ভারতের সংবিধানে নাগরিকত্ব সংক্রান্ত আদি আইন ১৯৫৫ সালে গৃহীত হয়। যে কেউ ভারতে জন্মালেই সে ভারতের নাগরিক হিসেবে গণ্য হবে — এই ছিল মূল কথা। তাছাড়া মূল ভারতীয় ভূখণ্ড (অর্থাৎ ব্রিটিশ ভারত)-এর যে কোনো ব্যক্তির ভারতীয় নাগরিক হওয়ার সহজ ব্যবস্থা ছিল।
পরবর্তীতে নাগরিকত্ব আইনে কিছু কিছু পরিবর্তন হয়। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হয় ২০০৩ সালে।
২০০৩ সালে ১৯৫৫’র আইনে তিনটি নতুন ধারা যুক্ত হয়। প্রথমত, জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকার কেড়ে নিয়ে উত্তরাধিকার সূত্রের কথা বলা হয়। শুধু ভারতে জন্মালেই হবে না, তার বাবা ও মা উভয়কেই ভারতীয় নাগরিক হতে হবে।
দ্বিতীয়ত, সকলকেই বিভিন্ন নথিপত্র দিয়ে নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে হবে এবং তার ভিত্তিতে সরকার একটা নাগরিকপঞ্জি বা তালিকা বানাবে এবং নাগরিকের পরিচয়পত্র দেবে। এই তালিকার নাম ‘ন্যাশনাল রেজিস্টার অব ইণ্ডিয়ান সিটিজেন্স’ বা এক কথায় এনআরসি।
তৃতীয়ত, অন্য দেশ থেকে এসে যারা ভারতে বসবাস করছেন তারা সকলেই বেআইনি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে গণ্য হবেন।
২০০৩ সালে নাগরিকত্ব আইনে এই তিনটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ‘সংশোধন’ আনে সেই সময়কার বিজেপি সরকার। দেশভাগের শিকার হয়ে ওপার বাংলা থেকে আসা সকল ব্যক্তি ও তার বংশধরদের বেআইনি অনুপ্রবেশকারী বানিয়ে দেয় এবং সমস্ত দেশবাসীর মাথায় এনআরসি’র খাঁড়া ঝুলিয়ে দেয়।
২০১৯ সালে আসামে এনআরসি’র ভহাবহ অভিজ্ঞতা সামনে আসে। নাগরিকত্বের প্রমাণ হাজির করতে কোটি কোটি মানুষের চরম হয়রানি, আতঙ্ক, জমিজায়গা বেচতে বাধ্যা হওয়া, বহু মানুষের আত্মহত্যা, ডি-ভোটার, ডিটেনশন ক্যাম্পের বিভীষিকা, জাতি-ধর্ম-ভাষা নির্বিশেষে ১৯ লক্ষ মানুষের বেনাগরিক হয়ে যাওয়া — বিজেপি নেতা অমিত শাহের ‘উইপোকা’ উক্তি।
দেশজুড়ে এনআরসি’র বিরুদ্ধে তীব্র গণক্ষোভ ছড়াতে থাকায় বিজেপি সামনে আনে নাগরিকত্ব আইনে নতুন সংশোধন — সিএএ-২০১৯। বিজেপি বলার চেষ্টা করে, সিএএ’র ফলে হিন্দুদের আর এনআরসি’র ভয় পাওয়ার কিছু নেই। অমিত শাহ বলেন, “ক্রনলজি সমঝিয়ে। পহলে সিএএ, উসকে বাদ এনআরসি”।
সিএএ-২০১৯এ বলা হয় যে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে নির্দিষ্ট কয়েকটি ধর্মের মানুষ ধর্মীয় কারণে উৎপীড়িত হয়ে ভারতে এলে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন জানাতে পারবে। মুসলমান, ইহুদি, নাস্তিক ইত্যাদিদের এই সুযোগের বাইরে রাখা হয়। এর বিরুদ্ধে দুই শতাধিক মামলা সুপ্রিম কোর্টে চলছে।
সংবিধানের ১৪নং ধারায় ভারতে বসবাসকারী যে কোনও ব্যক্তিকে আইনের চোখে সমান হিসেবে দেখার যে নির্দেশ দেওয়া আছে সিএএ তা লঙ্ঘন করছে, অন্যান্য সমস্ত ধরণের নিপীড়নকে গণ্য না করে (যথা, রাজনৈতিক, জাতিগত, গোষ্ঠিগত বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়গত কারণ) কেবলমাত্র ধর্মীয় নিপীড়নকেই নাগরিকত্ব প্রদানের জন্য গণ্য করা, ধর্মীয় পরিচিতিগুলির মধ্যেও বিশেষ কয়েকটিকে মান্যতা দিয়ে বাকিগুলিকে বাদ দেওয়া ইত্যাদি কারণে সিএএ-২০১৯-কে বহু আইনবিদ সংবিধান-বিরোধী আখ্যা দেন। স্পষ্টতই এই ‘ক্যা-২০১৯’ ধর্মীয় মেরুকরণের প্রচেষ্টা মাত্র।
সিএএ-২০১৯ লাগু করার নিয়ম কী হবে, কীভাবে ওপার বাংলা থেকে আসা লক্ষ লক্ষ মানুষ ও তাঁদের পরিবার নিজেদের ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার বলে প্রমাণ দেবেন তা নিয়ে ব্যাপক উদ্বেগ ছড়ায়।
পাঁচ বছর ঝুলিয়ে রেখে গত ১১ মার্চ সিটিজেনশিপ এমেন্ডমেন্ট রুলস বা সিএআর’২০২৪ জারি হয়। এতে আবেদন জানানোর যে নিয়ম ও যা যা প্রমাণপত্র দাখিল করার কথা বলা আছে তাতে স্পষ্ট যে, নাগরিকত্বের আবেদন জানানোর অর্থ নিজেকে এবং নিজের পরিবারকে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে ঘোষণা করে, এযাবৎ পাওয়া সমস্ত আইনি অধিকার খুইয়ে, পুলিশ ও প্রশাসনের কাছে আত্মসমর্পন করে, আবেদন মঞ্জুরির জন্য অনির্দিষ্টকাল অপেক্ষা করা। এক উচ্চ পর্যায়ের সংস্থা খতিয়ে দেখবে আবেদনকারীকে নাগরিকত্ব দেওয়া যাবে কী না। ততদিন সব নাগরিক অধিকার খুইয়ে আবেদনকারী ও তাঁর পরিবারের স্থান কোথায় হবে তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তাঁরা যে ডি-ভোটার হয়ে যাবেন, তাঁদের নামে থাকা সবকিছুই বেআইনি হয়ে যাবে এবং পুলিশ প্রশাসন ইচ্ছে করলে সব ধরনের হয়রানি চালাতে পারবে — এটুকু বোঝাই যায়, কিন্তু তাঁদের এখুনি ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দী করা হবে কিনা সে বিষয়টা স্পষ্ট নয়, যাদের আবেদন নাকচ হয়ে যাবে তাঁদের কী দশা হবে সেটাও বোঝা যাচ্ছে না।
এইসবই সাধারণ তথ্য মাত্র। সিএএ ও এনআরসি পরস্পর অবিচ্ছেদ্য প্রক্রিয়া। ভোটের আগে সিএএ রুলস আনা হয়েছে, ভোটে জিতলেই ওরা হয়তো নামিয়ে আনবে এনআরসি’র খাঁড়া।
(২৩ মার্চ ২০২৪, সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পক্ষে জীবন কবিরাজ কর্তৃক, তাহেরপুর, নদীয়া থেকে প্রকাশিত প্রচারপত্র)