আমরা কাগজ দেখাব না
we-will-not-show-the-paper

সুপ্রিম কোর্টের ধমকে ও তার নির্দেশ অনুযায়ী ৩০ ঘণ্টার মধ্যেই নির্বাচনী বন্ড নিয়ে যাবতীয় তথ্য স্টেট ব্যাঙ্ক জমা দিল নির্বাচন কমিশনের কাছে। কিন্তু, কোন কোন কর্পোরেট কোন রাজনৈতিক দলকে কত টাকা অর্থ সাহায্য করেছে, সেই তথ্য স্টেট ব্যাঙ্ক নির্বাচন কমিশনের কাছে সরাসরি জমা করেনি। যেটুকু তথ্য উঠে এসেছে তাতে জানা যায়, স্টেট ব্যাঙ্ক একেবারেই ‘র’ ডেটা (কাঁচা তথ্য) মোদীর একান্ত আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশনের কাছে জমা দিয়েছে যা ঠিক ঠাক সাজিয়ে গুছিয়ে ওয়েবসাইটে তোলার কাজটা বেশ কঠিনই হবে। নাগরিকদের যে সমস্ত তথ্য জানার অধিকারের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকার প্রশ্ন চিহ্ন তুলেছিল, শীর্ষ আদালত সেই আপত্তি উড়িয়ে তথ্য জানার অধিকারকে সংবিধানের মৌলিক অধিকার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করলেও দিনের শেষে সেই সমস্ত তথ্য কতটা প্রকাশিত হবে দেশবাসীর কাছে, তা এখনও অনিশ্চিত। সিবিআই-ইডি-সিএজি-নির্বাচন কমিশনের পর ভারতের বৃহত্তম রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক স্টেট ব্যাঙ্কও মোদী সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে উঠল।

আর, এখান থেকে দেশবাসীর দৃষ্টি ঘোরাতে এবার মোদী সরকার নিয়ে এল সেই বিতর্কিত বিভাজন সৃষ্টিকারী ২০১৯-এর নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ)-এর গেজেট বিজ্ঞপ্তি, ঠিক পবিত্র রমজান শুরু হওয়ার দিনে। দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় এসেই সিএএ পাশ করায় মোদী সরকার। আগে বলা হয়েছিল বাংলাদেশ-পাকিস্তান-আফগানিস্তানের মতো দেশ থেকে সে দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা (হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, পার্সি ও খ্রিস্টান) ধর্মীয় উৎপীড়নের কারণে যদি ২০১৫ সালের আগে এ দেশে আশ্রয় নিয়ে থাকেন সে ক্ষেত্রে নাগরিকত্ব দেবে ভারত। তখন মোদী সরকারের দাবি ছিল, ভারতে আসার তারিখ জানালেই নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। কিন্তু এই যে নতুন গেজেট বিজ্ঞপ্তি বেরোলো, তাতে জানানো হয়েছে নাগরিকত্বের জন্য একাধিক নথি অনলাইনে জমা দেওয়াটা বাধ্যতামূলক। আবেদনকারীকে ছবি, দাবির পক্ষে প্রয়োজনীয় কাগজ ও একাধিক হলফনামা দিতে হবে। আবেদনকারী ও তাঁর পরিবার সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য ফর্মে দিতে হবে। আর, আইন এটাও জানিয়েছে, আবেদনকারী নিজের, পরিবার সম্পর্কে সঠিক তথ্য জমা দিয়েছেন কি না তারও আলাদা এক হলফনামা জমা দিতে হবে। এছাড়া দিতে হবে ওই ব্যক্তির চরিত্র সম্পর্কে স্থানীয় কোনো ভারতীয় নাগরিকের হলফনামা। অনেক কমিটির হাত ঘুরে, যাচাই-নজরদারির বিস্তর পথ বেয়ে আমলাতন্ত্রের মর্জি জয় করার পর হয়তো বা নাগরিকত্বের শিকে ছিঁড়তে পারে।

নির্বাচনের ঠিক আগে মেরুকরণ ঘটানোর ফন্দি নিয়ে আনা হল নতুন এই বিজ্ঞপ্তি। মুহূর্তের মধ্যে এর বিরুদ্ধে দেশব্যাপী বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। আসামে ১৬টি বিরোধী দলের ঐক্যবদ্ধ মঞ্চ হরতাল ডাকল। আর, নজিরবিহীনভাবে এই হরতালের বিরুদ্ধে আসাম পুলিশ বিরোধীদের হুমকি দিল, জারি করল ‘আইনানুগ’ ব্যবস্থা নেওয়ার ফরমান। পবিত্র রমজান শুরু হওয়ার শেষ শুক্রবার দিল্লির বুকে নামাজিদের উপর দিল্লি পুলিশের আক্রমণ, কর্নাটকের সাংসদ অনন্ত হেগড়ের বক্তব্য যে ৪০০ আসনে বিজেপিকে জয়ী করলে সংবিধান বদলে তারা হিন্দু রাষ্ট্র বানাবেন, আর তার অব্যবহিত পরেই সিএএ-বিজ্ঞপ্তি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, হিন্দুত্ববাদী মেরুকরণের লক্ষ্যে তা একসূত্রে বাঁধা।

ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব প্রদান ভারতের সংবিধানের উপর এক সরাসরি হামলা। এর বিরুদ্ধে সর্বস্তরের মানুষকে পথে নেমেই প্রতিরোধ করতে হবে। আরএসএস-র শতবর্ষে হিন্দু ভারতের অভিমুখে আমাদের দেশকে নিয়ে যাওয়ার যে লক্ষ্য নিয়ে মোদী সরকার এগিয়ে চলেছে দুরন্ত গতিতে তা ব্যর্থ করতেই হবে ভারতবাসীকে। ভারতের জাতীয় পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে সংখ্যালঘু মেয়েরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শাহিনবাগ তৈরি করে এই বেনাগরিক বানানোর দানবীয় আইনের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালে ‘হম কাগজ নেহি দিখায়েঙ্গে’ রণহুংকারে রাজপথ কাঁপিয়েছিলেন। আজ, আবার ফিরে আসুক সেই রণদামামা — আসমুদ্রহিমাচল!

খণ্ড-31
সংখ্যা-9