একশ দিনের কাজ ও মজুরি বৃদ্ধির প্রহসন
hundred-days-of-work-and-wages

দেশে সাধারণ নির্বাচনের ভরা মরসুমেই মোদী সরকার ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প খাতে মজুরি বাড়াল, নির্বাচন কমিশনের অনুমতি নিয়ে। কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের জন্য নতুন মজুরি ঘোষণা করেছে। এ’রাজ্যের কপালে জুটল নামমাত্র ৫.৪৯ শতাংশ বৃদ্ধি, অর্থাৎ আগে ছিল ২৩৭ টাকা, এবার হল ২৫০ টাকা। গোটা দেশে গড়ে দৈনিক মজুরি বেড়েছে দৈনিক ২৮ টাকা, অর্থাৎ ৭ শতাংশের মতো। ১ এপ্রিল থেকে দৈনিক গড় মজুরি বেড়ে হবে ২৮৫ টাকা ৪৭ পয়সা। সেই সাপেক্ষে এ’রাজ্যে ২৫০ টাকা দৈনিক মজুরি ও ৫.৪৯ শতাংশ বৃদ্ধি, দু’টিই কম।

বিভিন্ন রাজ্যে গড়ে এই মজুরি বৃদ্ধি হয়েছে ৩ থেকে ১০.৫ শতাংশ হারে। হরিয়ানায় ১০০ দিনের কাজের মজুরি সব থেকে বেশি বেড়েছে — দৈনিক ৩৭৪ টাকা। আর, সব থেকে কম বৃদ্ধি হয়েছে অরুণাচল প্রদেশ ও নাগাল্যান্ডে, দৈনিক ২৩৪ টাকা। শতাংশের সাপেক্ষে সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি হয়েছে গোয়ায় (১০.৫৬ শতাংশ), তারপর কর্নাটক (১০.৪ শতাংশ)। উত্তরপ্রদেশ ও উত্তরাখন্ডে বৃদ্ধির শতাংশের হার সর্বনিম্ন — মাত্র ৩ শতাংশ।

গোটা দেশে, কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সক্রিয় ১০০ দিন প্রকল্পের সাথে যুক্ত মজুরের সংখ্যা a-farce-of-one-hundred-days-of-work-and-wages১৪.৩৪ কোটি, পরিবারপিছু গড়ে যারা ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে কাজ পেয়েছেন মাত্র ৫১ দিন। গত অর্থবর্ষে এই একশ দিনের কাজে মজুরি ছিল মাত্র ২৬৭ টাকা। দেশের কী বিপুল সংখ্যক কর্মক্ষম মানুষ কত কম মজুরি নিয়ে অসংগঠিত ক্ষেত্রের সবচেয়ে নিম্নমানের কাজের সাথে যুক্ত এই মোদী জমানায়! তাও এই রোজগার নিয়মিত নয়, বরং সারা বছরে গত অর্থবর্ষে তাঁদের কপালে ওই কাজ জুটলো মাত্র ৫১ দিন। আর কোনো উন্নতমানের কাজ খুঁজে না পেয়ে তাঁরা বাধ্য হচ্ছেন এই রোজগার নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে। এটা আমাদের দেশে দারিদ্রের, কর্মক্ষেত্রের গুণমান ও রোজগারের ধরণের নিদারুণ বাস্তবতাকে দেখিয়ে দেয়।

এ’বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে গ্রামোন্নয়ন ও পঞ্চায়েত রাজের সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটি যে সুপারিশ পেশ করে তাতে স্পষ্টই বলা হয়, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির সাথে ভোগ্যপণ্য সূচক — কৃষি শ্রমিকের মূল্যযুক্ত (সিপিআই-এগ্রিকালচারাল লেবার) ভিত্তিক মজুরি নির্ধারণের এই রেওয়াজ যথাযথ নয়। এই কমিটি মজুরি বৃদ্ধির দাবি করে। সংসদীয় কমিটি সমালোচনা করে বলে, ২০২৩-২৪-এ মনরেগা খাতে বরাদ্দের প্রস্তাব ছিল ৯৮,০০০ কোটি টাকা, যা আবার সংশোধিত হয়ে দাঁড়ায় ৮৯,৪০০ কোটি টাকা। কিন্তু বাস্তবে বরাদ্দ করা হয় ৬০,০০০ কোটি টাকা। এই হ্রাসপ্রাপ্ত বাজেট বরাদ্দ যে এই গুরুত্বপূর্ণ গ্রামীণ রোজগার যোজনায় বিরাট নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, তা উল্লেখ করেছে এই কমিটি।

