তাঁরা লড়েন জেতার লড়াই
they-fight-to-win_0

[‘উইমেনস ভয়েস’-এর পক্ষ থেকে কমরেড রাধিকা মেনন সারা ভারত প্রকল্পকর্মী ফেডারেশন (এআইএসডব্লুএফ)-এর সাধারণ সম্পাদক এবং বিহার রাজ্য আশা কর্মকর্তা সংঘের সভানেত্রী কমরেড শশী যাদবের এক সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সেখানে উঠে এসেছে আশা কর্মীদের বহু সমস্যা, তাদের কাজের বিশেষ ধরন, তাদের চাহিদার প্রকৃতি, তাদের সংগঠন গড়ে তোলার অনন্য নজির, অতিমারীর চ্যালেঞ্জ, তাঁরা আগামী লোকসভা নির্বাচন, ২০২৪-এর নির্বাচনী ইশতেহারে কী দেখতে চান – এমন বহু কথা। শশী বিহার রাজ্য বিধান পরিষদে সিপিআইএমএল লিবারেশন-এর নব নির্বাচিত প্রথম মহিলা সদস্যও বটেন। এই লড়াকু নেত্রীকে সংগ্রামী অভিনন্দন জানিয়ে আমরা সেই মূল্যবান সাক্ষাৎকারটির বঙ্গানুবাদ ‘আজকের দেশব্রতী’র পাঠকদের হাতে তুলে দিলাম। 

- সম্পাদকমণ্ডলী]

প্রকল্পকর্মীরা আজকের ভারতে কর্মী মহিলাদের সংগ্রামে প্রথম সারিতে উঠে এসেছেন। তাঁরা বিশেষ করে, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাক্ষেত্রে, কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প রূপায়িত করে চলেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন আশাকর্মী (অ্যাক্রিডিটেড সোশ্যাল হেল্থ অ্যাক্টিভিস্ট) এবং ন্যাশনাল রুরাল হেল্থ মিশন কর্মসূচির ‘মমতা’রা, আইসিডিএস কর্মসূচির আওতাভুক্ত অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা এবং মিড ডে মিল (এমডিএম) কর্মীরা। তারা ফ্রন্টলাইন কর্মী হিসাবে জনসমাজের গভীরে গিয়ে সরকারের ‘মুখ’ হয়ে কাজ করেন। প্রকল্প কর্মীদের ৯৫% এর বেশি হলেন মহিলা। তাদের বেশিরভাগই শ্রমশক্তিতে প্রথম যোগ দিয়ে গভীর মর্মবেদনায় বুঝলেন সরকার তাদর শ্রমকে ‘কাজ’ হিসেবেই স্বীকার করে না! তাদের শ্রমিকের অধিকার নেই, নেই সম্মানজনক মজুরি, নেই চাকরির সুরক্ষা! নয়া উদারবাদী রাষ্ট্র - পরিকল্পিত এবং ধারাবাহিক ভাবে মেয়েদের পরিচর্যার কাজকে, মজুরিবিহীন গার্হস্থ্য কাজ থেকে বিনামজুরির সরকারি কাজ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাচ্ছে!

প্রকল্প কর্মীরা তাই আজ বিপুল জমায়েত আর ধর্মঘটের মাধ্যমে তাদের শ্রমিকের মর্যাদা আর ন্যায্য মজুরির দাবির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য প্রতিবাদ সংগঠিত করছেন।

রাধিকা: শ্রমিকের স্বীকৃতি পাওয়ার জন্যে প্রকল্প কর্মীরা লড়েছেন। সরকার তার নিয়মিত কর্মীদের তুলনায় প্রকল্প কর্মীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করে চলেছে। সারা ভারত প্রকল্প কর্মী ইউনিয়ন এবং তাদের লড়াইয়ের নেত্রী হিসেবে আপনি যদি এ ব্যাপারে আমাদের আরও কিছু বলেন?

