তা না হলে ক্রমাগত খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়তে থাকলেও দেশের প্রধানমন্ত্রী তাঁর নির্বাচনী ভাষণে সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সময় ব্যয় না করে কেবল ধর্ম ও দুর্নীতির বাগাড়ম্বরে ভোট চাইতে পারেন?

সরকারি হিসেব অনুযায়ী ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এ’বছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত সমস্ত ভোগ্যপণ্যগুলির, যার মধ্যে খাদ্য-পানীয়-স্বাস্থ্য-শিক্ষা-ওষুধ-পরিবহণ এগুলি অন্তর্ভুক্ত, দাম বেড়েছে ৫ শতাংশের বেশি (৫.১ শতাংশ)। কিন্তু ওই সময়কালে খাদ্য ভোগ্যপণ্য সূচকের নিরিখে খাদ্য ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়েছে ৯ শতাংশ। খাদ্য ভোগ্যপণ্যের মধ্যে যে সমস্ত পণ্য সাধারণ ভোগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ, চালের দাম বেড়েছে ১৩ শতাংশ, দানা শস্যের বেড়েছে ৮ শতাংশ, ডিমের দাম বেড়েছে ১১ শতাংশ, সব্জির ৩৫ শতাংশ, মশলাপাতির ১৪ শতাংশ। ওই সময়কালে বিদ্যুতের মাশুল বেড়েছে ১০ শতাংশ, কেরোসিনের ১১ শতাংশ।

উপরেই বলা হয়েছে, ভোগ্যপণ্য সূচক অনুসারে ফেব্রুয়ারি ২০২৪-এ বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতির হার ৫.১ শতাংশ। সারা দেশে সেই হার সমান নয়। মণিপুরে সব থেকে বেশি ১১ শতাংশ, ওড়িশায় ৭.৬ শতাংশ, তেলেঙ্গানায় ৬.৭ শতাংশ, হরিয়ানায় ৬.৩ শতাংশ, আসাম ৬ শতাংশ, ঝাড়খন্ড ৫.৯ শতাংশ, কর্ণাটক ৫.৭ শতাংশ, অন্ধ্রপ্রদেশ ৫.৭ শতাংশ, গুজরাট ৫.৪ শতাংশ, রাজস্থান ৫.৩ শতাংশ, উত্তরপ্রদেশ ৫.৩ শতাংশ, পাঞ্জাব ৫.২ শতাংশ। উক্ত ১৩টি রাজ্যের মুদ্রাস্ফীতির হার বার্ষিক হারের থেকে বেশি। ৩০টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে ওই হারের নিরিখে ২৩তম, ৪.৪ শতাংশ।

মোদী সরকার ভারতীয় অর্থনীতিতে মূল্যবৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার কথা বলে সরকারে এসেছিল। গত ২০১৯ সালের নির্বাচনের সময়ে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে বলে কৃতিত্বও নিয়েছিল। অতএব, যদি মুদ্রাস্ফীতি বর্তমানে অনিয়ন্ত্রিত থাকে তার দায় সরকারকেই নিতে হবে। ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এই ৫ বছরে, ২০১৪ সালের মে থেকে ২০১৯ সালের মে মাস পর্যন্ত হিসেব করলে সমস্ত ভোগ্যপণ্যগুলির দাম বেড়েছিল বার্ষিক ৪.৮ শতাংশ। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সেই বৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ। খাদ্য ভোগ্যপণ্য সূচকের নিরিখে খাদ্য ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়েছিল, ২০১৪ সালের মে থেকে ২০১৯ সালের মে মাস পর্যন্ত হিসেব করলে, বার্ষিক ৩.৩ শতাংশ। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সেই বৃদ্ধির হার বার্ষিক ৮.১ শতাংশ। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৫ বছরে দানাশস্যের দাম বেড়েছে বার্ষিক ৮.২ শতাংশ (বার্ষিক ৩.৩ শতাংশ আগের ৫ বছরে), মাছ মাংসের দাম বেড়েছে বার্ষিক ৯.৪ শতাংশ (৬.৮ শতাংশ), ডিমের দাম বেড়েছে বার্ষিক ৯.৪ শতাংশ (৪.১ শতাংশ), শাকসব্জির দাম বেড়েছে বার্ষিক ১০.৮ শতাংশ (৩.৪ শতাংশ), ডালের দাম বেড়েছে বার্ষিক ১৩.৮ শতাংশ (২.৮ শতাংশ), মশলাপাতির দাম বেড়েছে বার্ষিক ১৪.২ শতাংশ (৫.৪ শতাংশ)। ফলে এটা দেখা যাচ্ছে যে, মোদী সরকারের দ্বিতীয় দফায় সাধারণ ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি সর্বক্ষেত্রেই ঊর্ধ্বাভিমুখী। (এই অনুচ্ছেদে বন্ধনীর মধ্যে সংখ্যাগুলি মে ২০১৪ থেকে মে ২০১৯ পর্যন্ত মোদী সরকারের প্রথম ৫ বছরের মূল্যবৃদ্ধির বার্ষিক হার)

