প্যালেস্টাইনের পাশে দুনিয়ার জনমত : নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত পাস
security-council-passed-a-ceasefire-decision

বিগত ছয় মাস ধরে প্যালেস্টাইনের গাজাপট্টিতে ইজরায়েলী বাহিনী ব্যাপক গণহত্যা ও সর্বাত্মক ধ্বংসলীলা চালানোর পর অবশেষে গত ২৫ মার্চ জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে সিদ্ধান্ত গৃহীত হল এখনই যুদ্ধবিরতি দাবি করে। ফেব্রুয়ারি মাসে আন্তর্জাতিক আদালতে ইজরায়েলের বিচার চলেছে গণহত্যার দায়ে। বিশ্বের অধিকাংশ দেশ ইজরায়েলকে যুদ্ধাপরাধী বলে সাব্যস্ত করে স্বাক্ষ্য দিয়েছে। ২৬ ফেব্রুয়ারি তার রায়ে গণহত্যা বন্ধ করে মানবিক ত্রাণের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক আদালত। কিন্তু এর আগে চার বার প্রস্তাব এনেও জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত পাস করা যায়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বারবার ভেটো দিয়ে সিদ্ধান্ত আটকে দিয়েছে। অবশেষে সোমবার এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হল নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্য দেশের মধ্যে ১৪টি দেশের ভোটে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভেটো প্রয়োগ করার অবস্থান থেকে পিছিয়ে এসে ভোটদানে বিরত থাকার অবস্থান নেয় এবার। গৃহীত সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, রমজান মাসের জন্য এখনই যুদ্ধবিরতি শুরু করতে হবে এবং তা থেকে স্থায়ি যুদ্ধবন্ধের পথে এগোতে হবে। যুদ্ধবন্দীদের মুক্তির দাবিও করা হয়েছে, কিন্তু বন্দিমুক্তিকে যুদ্ধবিরতির শর্ত হিসেবে আরোপ করা হয়নি।

জাতিসঙ্ঘের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর সংস্থায় যুদ্ধবিরতির এই সিদ্ধান্তগ্রহণে বিশ্বজুড়ে সাধারণ মানুষের ধারাবাহিক আন্দোলন সবচেয়ে জোরালো ভূমিকা রেখেছে। ইজরায়েলের যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে তো বটেই, যে দেশগুলি ইজরায়েলের এই নৃশংস মানবতা-বিরোধী অপরাধে সঙ্গ দিয়েছে সেই সেই দেশের সরকারগুলির বিরুদ্ধে সেখানকার মানুষেরা ব্যাপক সংখ্যায় লাগাতার রাস্তায় নেমে এসেছে ধিক্কার জানিয়ে। প্যালেস্টাইনের সংহতিতে কথা বলা, প্যালেস্টাইনের মানুষের জীবন ও সংগ্রামের কথা তুলে ধরা একদিনের জন্যও থামিয়ে দেয়নি বিশ্বজুড়ে সংগ্রামী জনতা।

ইজরায়েলী বাহিনী গত ছয় মাসে গাজাপট্টির নাগরিক আবাসন, সরকারি প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ, মসজিদ ও গীর্জা, এমনকি বড় বড় হাসপাতালকে নিশানা বানিয়ে লক্ষাধিক প্যালেস্তিনিকে হত্যা করেছে বা চিরতরে পঙ্গু করেছে, ২০ লক্ষের ওপর মানুষকে গৃহহীন উদ্বাস্তু বানিয়েছে, দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি তৈরি করেছে, বেছে বেছে সাংবাদিকদের হত্যা করেছে, এমনকি জাতিসঙ্ঘের পাঠানো মানবিক ত্রাণকর্মীদের ওপরও বোম মেরেছে। প্যালেস্টাইনের জমি জবরদখল করে বানানো ইজরায়েলী বসতিতে ৭ অক্টোবর ২০২৩ প্যালেস্টাইনের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল হামাসের নেতৃত্বে হওয়া সশস্ত্র হামলাকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে, হামাসকে খতম করার বাহানায় ইজরায়েলী বাহিনী গত ছয় মাস ধরে এই নৃশংস ধ্বংসলীলা চালিয়ে আসছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের সেক্রেটরি জেনেরাল ইজরায়েলের এই একপাক্ষিক যুদ্ধকে ‘জেনোসাইড’ বা একটি জনগোষ্ঠিকে খতম করে দেওয়ার অভিযান বলে বর্ণনা করেন। হামাসের হামলাকে নিন্দা জানিয়েও তিনি বলেছিলেন যে এই হামলার এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আছে, “শূন্যের ওপর ঘটেনি”।

