এসবিআই ইলেক্টোরাল বন্ড নিয়ে যেসর তথ্য পেশ করেছে, তা অসম্পূর্ণ হলেও, অধুনা বাতিল অসাংবিধানিক প্রকল্পটিকে ঘিরে এক বিরাট সন্দেহজনক বাতাবরণকে ইতিমধ্যেই উন্মোচিত করেছে। সেখানে বেশ কিছু বেনিয়ম আর ফাঁকফোকর রয়েছে, বিশেষ করে ‘ইউনিক’ বন্ড নাম্বারগুলোর ব্যাপারটা — যা এসবিআই প্রকাশ করেনি। যে কারণে এখনও নির্দিষ্ট দাতা-গ্রহীতা সংযোগ নির্ণয় করা যায়নি। অবশ্য একবার যদি এসবিআই-কে ঐ চেপে রাখা ও ‘হারিয়ে ফেলা’ তথ্যগুলো বিশদে প্রকাশ করতে বাধ্য করা যায়, ঐ যোগসূত্রগুলো সম্পর্কে জানা যাবে। কিন্তু যে নমুনাটুকু প্রকাশ্যে এসেছে, তাতেই বলা যায়, নির্বাচনী বন্ড প্রকল্প মোদী সরকারের সবচেয়ে বেপরোয়া, নির্লজ্জতম এক দুর্নীতি। স্কিমের মধ্যেই তৈরি করা হয়েছে নামহীনতা ও গোপনীয়তার সুযোগ। আর তাকে কাজে লাগিয়ে সরকার যথার্থই এটিকে জুলুম চালানোর এক অবৈধ চক্র হিসেবে ব্যবহার করে বিভিন্ন কোম্পানিকে ভয় দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়েছে। আর প্রতিদানে দাতারাও আইনি সুরক্ষাসহ নানা লোভনীয় প্রকল্প আর কনট্রাক্ট হাতে পেয়ে গেছে।
এই মুহূর্তে, বন্ড ক্রেতাদের তালিকায় তিনটি বড় কর্পোরেট সংস্থার সরাসরি উপস্থিতি চোখে পড়বে না। অনুসন্ধানকারী সাংবাদিকরা বন্ডগুলোকে ট্র্যাক করে অবশ্য ৪০০ কোটি টাকার বেশি মূল্যের বন্ডে আম্বানিদের উপস্থিতি ধরে ফেলেছেন। টাটারা রাজনৈতিক চাঁদা দেওয়ার ক্ষেত্রে সম্ভবত নিজেদের ট্রাস্টের (প্রোগ্রেসিভ ইলেক্টোরাল ট্রাস্ট) মাধ্যমই পছন্দ করে। আর আদানির সংযোগ সম্ভবত শেল কোম্পানি ও অন্ধকারাচ্ছন্ন দাতাদের স্তরের নিচে লুকিয়ে আছে। অন্য শীর্ষস্থানীয় কর্পোরেট সংস্থাগুলো অবশ্য তালিকায় খানিকটা স্পষ্টভাবেই বিদ্যমান। শীর্ষস্থানীয় দাতারা অবশ্য নিজেরাই উন্মোচিত, ভারতের ক্রমবর্ধমানভাবে অসৎ আর বেপরোয়া হয়ে ওঠা স্যাঙাৎ পুঁজির নিচের দিকে তাদের অবস্থান। ইলেক্টোরাল বন্ড কিনতে কোম্পানিগুলো যে টাকা খরচ করেছে তা করমুক্ত, কিন্তু আসল সুবিধেটা রয়েছে, অবৈধ লেনদেনের বোঝাপড়ার (কুইড প্রো কো — “এটার জন্যে ওটা” অর্থাৎ একটার বিনিময়ে আরেকটা) মধ্যে, কেনা বন্ড এবং পাওয়া কনট্রাক্ট-এর পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে, যে লেনদেনে আইনকে বুড়ো আঙুল দেখানো হয়েছে এবং সমস্ত অর্থনৈতিক অপরাধের জন্যে শাস্তিকেও এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