শশী যাদব : কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালিত বিভিন্ন প্রকল্পে নিযুক্ত আছেন ১০ মিলিয়ন(১০০লক্ষ) কর্মী। স্বাস্থ্য দপ্তরে আছেন আশা ও আশা ফ্যাসিলিটেটররা (সহায়তাকারী কর্মীরা)। তারা জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের অধীনে তাদের দায়িত্ব পালন করছেন। সমস্ত আশাকর্মীই মহিলা। স্কুলে কাজ  করছেন মিড ডে মিল কর্মীরা। তাদের ৯৫%ই মহিলা। এছাড়া আছেন অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা। তারা সকলেই মহিলা। তারা শিশু ও গর্ভবতী মায়েদের খাদ্যশস্য, পুষ্টি সম্পূরক নানা খাদ্যসামগ্রী এবং প্রাথমিক পরিচর্যা দিয়ে থাকেন। তারা বিভিন্ন রাজ্য দপ্তরে কাজ করছেন। তারা কর্তব্য পরায়ণ, নিজেদের কাজের প্রতি দায়বদ্ধ, কিন্তু যে কথাটা সবক্ষেত্রেই প্রযোজ্য – সংশ্লিষ্ট রাজ্য দপ্তরগুলো এদের শ্রমিক বা কর্মচারী, কোনোটাই মনে করে না। তাই তাদের বেতন বা ন্যূনতম মজুরি – কোনোটাই দেওয়া  হয় না। তাদের জন্যে নেই কোনো সামাজিক সুরক্ষা বিধি।

এগুলো সবই কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্প – জাতীয় স্তরে পরিচালিত হয়। কিন্ত তাদের প্রাথমিক অধিকারগুলোও নেই আর মোদী সরকার এদের জন্য ব্যয়বরাদ্দও ছাঁটাই করেছে। তারা কাজটা করেন সরকারি কর্মচারীর, কিন্তু সরকারি কর্মচারীর মর্যাদা তাদের দেওয়া হয়না। কেন? কারণ তারা নাকি ‘প্রকল্পকর্মী’ হিসেবে নিযুক্ত! এটাই  হচ্ছে আধুনি যুগের ক্রীতদাস প্রথা আর নয়া উদারবাদী রাষ্ট্রের ন্যায্য মজুরি চুরির কায়দা!

গড়ে একজন আশাকর্মী পান ৩০০০-৪০০০ টাকা। তারা কোনো মজুরি বা সাম্মানিক পান না, শুধু উৎসাহ ভাতা। ধরুন, তাদের তদারকি ও পরিচর্যায় থাকা কোনো গর্ভবতীর সফল প্রসবের পর, দীর্ঘ কয়েক মাস কাজের বিনিময়ে তারা পাবেন ৬০০ টাকা। একজন আশা ফ্যাসিলিটেটর পান মাসিক ৭০০০ টাকা সাম্মানিক। একজন অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীও পান ৭০০০ টাকা। বিহারে একজন মিড ডে মিল কর্মী একমাস কাজ করে পান মাত্র ১৬৫০ টাকা। একজন মিড ডে মিল কর্মী যা পান তাতে কেন্দ্রীয় সরকার দেয় মাত্র ১০০০ টাকা। একইভাবে, আশা কর্মীদের ইন্সেনটিভ-এর ৬০% দেয় কেন্দ্রীয় সরকার, ৪০% দেয় রাজ্য সরকার, তবে বিভিন্ন রাজ্যে তার ফারাক আছে। প্রকল্প কর্মীদের, কেন্দ্র এবং রাজ্য – উভয় সরকারের বিরুদ্ধেই লড়তে হয়। বিহারে দীর্ঘ লাগাতার সংগ্রামের পর আশাকর্মীরা প্রতিশ্রুতিমত টাকা পাচ্ছেন।

রাধিকা : প্রকল্প ক্ষেত্রে নিয়োজিত শ্রমশক্তিতে নারীরাই বিপুল অংশ; তাদের যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়, দাবিগুলোতে কি তার প্রতিফলন ঘটছে? ইউনিয়ন কী ধরণের ইস্যুগুলো তুলে ধরেছে? আপনি কি এই দাবিগুলোকে ‘নারীবাদী’ মনে করেন?