in-the-second-phase-of-the-modi-government

সরকারি স্তরে প্রদত্ত মূল্যবৃদ্ধির হারের সঙ্গে সাধারণ মানুষের বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা মেলে না। চাল ডাল তেল নুন আটা ময়দা মাছ মাংস ইত্যাদি দৈনন্দিন ভোগ্যপণ্য যেভাবে মহার্ঘ হয়ে উঠেছে তাতে খাদ্য ভোগ্যপণ্যের দাম গত ৫ বছরে বার্ষিক ৮.১ শতাংশের সরকারি পরিসংখ্যানের সঙ্গে মেলে না। কোভিড পরবর্তী ৩ বছরে গণপরিবহনের ক্ষেত্রে এক বিপুল ব্যয় বৃদ্ধি ঘটেছে। কলকাতা শহরে বা রাজ্যজুড়ে বাসের ভাড়া সরকার নির্ধারিত পূর্বতন ভাড়ার তুলনায় বহু ক্ষেত্রে দেড়গুণ হয়েছে। একইভাবে এ্যাপভিত্তিক ট্যাক্সিগুলির ভাড়াও বহুলাংশে বেড়েছে, যা অনেক সময়ই সরকার নির্ধারিত ট্যাক্সির কিমি প্রতি ভাড়ার দ্বিগুণ বা তিনগুণ। এমনকি ট্যাক্সির ক্ষেত্রেও সরকারিভাবে এ্যাপের বন্দোবস্ত করা হয়েছে, দ্বিগুণের বেশি ভাড়ায়। কিন্তু পরিবহণের এই চরম ব্যয়বৃদ্ধি কিন্তু ভোগ্যপণ্য মূল্যসূচকে প্রতিফলিত হয়নি।

সাধারণভাবে ব্যক্তিগত ভোগব্যয় সংক্রান্ত পরিসংখ্যান এমনটা দেখাচ্ছে না যে ভোগচাহিদার বৃদ্ধি জনিত কারণে মুদ্রাস্ফীতি ঘটেছে। ফলে চাহিদা জনিত মুদ্রাস্ফীতি ঘটেছে বলা যাবে না। অপরদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য যোগানের দিকে সঙ্কট এসেছে এমনটাও দেখা যায়নি। তাই ভারতের মুদ্রাস্ফীতির কারণ দেশের আভ্যন্তরীণ যোগান জনিত সমস্যা। অধিক মুনাফার জন্য ৫টি বৃহৎ পুঁজিপতি ঘরানার বোঝাপড়াকে দায়ী করেছিলেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পূর্বতন ডেপুটি গভর্নর ভিরাল আচার্য। তাকে সরকারি স্তরে অবশ্য নাকচ করা হয়েছে। কিন্তু রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সুদের হার বারবার বাড়িয়েও মুদ্রাস্ফীতিকে কাবু করতে পারছে না। ২০২২ সালের এপ্রিলের গোড়া থেকে ৬ বার হার বাড়নোর ফলে সেই হার (রেপো হার) ৪ শতাংশ থেকে ৬.৫ শতাংশে পৌঁছায়। অপরদিকে ব্যাঙ্কগুলি গৃহঋণ সমেত বিভিন্ন ঋণের উপর সুদের হার বাড়ানোর ফলে মধ্যবিত্তের উপরে চাপ বাড়ে, স্বল্প ও মাঝারি মূল্যের আবাসনের বিক্রি কমে। একইসঙ্গে ক্ষুদ্রশিল্পগুলির উপরে সুদের হার বাড়ার ফলে তাদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বৃহৎ পুঁজির মালিকদের মুনাফা কিন্তু কমেনি। যার ফলে দেশে অসাম্যের তীব্রতা বেড়েছে। অক্সফ্যাম বা গ্লোবাল ইনইকোয়ালিটি ল্যাবের রিপোর্টে তা প্রতিফলিত হয়েছে।

অর্থনীতির সূত্র অনুসারে মুদ্রাস্ফীতির হার ও কর্মহীনতার হারের মধ্যে সম্পর্ক ব্যস্তানুপাতিক। অর্থাৎ মুদ্রাস্ফীতি বাড়লে কর্মহীনতা কমে। এক্ষেত্রেও ভারতের অর্থনীতি অন্য নিদর্শন রাখছে। মুদ্রাস্ফীতির হার উচ্চ অবস্থানে থাকলেও বেকারি কমছে না। বরং শিক্ষিত যুবকদের বেকারি বেড়েছে। অন্য একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। তা হল শ্রমিকের জীবনযাত্রার মান। শ্রমিকের জীবনযাত্রার মান বাড়ে তখনই যখন তাঁদের প্রকৃত মজুরি বাড়ে। সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ন্যুনতম মজুরিকে প্রকৃত মজুরির সূচক হিসেবে দেখা যেতে পারে। বিগত বছরগুলিতে প্রকৃত ন্যুনতম মজুরি বাড়েনি। ফলে ধরেই নেওয়া যায় শ্রমিকের জীবনযাত্রার মান বাড়াতে মোদী সরকার সমর্থ হয়নি।

- অমিত দাশগুপ্ত

খণ্ড-31
সংখ্যা-13