২০১৭-২০২২ আর্থিক বর্ষে রাজনৈতিক দলগুলোর দাখিল করা আয়কর রিটার্ন এবং নির্বাচনী বন্ডের নগদ রূপান্তর সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনের প্রকাশিত সর্বশেষ পর্যায়ের তথ্য (যা ২০২৩ আর্থিক বর্ষের আয়কর রিটার্নে প্রতিফলিত হবে) মিলিয়ে দেখলে পরিষ্কার বোঝা যাবে রাজনৈতিক দলগুলির নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে মোট কত আয় হয়েছে। এই সামগ্রিক ছবির ভিত্তিতে, বিজেপি মোট ১৬,৫৯২ কোটি টাকার অর্থ মূল্যের ৫০ শতাংশেরও বেশি, ৮২৫২ কোটি টাকার বন্ড থলিতে পুরেছে। মোট ১৯৫২ কোটি টাকার বন্ড পেয়ে দ্বিতীয় হলেও অনেক পিছনে আছে কংগ্রেস। আর ১৭০৫ কোটি টাকার বন্ড পেয়ে তৃতীয়স্থানে আছে তৃণমূল-কংগ্রেসের সামান্য পিছনে। বিআরএস ১৪০৮ কোটি এবং বিজেডি ১০২০ কোটি টাকার বন্ড পেয়ে যথাকারমে চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে আছে।
অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুর্নীতিকে বৈধতা দিতেই বিজেপি একটা অসাংবিধানিক প্রকল্পকে চাপিয়ে দিয়েছে — সুপ্রিম কোর্টের এই অভিযোগের উত্তর দেওয়ার পরিবর্তে বিজেপি এখন এই নির্বাচনী বন্ড কেলেঙ্কারিকে উড়িয়ে দিতে ব্যস্ত। তার দাবি আসলে বিরোধী দলগুলোর থেকে সে নাকি অনেক কম টাকা পেয়েছে! তার আরও যুক্তি, দলটি যে টাকা পেয়েছে তা আসলে তার নির্বাচনী শক্তির অনুপাতেও কম। বিজেপি’র আইটি সেল মানুষকে ভুল বোঝানোর জন্যে সরাসরি মিথ্যা পরিসংখ্যান প্রচার করছে। আসলে যেটা বুঝতে হবে — নির্বাচনী বন্ড স্কিম কর্পোরেট সংস্থাগুলোর বড় পার্টিগুলোকে টাকা দেওয়ার প্রচলিত ব্যবস্থার বিষয়টাকে মাত্রাগত ও তহবিলের প্রকৃতিগত (বিদেশি অর্থাগম থেকে শুরু করে শেল কোম্পানিগুলির মাধ্যমে বেআইনি টাকা পাচার পর্যন্ত সমস্ত অস্বচ্ছ সূত্র সহ) — উভয় প্রশ্নেই এক সম্পূর্ণ নতুন স্তরে নিয়ে গেছে আর সেই সঙ্গে ন্যায়সঙ্গত পরিস্থিতির ধারণাটিকেও (যেখানে সবার সমান সুযোগ থাকবে) সম্পূর্ণ ধ্বংস করেছে।
নির্বাচনী বন্ড স্কিমের অসাংবিধানিকতা এটির চরম অস্বচ্ছতা ও অসামঞ্জস্যের মধ্যেই নিহিত আছে। যা clientelism’কে প্রতিষ্ঠানিক করে তুলেছে আর দুর্নীতিকে আগলমুক্ত করেছে। স্যান্টিয়াগো মার্টিনের ফিউচার গেমিং অ্যান্ড হোটেল সার্ভিসেস কোম্পানিতে ধারাবাহিক ইডি হানা এমনকি সম্পত্তির আটকের পরপরই সেটির ধারাবাহিক ভাবে নির্বাচনী বন্ড কেনা প্রমাণ করে দেয় এই স্কিমের সম্পূর্ণ সন্দেহজনক প্রকৃতির (মার্কি নেচার)। এসবিআই-এর তথ্য দেখাচ্ছে, সামান্য আদায়কৃত মূলধন ও লাভ সম্পন্ন কোম্পানিগুলো তাদের জ্ঞাত আর্থিক শক্তির বেশ কয়েক গুণ বেশি টাকা দিয়ে নির্বাচনী বন্ড কিনেছে। আর সরকার যখন জানে কোন কোম্পানির কোন দলকে কত টাকা দিচ্ছে, আম জনতা এবং বিরোধীদলগুলো তহবিলের প্রবাহ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রয়েছে। তথ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং ইডি, সিবিআই এবং কর-কর্তৃপক্ষ থেকে এমনকি ব্যাংক ব্যবস্থা পর্যন্ত, বিভিন্ন এজেন্সির অপব্যবহার — স্কিমটিকে সম্পূর্ণ ভাবে বিজেপি’র অনুকূলে চালিত করেছে, যদিও কয়েকটি বড় রাজ্যে ক্ষমতাসীন (যেমন টিএমসি, বিআরএস, বিজেডি, ডিএমকে, ওয়াইএসআরসিপি) দলগুলোরও বেশ বড়সড় অংশ রয়েছ। কর্পোরেট তহবিল এবং নির্বাচনী বন্ডের কাদা থেকে মুক্ত একমাত্র কম্যুনিস্ট এবং অন্যান্য বাম দলগুলো।
