লোকসভা নির্বাচনের প্রথম ভোট পড়তে আর বেশি দিন নেই। প্রায় সমস্ত জনমত সমীক্ষা, প্রধানমন্ত্রী এবং বিজেপির সুরে সুর মিলিয়ে বলছে, এবার ৫৪৩ জনের লোকসভায়, তাঁরা একাই ৪০০ আসন পাবেন। তা দেখে শুনে, অনেকেই হতোদ্যম হয়ে পড়ছেন, তবে কি বিজেপিকে কোনোভাবেই আর পরাজিত করা সম্ভব নয়? কিন্তু কিছু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, বিজেপি এবং প্রধানমন্ত্রী মোদী যদি এতোটাই নিশ্চিত হন, তাঁদের দলের তৃতীয়বারের ক্ষমতায় আসা নিয়ে, তাহলে তিনি গণতান্ত্রিক পদ্ধতি মেনে, নির্বাচনে বিরোধীদের পরাজিত করার কথা না বলে, সমস্ত বিরোধী দলগুলোকে এইভাবে হেনস্থা করছেন কেন? তাহলে কি উনি হেরে যাওয়ার ভয় পাচ্ছেন? তাহলে কি মনের কোনও একটি জায়গায় পরাজয়ের ভীতি প্রবেশ করেছে?
যেদিকেই তাকানো যাচ্ছে, সেদিকেই দেখা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাদের তৎপড়তা বেড়ে গেছে। স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পরে, লোকসভা নির্বাচন হচ্ছে, কোনোদিনও কি কেউ বলতে পারবেন, ইডি এবং সিবিআই এতটা তৎপড়তা দেখিয়েছেন এর আগে? সাধারণত নির্বাচন ঘোষণা হয়ে গেলে, যাবতীয় এই ধরনের বিষয়গুলো স্থগিত রাখা হয়, কিন্তু এবার দেখা যাচ্ছে উল্টো। নির্বাচন ঘোষণা হওয়ার পরে, বিরোধী ইন্ডিয়া জোটের অন্যতম দু’জন শরিক আম আদমি পার্টি এবং ঝাড়খন্ড মুক্তি মোর্চার প্রথম সারির নেতৃত্ব এবং সেই রাজ্যগুলোর মুখ্যমন্ত্রীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল এবং ঝাড়খন্ডের মুখ্যমন্ত্রী, হেমন্ত সোরেনকে গ্রেপ্তারের পরে, সারা বিশ্বের নানান দেশ থেকে সমালোচনা হলেও, নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর মন্ত্রীসভার সদস্যদের থামানো যাচ্ছে না। এমনকি উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড়, যিনি একটি সাংবিধানিক পদে বহাল, যাঁর দলীয় রাজনীতিতে মন্তব্য করা সমীচীন নয়, তিনি অবধি বলেছেন, বিদেশী কোনও দেশের উপদেশ নেওয়ার প্রয়োজন তাঁদের নেই। একদিকে গ্রেপ্তারি চলছে, পাশাপাশি বিভিন্ন জনসভায় প্রধানমন্ত্রী বলে বেড়াচ্ছেন, তিনি দুর্নীতির সঙ্গে আপোষ করবেন না, যে কোনও দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে এবং আগামীতেও হবে। এই কথা শুনে অনেকেই হয়তো ভাবছেন, এইরকম কঠোরতাই দরকার, দুর্নীতি রুখতে এইরকম শক্ত লোকই দরকার।
২০১৪ সালের আগে, দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের দুর্নীতি নিয়ে যখন রোজ খবর হচ্ছিল, তখন যুগপুরুষ হিসেবে নরেন্দ্র মোদীকে খুব সচেতনভাবে তুলে ধরা হয়েছিল। শ্লোগান উঠেছিল, ‘বহুত হুয়া ভ্রষ্টাচার, আবকি বার মোদী সরকার’। ক্ষমতায় আসার পরে গঙ্গা, যমুনা, নর্মদা দিয়ে বহু জল যাওয়ার পরে দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা, যাঁদের বিরুদ্ধে এতদিন তদন্ত চলছিল, তাঁদের বিজেপিতে অন্তর্ভুক্তি হচ্ছে। শুধু তাই নয়, তাঁদের বিরুদ্ধে যে তদন্ত চলছিল, সেই তদন্ত অবধি বন্ধ করা হচ্ছে। যাঁদের বিরুদ্ধে, সকাল থেকে রাত অবধি নরেন্দ্র মোদী আঙুল তুলতেন, সেই হিমন্ত বিশ্বশর্মা, শুভেন্দু অধিকারী, প্রফুল্ল প্যাটেল, ছগন ভুজাওয়াল কিংবা অজিত পাওয়ারদের আজকাল প্রধানমন্ত্রীর পাশেই দেখা যাচ্ছে। এমনকি, নরেন্দ্র মোদীর মন্ত্রীসভার অর্থমন্ত্রী, নির্মলা সীতারামন একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তাঁদের দলের দরজা, সকলের জন্য খোলা। যে কোনও মানুষ, যিনি দুর্নীতিগ্রস্ত হোন, কিংবা তাঁর বিরুদ্ধে যদি তদন্তও চলে, তাতেও সেই নেতাকে দলে নিতে তাঁদের আপত্তি নেই।
