আস্তে আস্তে ভোটের দিন যত এগিয়ে আসছে, হুগলী-বর্ধমানের গঞ্জে-বাজারে চায়ের দোকানের আড্ডায় রাজনীতি নিয়ে গরম গরম কড়চাও তত জমে উঠছে। মেমারীর এক চায়ের দোকানের আড্ডার একটা খণ্ডচিত্র তুলে ধরা যাক। এক বিজেপি ঘেঁষা টোটো চালক বললেন, “তা দিদির কেবল ভোটের মুখেই অ্যাক্সিডেন্ট বাধে? সেবার নন্দীগ্রামে পা ভাঙ্গল আর এবার কিনা কালীঘাটে নিজের বাড়িতেই কপাল ফাটল!” মোটরভ্যান চালক আর একজন সাথে সাথেই চেঁচিয়ে উঠল, “হতেই পারে। অ্যাক্সিডেন্ট ইজ অ্যাক্সিডেন্ট।” প্রথমজন মানতে নারাজ। একই বিষয় নিয়ে দু’জনের চ্যাঁচামেচি চলতেই থাকল। এরই মধ্যে এক মাঝবয়সী লোক এক মোক্ষম প্রশ্ন তুলে আলোচনার মুখ ঘুরিয়ে দিলেন। তাঁর জিজ্ঞাসা, “মোদী বলেছেন, ইডি পশ্চিমবঙ্গে নগদ টাকা ও সম্পত্তি সমেত যে ৩০০০ কোটি টাকা বাজেয়াপ্ত করেছে তা ভোটের পরে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হবে। তা হ্যাঁ হে ছোকরারা, ভোটের পরে যা দেবে সেটা এখন বলার কী দরকার?” বিজেপি ঘেঁষা টোটো চালক সামান্য থতমত খেতেই পাশ থেকে একটা হালকা বয়সী ছেলে বলে উঠল, “কাকু, মোদীজির কোনো ভুল হয়নি। রাম জন্মানোর হাজার বছর আগে যদি রামায়ণ লেখা হয়ে থাকে তাহলে ভোটের পরে টাকা বিলোবার কথা আগেভাগে বলে মোদীজি তো নির্ঘাত রামভক্তের কাজই করেছেন।” সবাই হৈ হৈ করে হেসে ওঠে। এরপর ওই দোকানে রাজনীতির কথা বন্ধ হয়ে যায়। চলে আসে আলুচাষ, সবজি চাষে লাভ লোকসানের কথা। কিন্তু সে আর কতক্ষণ? ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চাষের কথার মধ্যেও রাজনীতি এসে পড়ে। ঠাট্টা করে হয়ত বলা হয়, “ভাতের হাঁড়ির মধ্যেও রাজনীতি!” কিন্তু ভাতের সমস্যা, হাতের কাছে কাজের সমস্যাই তো আসল রাজনীতি।
পূর্ব বর্ধমান কেন্দ্রে আমাদের প্রার্থীর সমর্থনে প্রচারে, সেজন্য কৃষি প্রশ্নকেই যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হচ্ছে। এই কেন্দ্রের মেমারী, কালনা, জামালপুর ও রায়নার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে মূলত আলু চাষই হল উপার্জনের একটা বড় উপায়। আর সেই আলু চাষেই সেখানে নেমে এসেছে বিরাট বিপর্যয়।
গতবছর (২০২৩) ৫-৬ ডিসেম্বরের তুমুল বৃষ্টি এবার আলু চাষে বড় মাত্রায় সংকট ডেকে এনেছে। বৃষ্টির বেশ খানিকটা আগে কিছু জমিতে যে আলু চাষ হয়, সেখানে আলু বেঁচে যায়। প্রত্যাশামত সেখানে ফলনও ভালো হয়। কিন্তু অধিকাংশ জমিতে বৃষ্টির পরে, স্বাভাবিক সময়ের অনেক দেরীতে, যে আলু বসানো হয়, তার ফলন হয়েছে খুবই কম পরিমাণে। অনিবার্যভাবেই কৃষকদের চাষের খরচ তো উঠবেই না, উল্টে মোটা টাকা লোকসান হবে। এ’বছর বিঘেপিছু (আলুচাষে) ৩০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়েছে। ডবল করে চাষের জন্য ওই খরচ পৌঁছেছে ৩২ হাজার টাকায়। সবচেয়ে শেষ দিকে যারা চাষ করেছেন তাঁদের খরচ এমনকি ৩৫ হাজার টাকাতেও গিয়ে ঠেকেছে। নিশ্চিতভাবেই সব চাষির লোকসান একই মাত্রার নয়। আলুর গড় ফলন খুব কম হওয়ায় অনেক চাষিই আলুর ভালো দাম পেয়েছেন। কেবলমাত্র বৃষ্টির আগে যারা আলু চাষ করেছিলেন, ভাল ফলন হওয়ায় তাঁদের কিছু লাভ তো হয়েইছে, এমনকি বৃষ্টির পর চাষ করা আলু থেকেও কিছু চাষি লাভবান হয়েছেন। কিন্তু এদের সংখ্যা আঙ্গুলে গোনা। অধিকাংশ চাষিই বড় রকমের ধাক্কা খেয়েছেন।
