( সম্প্রতি দেশের বহু ঢাক পেটানো আর্থিক বৃদ্ধি নিয়ে কয়েকজন প্রথম সারির অর্থনীতিবিদ প্রশ্ন তুলেছেন। একজন হলেন, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ভূতপূর্ব গভর্নর রঘুরাম রাজন, আর আরেকজন হলেন কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাক্তন মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যন। আমরা তাঁদের বক্তব্য এখানে তুলে ধরছি। - সম্পাদকমন্ডলী, আজকের দেশব্রতী )
“দেশের আর্থিক বৃদ্ধিকে বাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখানো হচ্ছে যা ভারত বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। এটা তার সবচেয়ে বড় ভুল”, বললেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন। তিনি বলেছেন, “অর্থব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু কাঠামোগত সমস্যা থেকে যাচ্ছে, যা সমাধান করার উপরই দেশের অগ্রগতি নির্ভর করছে।”
তাঁর মতে, নির্বাচনের পর ক্ষমতায় যে সরকার আসীন হবে তার সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে শ্রমশক্তির শিক্ষার গুণমান ও দক্ষতা বাড়ানো। এই সমস্যা মোকাবিলা করতে না পারলে ভারত তার তরুণ জনসংখ্যার থেকে ফসল তুলতে পারবে না — ১৪০ কোটির দেশের মধ্যে যাদের সংখ্যা প্রায় অর্ধেক আর বয়স ৩০’র মধ্যে।
“ভারত সবচেয়ে বড় ভুল করবে যদি বাড়িয়ে চাড়িয়ে তুলে ধরা ওই আর্থিক বৃদ্ধির প্রতি আস্থা রাখে। ওই গালগল্পকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে আরও বহু বছর আমাদের পরিশ্রম করতে হবে। রাজনীতিবিদেরা আপনাদের ওই অবাস্তব কথাকে বিশ্বাস করাতে চাইবে। কিন্তু তা বিশ্বাস করলে মারাত্মক ভুল হবে।”
২০৪৭’র মধ্যে ভারত এক উন্নত অর্থব্যবস্থায় উন্নীত হবে, মোদীর এই দাবিকে রাজন ‘স্রেফ বাজে কথা’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এখনও বহু পড়ুয়া উচ্চ মাধ্যমিকের গন্ডি পেরোতে পারে না। স্কুল-ছুটের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। আমাদের শ্রমশক্তি ক্রমবর্ধমান। সেখান থেকে ফসল তুলতে গেলে তাঁদের জন্য শোভন কাজ জোটাতে হবে। আমাদের সামনে এই সমস্যাটাই রয়েছে।
রাজন বিভিন্ন সমীক্ষার ফলাফল তুলে ধরে দেখান, কোভিডের পর দেশে স্কুল পড়ুয়াদের শিক্ষার মান ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ২০১২’র আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। মাত্র ২০.৫ শতাংশ তিন ক্লাসের পড়ুয়া ক্লাস দুই’এর বই পড়তে পারছে। স্বাক্ষরতার মানের ক্ষেত্রে অন্যান্য এশিয় দেশ, যেমন ভিয়েতনামের নিচে এখন ভারতের স্থান।
উচ্চশিক্ষা খাতে বাজেটের ব্যয় বরাদ্দ না বাড়িয়ে বিপুল সরকারি ভর্তুকি দিয়ে চিপ উৎপাদনের ‘বিপথগামী’ নীতিকে রাজন সমালোচনা করেছেন। দেশে সেমি-কন্ডাক্টার ব্যবসা স্থাপনের জন্য মোদী সরকার খরচ করছে ৭৬০ বিলিয়ন (এক বিলিয়ন = ১০০ কোটি) টাকা। আর, উচ্চশিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ মাত্র ৪৭৬ বিলিয়ন টাকা।
চিপ উৎপাদনের মতো হাই প্রোফাইল প্রকল্পের দিকে মোদী সরকারের বেশি নজর, কিন্তু প্রশিক্ষিত প্রযুক্তিবিদ তৈরি করার লক্ষ্যে শিক্ষা ব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনো চিন্তা ভাবনাই বর্তমান সরকারের নেই, বলেছেন রাজন।
শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি রাজন আগামী দিনে নির্বাচিত সরকারের জন্য কিছু নীতিগত অগ্রাধিকার রেখেছেন। তাঁর মতে, আর্থিক অসাম্যকে কমানো, শ্রমনিবিড় উৎপাদনের দিকে জোর দেওয়া দরকার। ভারতের প্রশাসনিক ব্যবস্থা ক্রমেই কেন্দ্রীভূত হয়ে উঠছে। তার বিপরীতে, দ্রুত বিকাশের স্বার্থে রাজ্যগুলির হাতে আরও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের কথা তিনি বলেছেন। (ইকনমিক টাইমস, ২৬ মার্চ ২০২৪)
এদিকে, চলতি অর্থবর্ষের তৃতীয় ত্রৈমাসিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৮.৪ শতাংশ। যা প্রায় সমস্ত মূল্যায়ন সংস্থার পূর্বাভাসকে ছাপিয়ে গিয়েছে। অবাক করেছে অর্থনীতিবিদদের একাংশকে। কেন্দ্রের প্রাক্তন মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যনের বক্তব্য, এই হার ‘রহস্যজনক’, যা ‘হৃদয়ঙ্গম’ করাও কঠিন।
বিভিন্ন মূল্যায়ন সংস্থার সমীক্ষায় ব্যাখ্যা করা হয়েছিল, গত ত্রৈমাসিকে আর্থিক বৃদ্ধির হার হতে পারে ৬.৫ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশের মধ্যে। কিন্তু, সরকারি পরিসংখ্যান প্রকাশের পর দেখা যায়, আলোচ্য সময়ে জিডিপি বেড়েছে ৮.৪ শতাংশ হারে। যা গত দেড় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। শুধু তাই নয়, আগের দুই ত্রৈমাসিকের বৃদ্ধির হারেও বড় সংশোধন আনে সরকার। এপ্রিল-জুনে তা ৭.৮ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে করা হয় ৮.২ শতাংশ। জুলাই-সেপ্টেম্বরে ৭.৬ শতাংশ থেকে বেড়ে হয় ৮.১ শতাংশ। গোটা অর্থবর্ষে বৃদ্ধির পূর্বাভাসও বাড়িয়ে ৭.৬ শতাংশ করা হয়। সুব্রহ্মণ্যন বলেন, “আমি সৎ ভাবেই আপনাদের বলতে চাই, সর্বশেষ জিডিপি’র হিসাব আমি বুঝতে পারিনি। ওই পরিসংখ্যান রহস্যজনক। হিসাবেই আনা যাচ্ছে না। এর অর্থ আমার বোধগম্য হচ্ছে না।”
গত ত্রৈমাসিকে জিডিপি’র পরিসংখ্যান নিয়ে অবশ্য অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। দেশের প্রাক্তন মুখ্য পরিসংখ্যানবিদ প্রণব সেন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, দেশের বাজারের চাহিদার পরিস্থিতির সঙ্গে জিডিপি’র একটা সামঞ্জস্য থাকে। এক্ষেত্রে দুই পরিসংখ্যানের অনেক ফারাক রয়েছে। অর্থনীতিবিদদের একাংশের ব্যাখ্যা, এবার অনিয়মিত বর্ষার ফলে কৃষিক্ষেত্রের অগ্রগতি মসৃণ ছিল না। খাদ্যপণ্যের ছেঁকায় হাত পুড়েছে সাধারণ মানুষের। ফলে অত্যাবশ্যক পণ্য বাদে অন্যান্য পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধির হারও মন্থর, ৩ শতাংশের আশপাশে। সন্তোষজনক নয় শিল্পোৎপাদনের হারও।
প্রাক্তন মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা বলেছেন, “সরকার বারবার বলছে বিনিয়োগের জন্য ভারত এখন আদর্শ জায়গা। কিন্তু বাস্তব হল, গত কয়েক বছরে প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নি, বেসরকারি লগ্নি এবং কর্পোরেট লগ্নি কমেছে।” তিনি আরও বলেছেন, এদেশের মানুষের মধ্যে একটা ধারণা রয়েছে যে, ভারত খুব বড় বাজার। এই ধারণা থেকে তাদের বার হয়ে আসতে হবে। ভারতের অর্থনীতির বহর ৩ লক্ষ কোটি ডলারের বেশি। কিন্তু, এর মধ্যে মধ্যবিত্তের বাজার মাত্র ৭৫,০০০ কোটি ডলার। গোটা বিশ্বের তা ২০-৩০ লক্ষ কোটি ডলার।
প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক পরামর্শদাতা পরিষদের সদস্য শমীকা রবি স্বীকার করেন যে, বেসরকারি লগ্নি বিপুল ধাক্কা খেয়েছে। তবে তা নাকি দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের নীতির দীর্ঘমেয়াদি ফল।
(আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৬ মার্চ ২০২৪)