বাস্তুতন্ত্র ও স্বাধিকার রক্ষায় সোনাম ওয়াংচুকের নেতৃত্ব লাদাখের আদিবাসীরা যখন অনশন সত্যাগ্রহ চালাচ্ছেন ঠিক তখন, গত ২৪ মার্চ ২০২৪ রাতে অজ্ঞাত পরিচয় দুস্কৃতিরা ছত্তিশগড়ের হাসদেও অরণ্যে আদিবাসীদের প্রতিবাদমঞ্চ আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়।
হাসদেও অরণ্য বাঁচাও সংঘর্ষ সমিতির অন্যতম নেতা রামলাল করিয়ম মূকনায়ক ওয়েবসাইটের সাংবাদিককে জানান, “কারা আগুন লাগিয়েছে তা জানি না। কিন্তু বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে যাদের রুখতে আমাদের আন্দোলন তারাই এই কাজ করিয়েছে।” হাসদেও অরণ্যের জীবন ও বাস্তুতন্ত্র আদানি কোম্পানির আগ্রাসন থেকে বাঁচাতে গত এক দশক ধরে আদিবাসীরা তীব্র সংগ্রাম চালাচ্ছেন।
দেড় বছর আগে, ২০২২’র গান্ধী জয়ন্তীতে হাসদেও অরণ্যের আদিবাসীরা যখন ফতেপুর গ্রামে একত্রিত হয়ে ছত্তিশগড়ের রাজধানী রাইপুর শহরের উদ্দেশে পদযাত্রা শুরু করে, তখনও তাঁদের পথ আটকাতে কোম্পানির গুণ্ডাবাহিনী নানারকম হামলা চালিয়েছিল। তবু তাঁরা সমস্ত বাধাবিঘ্ন মোকাবিলা করে ৩০০ কিলোমিটার পথ হেঁটে ১৪ অক্টোবর ২০২২ রাইপুর পৌঁছেছিলেন। রাজ্যপাল তাঁদের সাথে দেখা করেছিলেন। কংগ্রেস সরকারের মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের সাথে দেখা করে কথা দিয়েছিলেন হাসদেও অরণ্যে কয়লাখনির প্রথম পর্যায়ের অনুমোদন আদানি কোম্পানি কীভাবে পেল তা খতিয়ে দেখা হবে। কিন্তু তারপর কেন্দ্রের মোদী সরকার আদানিদের দ্বিতীয় পর্যায়ের অনুমোদনও দিয়ে দেয়।
গত ডিসেম্বরে ছত্তিশগড়ে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর ডাবল ইঞ্জিন সরকার আদানিদের খনির জন্য জঙ্গল সাফ করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু হয় পুলিশ বাহিনীর সশস্ত্র পাহারায় হাজার হাজার গাছ কেটে ফেলা ও আদিবাসী গ্রামগুলিকে সন্ত্রস্ত করার অভিযান। অরণ্য রক্ষায়, জীবন-জীবিকা ও স্বাধিকার রক্ষায়, আদিবাসী গ্রামগুলি একত্রিত হয়ে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদস্থল গড়ে তোলেন। গত ২৪ মার্চ রাতে এই প্রতিবাদমঞ্চ পুড়িয়ে দিল কোম্পানির দুষ্কৃতিরা।
হাসদেও অরণ্যকে বলা হয় ছত্তিশগড়ের ফুসফুস। ভারতে টিকে থাকা সর্ববৃহৎ অখন্ড অরণ্যভূমির অন্যতম হাসদেও। ভারতের ঠিক বুকের মাঝে এর অবস্থান। এই গভীর অরণ্য হাতি চিতা ভাল্লুক সহ বহু বন্যপ্রাণীর আবাস। এখানে আছে বিপুল জল সম্পদ। ভারতের এই এলাকায় বসবাসকারী মানুষেরা দেশের অন্যতম আদি বাসিন্দা। হাসদেও অরণ্যের মধ্যে আছে তিনশ’র উপর গোন্দ গ্রাম। গভীর অরণ্যের নীরব উদ্ভিদকুল ও জীববৈচিত্র্যের সাথে সাথে ধ্বংস হয়ে যাবে এই গ্রামগুলিও, আদানি কোম্পানির খোলামুখ কয়লাখনির গ্রাসে।
গত এক দশকে আদানিরা ক্রমাগত খনি এলাকা বাড়িয়ে চলেছে। ২০১৯’র মার্চ মাসে মোদী সরকার আরো এক লক্ষ সত্তর হাজার হেক্টর বা ১৭০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা তুলে দেয় আদানিদের হাতে। ২০০৬ সালের বনাধিকার আইনকে হাতিয়ার করে আদিবাসীরা যে প্রতিরোধ গড়ে তুলছিলেন সেই আইনকে বানচাল করে দিতে মোদী সরকার ২০২২ সালে নতুন বনসংরক্ষণ আইনের প্রস্তাব আনে যা ২০২৩এ পাস হয়ে গেছে। মোদী সরকারের এই নতুন আইন বনাঞ্চলের সংরক্ষণ ও সুরক্ষার বদলে বনের সংজ্ঞাই বদলে দেয় এবং আদিবাসীদের গ্রামসভাগুলির অধিকার খর্ব করে দিয়ে বনাঞ্চলকে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার আইনি বন্দোবস্ত পাকা করে।
মোদী সরকারের স্যাঙাত হিসেবে আদানি কোম্পানি একদিকে প্রকৃতি ও মানুষের জৈবনিক চক্র ধ্বংস করছে আবার অন্যদিকে বিশ্ব জলবায়ু সংকটের সুযোগ নিয়ে ‘সবুজ শক্তি’র একচেটিয়া উদ্যোক্তা হিসেবেও বিপুল মুনাফা লুটছে। লাদাখ থেকে শুরু করে হাসদেও, মোদী-আদানি স্যাঙাত দেশবাসীর অধিকার পদদলিত করে কেড়ে নিচ্ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রাণবায়ু। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিপর্যয়ের সাথে সাথে মোদী-বিজেপি সরকার হয়ে উঠেছে পরিবেশ বিপর্যয়েরও সমার্থক।
- মলয় তেওয়ারি