একটা তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা যেতে পারে। বৃষ্টির আগে চাষ করে কোনো চাষি ৪ বিঘে জমিতে আলু ফলিয়েছেন ৩০০ বস্তা (গড়ে ৭৫ বস্তা/প্রতি বিঘা)। প্রথমদিকে বাজার খুব চড়া ছিল না। তিনি ৬১০ টাকা বস্তা দরে ২০০ বস্তা আলু বিক্রি করে চাষের খরচ তুলে ফেলেছেন। বাকি ১০০ বস্তা তিনি হিমঘরে রেখেছেন। যেহেতু পর্যাপ্ত আলুর অভাবে হিমঘরগুলি পুরো ভরাট হবে না, সে কারণে আশা করা যায়, ওই চাষি ভবিষ্যতে আলু বেচে ভালো লাভের মুখ দেখবেন।
ঠিক বিপরীত ছবিটা কেমন? এক গরিব চাষি ১.৫ বিঘে জমি ঠিকে নিয়েছিলেন। এজন্য ১৫ বস্তা আলু মালিককে দেওয়ার চুক্তি হয়েছিল। বৃষ্টির পরে চাষ করে, তাঁর ফলন হয়েছে মাত্র ১২ বস্তা! মালিকের কাছে নতজানু হয়েও তাঁর চোখ থেকে অঝোরে জল ঝরতেই থাকবে। ব্যাপারটা অতিরঞ্জিত মনে হতে পারে। তবে যাঁরা সার, কীটনাশক ইত্যাদি সময় ও পরিমাণমত দিতে পারেননি — এমন বহু গরিব চাষির ক্ষেত্রে এ ব্যাপারটাই ঘটেছে।
মধ্য ও স্বচ্ছল চাষিদের ক্ষেত্রে, উৎপাদন এমন খারাপ না হলেও প্রায়শই তা বিঘে পিছু ৪৫-৪৬ বস্তার আশপাশে থেকেছে। এই সময় অবশ্য আলুর বাজার দর ৭০০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। ফলে কিছু চাষি অতি সামান্য লাভের মুখ দেখলেও অনেকের ক্ষেত্রেই বড়জোর দু’মুখ প্রায় সমান থেকেছে। খুবই ব্যতিক্রম হিসেবে, সামান্য কিছু ক্ষেত্রে বিঘেয় ১০০ বস্তাও ফলেছে। কিন্তু ব্যাপক ব্যবহৃত ‘জ্যোতি’ আলুর ক্ষেত্রে এটি ঘটেনি। হিমালিনী বা নতুন উচ্চ ফলনশীল ‘১২১ প্রজাতির’ আলুর ক্ষেত্রেই ভালো ফলন চোখে পড়েছে। কিন্তু এই দুই শ্রেণীর আলু বীজের দাম জ্যোতি আলুর বীজের থেকে (২৫০০/বস্তা) অনেক বেশি (৩৫০০/বস্তা) হওয়ায়, কম সংখ্যক চাষিই এই আলু চাষ করেছিলেন।
তবে বড় গণ্ডগোলটা বেধেছে ‘পেপসিকো’র আলু চাষে। আলুর বাজার দর কোনো কোনো বছর খুব নিচে নেমে আসায় ইদানীং অনেক চাষি (বিশেষত অকৃষক জমির মালিকরা) পেপসি আলু চাষের দিকে ঝুঁকেছেন। পেপসি কর্তৃপক্ষ (আসলে কোম্পানির এজেন্ট বা সাব এজেন্ট ) চাষিদের সাথে দাম নিয়ে আগাম চুক্তি করে। এবারে পেপসি বস্তা পিছু ৪৯০ টাকাতে চুক্তি করে। অথচ এখন আলুর বাজার দর ৭০০ টাকার কম নয়। চাষিরা হাত কামড়াচ্ছেন। পেপসি আলুর ফলনও হয়েছে খুব কম। কেউ ২.৫ বিঘে চাষ করে পেয়েছেন ৭০ বস্তা। কেউ ১.৫ বিঘে চাষ করে ৬০ বস্তা। কোনো কোনো মৌজায় এবার ৭-৮শ বিঘে জমিতে পেপসি চাষ হয়েছিল। চাষিদের এখন মাথায় হাত। ‘পেপসিকো’ অবশ্য নাকের বদলে নরুন ধরাচ্ছে। তারা বলছে, যাদের দু’বার করে চাষ করতে হয়েছে তাদের একবারের বীজের দাম কোম্পানি নেবে না। সরকার নীরব দর্শক আর ‘পেপসিকো’র মতো কোম্পানি কৃষিজাত শিল্পের নামে বেমালুম লুট চালিয়ে যাচ্ছে। এনিয়ে পৃথকভাবে চর্চা হতে পারে। কিন্তু সরকারের যেখানে সত্যিই হস্তক্ষেপ দরকার সেখানে কী চলছে?