নির্বাচনী বন্ড, কর্পোরেট রাজনৈতিক তহবিলের অনেক উৎসের মধ্যে মাত্র একটি। এই সন্দেহজনক স্কিমটি চালু করার আগে নির্বাচনী ট্রাস্ট ছিল বৈধ চাঁদা দেওয়ার মুখ্য মাধ্যম (নির্বাচনে কী পরিমাণ অবৈধ অর্থের যোগান এবং ব্যবহার হয় সকলেরই জানা)। বেশ কয়েক বছর ধরে এই ট্রাস্টও বিজেপি’র দিকেই ক্রমশ ঝুঁকেছে। সবচেয়ে বিত্তশালী নির্বাচনী ট্রাস্ট প্রুডেন্ট ইলেকটোরাল ট্রাস্ট ২০১৭’র আর্থিক বছরে তার চাঁদার ৯৫ শতাংশই বিজেপিকে দিয়েছিল। সেই থেকে তার তহবিলের ৮৫ শতাংশই বিজেপির ঝোলায় পড়ে। ২০২৩’এর আর্থিক বছরে পাঁচটি ট্রাস্ট মিলে রাজনৈতিক দলগুলোকে মোট ৩৬৬ কোটি টাকা চাঁদা দিয়েছে যার মধ্যে বিজেপি একাই পেয়েছে ২৫৯•০৮ কোটি টাকা। ২০১৯’এর নির্বাচনের আগে, ২০১৮’র আর্থিক বছরে টাটারা তাদের প্রোগ্রেসিভ ইলেকটোরাল ট্রাস্টের মাধ্যমে বিজেপিকে দিয়েছিল ৩৫৬ কোটি টাকা আর কংগ্রেস পেয়েছিল মাত্র ৫৫ কোটি টাকা। এইসব রাজনৈতিক চাঁদা ছাড়াও, বিজেপি’র আয়ত্তে আছে সরকারি বিজ্ঞাপনের ক্রমবর্ধমান বাজেট এবং বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প যার সবগুলোই মোদী ব্র্যান্ড বেচাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। সরকারি বিজ্ঞাপন আর বিজেপি’র নিজস্ব দলীয় প্রচারের মধ্যে কোন ফারাক নেই। আর এসব এখন শুধু খবরের কাগজ, রেডিও ও দূরদর্শনের চ্যানেলে আটকে নেই, প্রতিটি জনপরিসর এবং প্রতিটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম প্লাবিত করে ফেলছে। এর পর আছে কোভিড অতিমারীর মুখে চালু হওয়া অতিকায় এক অস্বচ্ছ তহবিল যার সংক্ষিপ্ত নাম পিএম কেয়ারস। এই তহবিল তৈরি হয়েছিল রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি এবং বেসরকারি কর্পোরেশনগুলোর মোটা চাঁদা থেকে। শুধু তাই নয়, এই তহবিল নিজেকে গণ পরিসরের কোনো সমীক্ষা বা অনুসন্ধানের আওতাবহির্ভূত বলে মনে করে, কারণ এটা নাকি ব্যক্তিগত ব্যাপার!
মোদী জমানা সমস্ত সম্ভাব্য ভ্রষ্টাচার, অসাংবিধানিক এবং অনৈতিক উপায়কে ব্যবহার করে বিজেপি’র ধনাগার উপচে পড়ছে। লুট আর মিথ্যা, ঘৃণা আর সন্ত্রাসের এই দুর্নীতিগ্রস্ত অত্যাচারী শাসনকে শেষ করার জন্য ভারতীয় জনগণকে ভোটের সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে এই রাজত্বের কফিনে শেষ পেরেকটা পুঁতে দিতে হবে!
(এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ১৯ মার্চ ২০২৪)