শশী : এই সব প্রকল্পে মহিলারাই শ্রমশক্তির মূল যোগানদার, কিন্তু মহিলাকর্মীদের সম্পর্কে সরকারগুলোর মনোভাব ভীষণ সন্দহজনক। তারা মনে করে মেয়েদের শ্রম আর দক্ষতা ডাহা সস্তা আর ব্যবহারের পর ইচ্ছেমতো ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া যায়। এর মধ্য দিয়েই বোঝা যায় সরকারের মনোভাব কতটা পিতৃতান্ত্রিক তথা সামন্ততান্ত্রিক! তাই প্রথমে এটার মোকাবিলা করতে হয়েছে। এই মনোভাবই সরকারকে মহিলাদের, এমনকি শ্রমিকের প্রাথমিক অধিকারগুলো থেকেও বঞ্চিত করার প্ররোচনা দেয়। আমাদের ইউনিয়ন এই মনোভাবকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। শুরু থেকেই আমরা আশাকর্মীদের জন্য হাসপাতালে আলাদা বিশ্রামের ঘর, পিরিয়ড লিভ (ঋতুকালীন ছুটি)-এর ব্যবস্থা, যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানোর কমিটি, অন্যান্য অভিযোগের প্রতিকারের ব্যবস্থা ইত্যাদি ইস্যুগুলোকে তুলে ধরেছি। এছাড়াও রয়েছে কর্মরত অবস্থায় কর্মীদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার প্রয়োজনের বিষয়টি।

মহিলাদের কেন শুধু সাম্মানিক দেওয়া হবে, কেন বেতন নয়? প্রকল্প কর্মীরা সরকারের জন্যে কাজ করেন কিন্তু তাদের এত কম পয়সা দেওয়া হয় যে তাদের পরিশ্রমকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনা হয় না। এটা তাদের সময় ও মজুরি চুরি করা। সরকার তাদের দেশের জন্যে স্বার্থ ত্যাগ করতে বলছে, কিন্তু কেন সবসময় শুধু মহিলাদের, বিশেষ করে গরিব মহিলাদের স্বার্থত্যাগ করতে বলা হয়? প্রকল্প কর্মীদের ফেডারেশন এবং আমাদের ইউনিয়নগুলো এই প্রশ্নে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। আমাদের বেতন আর সরকারি কর্মচারীর স্বীকৃতির দাবি এই বোঝাপড়ার ওপর দাঁড়িয়ে আছে যে মহিলাদের কাজকে ন্যায্য মজুরিসহ স্বীকৃতি দিতে হবে। লিঙ্গ সাম্যের জন্য এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সরকারের উচিত সাম্মানিকের নামে নামমাত্র পারিশ্রমিক দিয়ে মহিলাদের কাজকে খারিজ করার বদলে, (যেমনটা সমাজ করে), তাদের সম নজরে দেখে লিঙ্গ সাম্যের পথ দেখানো। এইগুলো নারীবাদী ইস্যু। স্বাধীনতা আর মুক্তির স্বার্থে, একজন প্রকল্প কর্মীর মজুরি ও শ্রম অধিকারগুলি পাওয়া উচিত। অনেক আশাকর্মীকেই তাদের ঐ সামান্য উপার্জন দিয়েই সংসার চালাতে হয়। এটা তাদের একটা বিরাট মাথাব্যথার কারণ। মহিলাদের প্রশ্নটিকে তাদের জীবনের পরিস্থিতির মধ্যে রেখে ভাবতে হবে।

রাধিকা: প্রকল্প কর্মীদের গ্রামীণ দরিদ্রমানুষের প্রাথমিক পুষ্টি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রয়োজনগুলি নিয়ে কাজ করতে হয়। লক্ষ্যণীয়ভাবে, যদিও তাদের গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের সেবা করতে হয়, তাদের নিজেদেরও তো আর্থ-সামাজিক ভাবে প্রতিবন্ধী এক পটভূমি থেকে উঠে আসতে হয়েছে। তাদর ভাতা কি সেই দারিদ্র্য থেকে তাদের রেহাই দিতে পারে?