বিরোধী দলের নেতামন্ত্রীদের হেনস্থা এবং গ্রেপ্তারিতেই কিন্তু বিষয়টা থেমে নেই। প্রধান বিরোধী দল, কংগ্রেসের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, তাঁদের সমস্ত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে দেওয়া হয়েছে আয়কর দপ্তরের পক্ষ থেকে। বলা হয়েছে, যেহেতু কংগ্রেসের তরফ থেকে ২০১৭-১৮ সাল থেকে পরপর পাঁচ বছর, আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া হয়নি, তাই এই পথ নিতে বাধ্য হয়েছে আয়কর দপ্তরের পক্ষ থেকে। রাহুল গান্ধী, সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করেছেন, ৩০ বছর আগের অভিযোগ সহ আয়কর ফাঁকির অভিযোগ তুলে আয়কর দপ্তর শুধু শতাব্দী প্রাচীন দলটির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করেই ইতিমধ্যে বাজেয়াপ্ত করেছে ১৩৫ কোটি, যা আইনত করা যায় না। শুধু তাই নয়, কংগ্রেসের কাছে, আয়কর দপ্তরের তরফ থেকে প্রাথমিকভাবে ১৮২৩ কোটি টাকা ফাইন ধার্য করে চিঠি অবধি পৌঁছে গেছে। স্থাবর অস্থাবর মিলিয়ে কংগ্রেসের মোট সম্পত্তি ১৪৩০ কোটি টাকা। টাকা। শোনা যাচ্ছে, গত কয়েকদিনে আয়কর দপ্তর কংগ্রেসকে মোট ৩৫৩৬ কোটি টাকার নোটিস ধরিয়েছে। অর্থাৎ দলটি দেউলিয়া হয়ে গেলেও অত টাকা দেবার সাধ্য থাকবে না। আর ভোটের মুখে দলটির টাকা খরচ করার সাধ্যকে শূন্যে নামিয়ে আনাই লক্ষ্য। এই বিষয়টিকে কি সন্ত্রাস বলা উচিৎ নয়?
ইলেক্টোরাল বন্ডের থেকে যে টাকা বিজেপির ঘরে আসার ছিল তা সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বানচাল হয়ে যেতেই বিপক্ষকে আর্থিকভাবে পঙ্গু করার এই বিজেপীয় চাল দেশের ইতিহাসের কদর্যতার অধ্যায়ে লেখা থাকবে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচনের আগে এই কর-সন্ত্রাস নিয়ে ইতিমধ্যেই শোরগোল পড়ে গেছে। অনেকে বলছেন, কংগ্রেস নিজের দোষেই এই বিপদে পড়েছে। শুধু কংগ্রেস নয়, বাম দলগুলোর মধ্যে, সিপিআই(এম) এবং সিপিআই দলের নামেও আয়কর দপ্তরের চিঠি এবং শাস্তি ধার্য হয়েছে। বলা হয়েছে, তাঁরা যেহেতু পুরোনো প্যান কার্ড ব্যবহার করে কর জমা করেছেন, সেই কারণে তাঁদেরও জরিমানা দিতে হবে। সিপিআইকে বলা হয়েছে ১১ কোটি টাকা জরিমানা দিতে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, নির্বাচনী বন্ডে একমাত্র বাম দলগুলোই টাকা নেয়নি। এই অভূতপূর্ব কর সন্ত্রাসের মুখে দাঁড়িয়ে বিজেপি বিরোধী সমস্ত রাজনৈতিক দল প্রশ্ন তুলেছে, যে দল নির্বাচনী বন্ডে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে তাঁদের তো কোনও কেন্দ্রীয় সংস্থা হেনস্থা করছে না, তাঁদের তো আয়কর দপ্তরের চিঠি পেতে হচ্ছে না, তাহলে শুধু বিরোধী দলেদের ক্ষেত্রেই এই নিয়ম, নাকি তাঁরা বিজেপির চাপের কাছে মাথা নোয়ায়নি বলে এইরকম করা হচ্ছে তাঁদের? এই যে বিরোধী দলগুলোর থেকে ওয়াশিং মেশিনের উদাহরণ দেওয়া হচ্ছে এবং বলা হচ্ছে, যে ঐ মেশিনে ঢুকলেই সবার গায়ের নোংরা পরিষ্কার হয়ে যায়, তাহলে কি সেই অভিযোগটাই ঠিক?
শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, আয়কর দপ্তর, দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে জানিয়েছে, যে আপাতত নির্বাচন চলে আসার কারণে, তাঁরা কংগ্রেসের কাছ থেকে, জরিমানার টাকা আদায় করবে না, কিন্তু ভবিষ্যতে যে হবে না, তা কিন্তু বলা হয়নি। অর্থাৎ পরিষ্কার বোঝানো হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী এবং বিজেপির বিরুদ্ধে বেশি কথা বললে, আবার তাঁদের কোনও না কোনও হেনস্থার সম্মুখীন হতে হবে না, তার নিশ্চয়তা নেই।
- সুমন সেনগুপ্ত