সংবাদে প্রকাশ, ভোট মিটলেই টেলিকম মাশুল লাফ দিয়ে বাড়বে ১৫ থেকে ১৭ শতাংশ হারে! ইতিমধ্যেই বহুগুণ বাড়ল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ওষুধপত্রের দাম। রহস্যাবৃত নির্বাচনী বন্ডের আল্ফানিউমেরিক সংখ্যার প্রহেলিকা আব্রুবিহীন হওয়ার পর নিত্যনতুন তথ্য প্রকাশ পাচ্ছে, আর দেখা যাচ্ছে, হরেক সংস্থা — টেলিকম, নির্মাণ কর্পোরেট ওষুধ সংস্থাগুলি বিপুল অর্থের বিনিময়ে যে সমস্ত নির্বাচনী বন্ড কিনেছিল, এবার তারাও মওকা দেখে নিজেদের প্রাপ্য বুঝে নিচ্ছে — মাশুল বাড়িয়ে পকেট কাটতে শুরু করেছে সাধারণ মানুষের।
দেখা যাচ্ছে, ৩৩টি কর্পোরেট সংস্থা, যাদের ২০১৬-১৭ থেকে ২০২২-২৩ পর্বে সামগ্রিক লোকসান (এগ্রিগেট লস) এক লক্ষ কোটি টাকারও বেশি, তারা নির্বাচনী বন্ড কিনেছিল প্রায় ৫৮২ কোটি টাকার আর যার ৭৫ শতাংশই গেছে বিজেপির কোষাগারে! রহস্যের অবগুণ্ঠন অপসৃত হওয়ার পর দেখা গেল — লোকসানে চলা সংস্থাগুলো মোটা টাকার বিনিময়ে বন্ড কিনেছে, মুনাফা কামানো সংস্থাগুলো তাদের মোট লাভের থেকে অনেক বেশি টাকা দিয়েছে। কিছু কিছু সংস্থা তাদের নিট মুনাফার কোনো রিপোর্ট জমা করেনি, বা সমস্ত কর দেওয়ার পর কত মুনাফা থাকল, তাও প্রকাশ করেনি। আরো কৌতুকের ব্যাপার হল, বেশ কিছু সদ্য নথিভুক্ত সংস্থা আবির্ভূত হওয়ার তিন বছর আগেই নিয়ম বহির্ভূতভাবেই মোটা অঙ্কের নির্বাচনী বন্ড কিনেছে — বেনিয়মে সন্দেহজনক সংস্থার মাধ্যমে নির্বাচনী বন্ড কেনার তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।
মুনাফা না হওয়া সত্ত্বেও ভারতী গ্রুপ তার দুটি সংস্থা — ভারতী এয়ারটেল ও ভারতী টেলিমিডিয়া নির্বাচনী বন্ড মারফত শুধু বিজেপি’কেই দিয়েছে ২৩৪ কোটি টাকা। আর, বিরাট লোকসানে চলা আদিত্য বিড়লা গ্রুপের ভোদাফোন-আইডিয়া, বা সংক্ষেপে ভিআই’র ডুবন্ত সংস্থাকে বাঁচাতে মোদী সরকার এক ‘বেলআউট’ প্যাকেজ নিয়ে আসে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নির্বাচনী বন্ড মারফত বিজেপিকে ১০০ কোটি টাকা দেওয়ার দু’মাসের মধ্যেই বিড়লা গ্রুপ বেলআউটের নামে সেই উপঢৌকন পেয়ে যায়। আর, এখন সেইসব অনুদান কড়ায় গন্ডায় উশুল করতে মাশুল বৃদ্ধির পথ ধরেছে টেলিকম সংস্থাগুলি।
যে চারটি আইনকে সংশোধন করে মোদী সরকার নির্বাচনী বন্ড নিয়ে এল, শীর্ষ আদালত তার তিনটিকেই অসাংবিধানিক বলে চিহ্নিত করেছে। মোদীর আমল এমনকি লোকসানে চলা সংস্থাগুলোর জন্যও দরজা খুলে দেয়, যা আগের স্কিমে ছিল না। বারংবার রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এবং নির্বাচন কমিশন সেই সময়ে এই আশঙ্কা প্রকাশ করে যে নির্বাচনী বন্ডকে ব্যবহার করা হবে কর ফাঁকি, অসদুপায়ে বা বেআইনি পথে সংগৃহীত মুলধনকে আইনি প্রসাধনে সাজানোর উপায় হিসাবে। নানা শেল কোম্পানি মারফত, লোকসানে চলা বা সদ্য গজিয়ে ওঠা সংস্থাগুলোর নির্বাচনী বন্ড কেনার এই হিড়িক অনেক প্রশ্ন তুলে দিয়েছে, যার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দাবি জানায়।
নিজেদের আর্থিক অপরাধ থেকে পার পেতে, শাঁসালো সরকারি বরাত কব্জা করতে, বিপুল কর ফাঁকিকে আইনি করতে, বেআইনি পথে অর্জিত টাকা ভুয়ো সংস্থার মাধ্যমে সাদা করতে নির্বাচনী বন্ড ছিল কর্পোরেটদের কাছে মোদীর সবচেয়ে বড় উপহার। এই রহস্যাবৃত অস্বচ্ছ অন্ধকারে ঢাকা বন্ড আজ দিনের আলো পেতেই উন্মুক্ত হল বিরাট অপরাধের ইতিবৃত্ত — মোদী সরকার যার সৃষ্টিকর্তা।
ভারতের শীর্ষ আদালতের সাংবিধানিক বেঞ্চ যে নির্বাচনী বন্ডকে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়ে বাতিল করে, সেই পদক্ষেপকেই চ্যালেঞ্জ করে মোদী বললেন তা নাকি দেশকে কালো টাকার দিকে ঠেলে দিয়েছে। আচমকা নোট বাতিলের বিপর্যয়কারী সিদ্ধান্তকে সেই সময় মোদী কালো টাকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা হিসাবে ব্যাখ্যা করেন। দেখা গেল, কালো টাকা বাজেয়াপ্ত হল না, উল্টে তা সাদা হয়ে আবার ব্যাঙ্কেই ফিরে এলো। এবারেও দেখা গেল, নির্বাচনী বন্ড চালুই করা হয়েছিল অনৈতিক অন্যায় অসাংবিধানিক স্বার্থকে চরিতার্থ করতে।
স্বাধীনতা উত্তর বৃহত্তম আর্থিক কেলেঙ্কারির খলনায়ক এই মোদী সরকারকে তাই আসন্ন নির্বাচনে কেন্দ্রীয় ক্ষমতা থেকে টেনে নামানোই ভারতবাসীর পবিত্র কর্তব্য।