শশী : না! প্রকল্প কর্মীদের অনেক ক্ষেত্রে নিজেদেরই নিষ্ঠুর দারিদ্র্যের মধ্যে কাটাতে হচ্ছে। তাদের ভাতা এই বিপুল মুদ্রাস্ফীতির বাজারে কিছুই না। মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে তাদের মজুরি বাড়ে না। বেশ কয়েক বছর ধরে, তাদের ভাতা বা সাম্মানিকের কোনও বৃদ্ধি ঘটেনি।


they-fight-to-win_1

রাধিকা: মহিলারা কীভাবে তাদের কাজ আর প্রকল্পে তাদের ভূমিকাকে উপলব্ধি করেন?

শশী : এরা অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রমী মহিলা, নিজেদের দায়িত্ব ও সমাজের প্রতি ভীষণ আন্তরিক। সম্প্রতি আশাকর্মীরা ফাইলেরিয়ার বিরুদ্ধে প্রচার অভিযানে গেলে, মানুষজন তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে, কারণ বাচ্চাদের বয়স এবং উচ্চতা অনুযায়ী ওষুধের মাত্রা নির্দিষ্ট করতে না পারলে কখনও কখনও ওরা অসুস্থ হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের তাদের সঙ্গে থাকার কথা। কিন্তু অনেক সময়েই ডাক্তাররা যান না, আশাকর্মীদের ওপরই কাজটা ছেড়ে দেন। গালাগাল সত্ত্বেও আশাকর্মীরা দমেন না, কারণ এটা সারা বছরে মাত্র একবারের কর্মসূচি আর ওষুধের ডোজ কোনভাবেই বাদ দেওয়া যাবে না! প্রসবের ব্যাপারগুলোতে দিনে রাতে যে কোন মুহূর্তে ছোটার জন্যে তারা তৈরি থাকে। এরা গরিব মহিলা, প্রসবের সময়টা যদি না যেতে পারে তো তাদের ন’মাসের পুরো কাজটাই বরবাদ হয়ে যাবে। যে মানুষগুলোর তারা সেবা করে, তাদের সঙ্গে আবেগের বন্ধনেও জড়িয়ে থাকেন তারা। আশাকর্মীদের ছাড়া ডাক্তার রোগীকে না-ও দেখতে পারেন, তাই তারা রোগীর সঙ্গে ছোটেন যাতে স্বাস্থ্যের অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত না হতে হয়। এমনকি কোভিড-এর সময়ে তারা যদি নিভৃত বাস, ভ্যাকসিনেশন, ওষুধ বিতরণ – এই প্রত্যেকটি ব্যাপারে সঙ্গে না থাকতেন – আমাদের মতো দেশে অতিমারিকে সামলানো অসম্ভব হত। অনেক আশাকর্মীর বাড়ি বলতে একটাই ঘর। তাই ফিল্ড থেকে ঘরে ফিরে তাদের সারা রাত ঘরের বাইরেই কাটাতে হয়েছে যাতে বাচ্চাদের মধ্যে সংক্রমণ না ছড়ায়।

এই সব কিছুর জন্য চাই একাগ্রতা, নিষ্ঠা, আত্মোৎসর্গের মানসিকতা। প্রত্যেক পেশার মতো এক্ষেত্রেও কিছু কর্মীর মধ্যে দায়িত্বজ্ঞানহীনতা আছে, কিন্তু সেটা খুবই কম।

রাধিকা : প্রকল্পকর্মীরা কাজের সময় পেশাগত চ্যালেঞ্জ, নিরাপত্তাহীনতা বা যৌন হেনস্থার অভিযোগ করেছেন কখনও? এ সবের প্রতিকারের জন্যে কী ব্যবস্থা আছে?