২০১০-১১-কে ভিত্তিবর্ষ ধরে, মজুরি নির্ধারণ করা হচ্ছে ভোগ্যপণ্য সূচক — কৃষি শ্রমিকের উপর দাঁড়িয়ে (সিপিআই-এগ্রিকালচারাল লেবার)। যা বর্তমানে মূল্যস্ফীতির সাথে সাযুজ্য বজায় রাখছে না। মনরেগার জন্য বিজ্ঞান ভিত্তিক মজুরি নির্ধারনের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার নিযুক্ত এক কমিটি, মহেন্দ্র দেব কমিটির সুপারিশ ছিল সিপিআই’এ এল’এর বদলে তা নির্ধারিত হোক সিপিআই-রুরাল লেবারার বা আরএল’এর ভিত্তিতে। অথবা অনুপ সথপতি’র প্রস্তাবিত দৈনিক মজুরি ৩৭৫ টাকা করা হোক। কিন্তু কোন সুপারিশই কেন্দ্র আমল দিল না। কোন পদ্ধতিতে প্রতিবছর মনরেগার মজুরি নির্ধারিত হচ্ছে, তা কেন্দ্রীয় সরকার জনসমক্ষে প্রকাশ করে না, ফলে তা নিয়ে আলাপ আলোচনা বা বিতর্কের অবকাশ থাকে না। মজুরি নির্ধারণ প্রশ্নে এই অস্বচ্ছতা এই আইনের মূল স্পিরিটের বিরুদ্ধেই যায়। ঝাড়খন্ডের মতো হাতে গোনা দু’একটি রাজ্য নিজেদের রাজ্য বাজেট থেকে মজুরি খাতে টাকা বাড়িয়েছে (১৯৮ টাকা থেকে ২২৫ টাকা)। বেশিরভাগ রাজ্য সরকার কিন্তু নিজ নিজ রাজ্যে হরেক জনপ্রিয়বাদী প্রকল্প খাতে অনেক টাকা ব্যয় করলেও শ্রম বাজারে গরিবদের মজুরি বৃদ্ধির জন্য কানাকড়িও বাড়ায় না।

সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, কেন্দ্রীয় সরকার কেন মনরেগা’র মজুরদের ন্যূনতম মজুরি দেবে না? সুপ্রিম কোর্ট একাধিকবার বিভিন্ন রায় দিতে গিয়ে বলেছে, ন্যূনতম মজুরি হল এক মৌলিক অধিকার, আর নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরির থেকে কম মজুরি দেওয়ার অর্থ ‘দাস প্রথার প্রবর্তন’। মজুরি প্রদানের রয়েছে এক আইনি বাধ্যতা। বাজেট বরাদ্দের সাথে তা যুক্ত করা বেআইনি। কেন্দ্রীয় সরকারের সদ্য ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি একজন কৃষি শ্রমিক যা আয় করেন, তার তুলনায় অনেক কম। দেখা যাচ্ছে, ২০২৩’র অর্থবর্ষে একজন কৃষি মজুরের দৈনিক মজুরির তুলনায় মনরেগা’র মজুরি গড়ে ১০৫ টাকা কম। কেরল রাজ্যে এই ফারাক সর্বোচ্চ, যা অত্যন্ত প্রকটভাবে দেখা যায়। সেখানে ২০২৩-২৪-এ মনরেগার দৈনিক মজুরি যখন ৩৩৩ টাকা, তখন পুরুষদের কৃষিকাজে ২০২২-২৩এ দৈনিক মজুরি ৭৬৪.৩ টাকা — অর্থাৎ পার্থক্য ৪৩১ টাকা।

দিনকয়েক আগে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত হল মিন্ট ইন্ডিয়া ইনভেস্টমেন্ট সামিট। সেখানে দেশের অর্থনীতির সামনে যে সমস্ত বড় বড় চ্যালেঞ্জগুলো উঠে আসছে তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রায় সমস্ত আলোচকেরা বলেছেন, ভোগব্যয় বাড়ানো, বিশেষ করে বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে ভোগব্যয় বাড়াতে নজর ফেরানো, ক্রমে চওড়া হওয়া আর্থিক অসাম্যকে কমিয়ে আনা দেশের অর্থনীতির সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

ধুঁকতে থাকা মন্থর গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে গ্রামীণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়াতে হবে। আর তা করতে সর্বাগ্রে দরকার ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি। বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ এ’কথাই বারংবার বলে আসছেন।

- অতনু চক্রবর্তী

খণ্ড-31
সংখ্যা-12