ইজরায়েল কি নিরাপত্তা পরিষদের দাবি মেনে যুদ্ধ বন্ধ করবে? প্যালেস্টাইনে ইজরায়েলের জবরদখল ও হামলার বিপক্ষে অন্তত পঞ্চাশবার জাতিসঙ্ঘে সিদ্ধান্ত পাস হয়েছে, কিন্তু কোনোদিনই ইজরায়েল সেসব মানেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার সবসময় ইজরায়েলের অপরাধকে মদত জুগিয়েছে। যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত এবারের সিদ্ধান্তগ্রহণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেন ভেটো দিয়ে আটকায়নি সে বিষয়ে ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু মার্কিন প্রশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের দপ্তর থেকে এবারও বলা হচ্ছে যে এই সিদ্ধান্ত মানার কোনও বাধ্যবাধকতা ইজরায়েলের নেই এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার নীতিতে কোনও পরিবর্তন আনছে না, ইজরায়েলকে মিসাইল ড্রোন বোমা সহ সমস্ত রকম অস্ত্র সহযোগিতা চালিয়ে যাবে ইউএসএ। ইউএসএ’র জনতা নিশ্চয় বাইডেন সরকারের এই যুদ্ধাপরাধের জবাব চাইবে।

মোদী সরকারের অধীনে ভারত উপনিবেশ-বিরোধী লড়াইয়ের উত্তরাধিকারকে সম্পূর্ণ পদদলিত করে, প্যালেস্টাইনের পাশে দাঁড়ানোর এতদিনকার নীতি উল্টে দিয়ে, ইজরায়েল-ইউএসএ’র দোসর হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে যায়। বেকারত্ব ও মূল্যবৃদ্ধিতে জর্জরিত যুবকদের ইজরায়েল পাঠায় মজুরের কাজ করতে, যাদের মধ্যে কারো কারো নিহত হওয়ার খবরও ইতিমধ্যে সামনে এসেছে। এদেশে বিজেপি-আরএসএসের হিন্দুত্ববাদ আসলে ইজরায়েলের নৃশংস ইহুদিবাদকেই মডেল করেছে। এই মডেলে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম সম্প্রদায়কে কোনঠাসা করার জন্য নিপীড়ন চলে, দেশের মানুষের ওপর গোপনে নজরদারি চলে, নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য ইচ্ছেমত ব্যবহার করা হয়, বিচার ব্যবস্থাকে কুক্ষিগত করতে চাওয়া হয়, বিরোধীদের স্তব্ধ করে দেওয়ার অপচেষ্টা চলে, কৃষকদের ন্যায্য দাবির আন্দোলনকে ড্রোন উড়িয়ে দমন করতে দেখা যায়। সাধারণ মানুষের জীবন সবদিক থেকে বিপর্যস্ত মোদী জমানায়। লোকসভা ভোটে ভারতের শান্তিকামী মানুষ নিশ্চয় এর যোগ্য জবাব দেবে। প্যালেস্টাইনের মানুষের সংগ্রামের পাশে ভারতের মানুষ থাকবে।

- মলয় তেওয়ারি

খণ্ড-31
সংখ্যা-11