শশী : অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের সেন্টারে যেতে হয়। সেখানে তাদের হেনস্থা ও অসম্মানের ঘটনা ঘটেছে। মিড ডে মিলের কর্মীদের উপরতলার বেশ কয়েক জনের তদারকিতে কাজ করতে হয়, কিন্তু অভিযোগ জানানোর কোনো ফোরাম নেই। আশাকর্মীদের কাজের কোনো বাঁধাধরা সময় নেই। এমন অনেক ঘটনাই আছে, যখন রাত দুপুরে কোনো পরিবারের ডাক পেয়ে যেতে হয়েছে এবং আক্রান্ত হতে হয়েছে। একটি ধর্ষণের ঘটনা আছে, যে ক্ষেত্রে কাজের নাম করে রাতে আশাকর্মীকে ডেকে নেওয়া হয়েছিল। এ সব ক্ষেত্রে প্রতিকারের কোন যথাযথ ব্যবস্থা নেই।

বিহারে আমরা বিশাখা গাইডলাইনের রূপায়ণ দাবি করেছিলাম। আমাদের দাবিতে স্বাস্থ্য দপ্তর এই মর্মে একটা বিজ্ঞপ্তি জারি করতে বাধ্য হয়েছিল যে হেনস্থার কোনো ঘটনা ঘটলে আশাকর্মীরা প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ইন-চার্জের (দায়িত্বশীলের) কাছে জানাবেন যিনি এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন। ইন-চার্জ নিজেই হেনস্থা করলে, অভিযোগ যাবে জেলা শাসকের কাছে। একমাত্র ইউনিয়ন থাকলে তবেই এ সব কার্যকর হতে পারে।

পেশাগত অন্যান্য সমস্যাও আছে। আশাকর্মীদের কোনো নির্দিষ্ট কাজের জায়গা বা সেন্টার নেই। তাদের কাজ ফীল্ড-ভিত্তিক। যখন তারা হাসপাতালে পেশেন্ট নিয়ে যান, তাদের রাতে সেখানে থাকতে হয়, বারান্দায় ঘুমাতে হয়। কোন শৌচাগার নেই – স্টাফ নার্সরা তাদের রেস্টরুম ব্যবহার করতে দেন না। আমরা বিহারে এ প্রশ্নে লড়েছি এবং শেষবারের ধর্মঘটের পর সরকার আশ্বাস দিয়েছে যে আশাকর্মীদের জন্যেও হাসপাতালে রেস্টরুম থাকবে, সেখানে মশারিসহ বিছানা থাকবে। প্রায় ১৫০-১৯০টা প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে আমরা এটা করাতে পেরেছি। যে সব স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ইউনিয়ন আছে, একমাত্র সেগুলোতেই এটা নিশ্চিত করা গেছে।

রাধিকা : প্রকল্প কর্মীদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে কী কী চ্যালেঞ্জ এবং সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল? এই কাজটা একেবারেই অসংগঠিত চরিত্রের এবং ভৌগোলিকভাবেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাদের ইউনিয়নে সংগঠনবদ্ধ করা এবং প্রাথমিক দাবিগুলো তুলে আনার ক্ষেত্রে কী পদ্ধতি নেওয়া হয়েছিল, সে বিষয়ে যদি সবিস্তারে একটু বলেন?