সকলেই জানে, মধ্য ও স্বচ্ছল চাষিরা ব্যাঙ্ক বা সমবায় থেকে চাষের জন্য লোন পেয়ে থাকেন। আইন থাকুক বা নাই থাকুক, সমবায়গুলি লোনের একটা অংশ (বীমার) প্রিমিয়াম বাবদ কেটে নেয়। ফসলের ক্ষতির জন্য রাজ্য সরকার আদৌ কোন ব্যবস্থা নেবে কিনা তার ঠিক নেই, সমবায় সমিতিগুলি কিন্তু লোনের টাকা উশুল করতে এক পায়ে খাড়া। তারা উঠতে বসতে চাষিকে লোনের টাকা মেটানোর জন্য ফোন করছে। যেমন মেমারীর আমাদপুর সমবায় সমিতি থেকে এক ক্ষুদ্র কৃষকের কাছে বারবার ফোন আসে। তিনি এক বিঘে জমিতে আলু চাষের জন্য নিয়মমাফিক পঁচিশ হাজার টাকা লোন পেয়েছেন। বোরো ধান চাষ অবধি তাঁর এই লোন পরিশোধের মেয়াদ। তবু এখনই তাঁকে ঋণ শোধ করার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে। আলু চাষের জলকর মেটাননি বলে তাঁর বোরো ধানে জল দেওয়া অবধি বন্ধ করে দিয়েছে। দায়ে পড়ে, তিনি বকেয়া জলকর মিটিয়ে দিয়েছেন। অথচ ওই ক্ষুদ্র কৃষক জানাচ্ছেন, ওই সমবায় সমিতি নাকি একজন হিমঘর মালিককে বহু আগে ৬০ লক্ষ টাকা লোন দিয়েছে — যা এখনও অনাদায়ী পড়ে রয়েছে। কারণ হিসেবে সমিতি নাকি বলেছে, ওই হিমঘরটি সমবায় কিনে নেবে। হয়ত আমাদপুর সমবায় কোনো দিন কোনো কোল্ডস্টোরের মালিক হবে। কিন্তু তাতে কৃষকদের কোন স্বার্থ রক্ষিত হবে? মেমারীর পার্শ্ববর্তী পান্ডুয়ার বৈঁচিতে সমবায় চালিত একাধিক কোল্ডস্টোরে চাষির আলু সংরক্ষণ করা হয় যৎসামান্য। সমবায় স্টোর ভরাট হয় প্রাইভেট স্টোর মালিকের আলু মজুত করে।
গভীর সংকটে ডুবে যাচ্ছে কৃষিক্ষেত্র। মরণাপন্ন কৃষক, অথচ সরকার নির্বিকার। এ জিনিস চলতে পারে না। সে কারণে, বাস্তবের রুক্ষ জমির ওপর পা রেখে উঠে দাঁড়াচ্ছে সিপিআই(এমএল)। পূর্ব বর্ধমান লোকসভা কেন্দ্রে রাজনৈতিক প্রচারে তুলে ধরা হচ্ছে বিপন্ন আলুচাষিদের ন্যায্য দাবিগুলি। রাজ্য সরকারকে আলু চাষের জন্য দেওয়া ঋণ মকুব করতে হবে। আলু চাষের লোকসানের জন্য উপযুক্ত পরিমাণে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। বাংলা শস্যবীমার আওতায় কৃষকের কাছ থেকে নেওয়া প্রিমিয়ামের টাকা সরকারকে অবিলম্বে ফেরত দিতে হবে। শুধু প্রচার নয়, ইতিমধ্যেই একাধিক স্থানে সংগঠিত হয়েছে বিক্ষোভ আন্দোলন। এ আন্দোলনে আরও বড় মাত্রায় কৃষক সমাজকে সামিল করতে হবে।
- মুকুল কুমার