শশী : প্রকল্পকর্মীরা বিভিন্ন সময়ে নিযুক্ত হয়েছেন। তাদের কাজও আলাদা আলাদা জনগোষ্ঠীর (কম্যুনিটির) মধ্যে। তারা যেহেতু বিক্ষিপ্তভাবে নথিভুক্ত হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে কোনো গোষ্ঠী বা যৌথ চেতনা ছিল না। তারা তাদের অধিকার সম্পর্কেও সচেতন ছিলেন না। নিয়মিত জমায়েত করতে হয়েছে, বার বার বুঝিয়ে উৎসাহিত করতে হয়েছে, তারপর তারা ইউনিয়নের ক্ষমতাকে মানতে পেরেছেন। তার আগে নয়! আশাকর্মীদের কাছে পৌঁছাতে প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোই হয়ে উঠেছিল কেন্দ্র বিন্দু (ফোকাল পয়েন্ট)। ওপর থেকে আমরা যে উদ্যোগ নিয়েছিলাম, সেটাই ইউনিয়ন গঠনে সহায়ক হয়েছিল। লাগাতার প্রচার চালিয়ে কর্মীদের উৎসাহিত করে তোলা হয়েছিল। আশাকর্মীদের ধর্মঘটগুলো হয়ে উঠেছে প্রকল্পকর্মী সংগঠনের সমাবেশ স্থল। ধর্মঘটের সাফল্য এবং প্রচারাভিযানগুলি আমাদের ইউনিয়নকে বড় করে তুলেছে, আর এখন সেটা হয়ে উঠেছে বিহারে প্রকল্পকর্মীদের বৃহত্তম সংগঠন। আমরা ১৩টি জেলা এবং ১০০টি প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে আমাদের সংগঠন শুরু করেছিলাম।

আমরা আশাকর্মীদের মর্যাদার জন্য লড়াই দিয়ে শুরু করেছিলাম। আগে ডাক্তার, ম্যানেজার এবং সরকারি কর্মচারীরা সংগঠনে বাধা দেওয়ার জন্য তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতেন, হুমকি দিতেন। লাগাতার সংগ্রামের মধ্য দিয়েই আশা আন্দোলনকর্মীরা ক্রমশ আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন। সাংগঠনিক কাজে দক্ষতাও বেড়েছে। আমাদের অভিজ্ঞতা দেখিয়ে দিয়েছে যে নেতৃত্বের ধারাবাহিক, দৃঢ়, গণতান্ত্রিক ও স্বচ্ছ ভূমিকা আমাদের সংগঠনের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। নেত্রীরা সবসময়েই কর্মীদের পাশে আছেন।

রাধিকা : কোভিড-এর সময় প্রকল্প কর্মীরা বিশেষ করে আশাদিদিরা একটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করেছেন, সামাল দিয়েছেন। তাঁদের সেই কাজের গুরুত্ব কি যথাযথ স্বীকৃতি পেয়েছে?

শশী : অতিমারীর সময় প্রকল্প কর্মীরা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। নিজেদের জীবনের বিরাট ঝুঁকি নিয়েও তারা প্রত্যেকের জন্য নিরাপদ স্থান ও প্রয়োজনীয় সহায়তা সুনিশ্চিত করেছেন। কিছু কিছু জায়গায় কাজ  করতে গিয়ে তাদের আক্রান্ত হতে হয়েছে, মানুষের থেকে দুর্ব্যবহার পেতে হয়েছে। কিন্তু তার জন্য মোদী সরকারের থেকে কোনো প্রতিদান মেলেনি, শুধু অর্থহীন বাগাড়ম্বর ছাড়া আর কিছুই জোটেনি। সরকার প্রকল্পকর্মীদের কৃতিত্ব আত্মসাৎ করে নিজের সাফল্য বলে চালিয়েছে। কিন্তু কর্মীদের দীর্ঘ দিনের বকেয়া দাবিগুলো উপেক্ষিতই থেকেছে। এই হৃদয়হীনতা, এই অবজ্ঞা প্রচণ্ড ক্রোধের জন্ম দিয়েছে যার প্রকাশ ঘটেছে পর পর কয়েকটি আন্দোলনে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিবাদ হয়েছে। উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি, কর্ণাটক এবং অন্যান্য রাজ্যে বিশাল বিশাল জমায়েত হয়েছে।

খণ্ড-31
সংখ্যা-9