খবরা-খবর
লাদাখবাসীর সংহতিতে প্রতীকী অনশন ও মানববন্ধন
solidarity-of-ladakh-people

সুধী,

প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ পরিবেশকর্মী বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কার বিজেতা লাদাখ নিবাসী সোনাম ওয়াংচুক সহ আপামর লাদাখবাসী একটি আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। গত ছয়ই মার্চ থেকে লে শহরে খোলা আকাশের নিচে তারা অনশন সত্যাগ্রহ করছেন। ইতিমধ্যে লাদাখ জুড়ে হাজার হাজার মানুষ তাদের সমর্থনে পথে নেমেছেন।

কেন এই আন্দোলন? প্রাকৃতিক কারণে লাদাখ অঞ্চল একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল বাস্তুতান্ত্রিক ভূখণ্ড। অতি কম বৃষ্টিপাত, চাষযোগ্য উর্বর জমিও সীমিত। তবু সেই প্রাচীন কাল থেকে লাদাখবাসী আনন্দের সঙ্গে জীবন জীবিকা নির্বাহ করতে সক্ষম হয়েছেন। আত্মনির্ভরতা ও স্বয়ংসম্পূর্ণতা তাদের আনন্দের চাবিকাঠি।

২০১৯ সালে বর্তমান কেন্দ্র সরকার জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য ভেঙে লাদাখকে একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করেন। লাদাখবাসী সাদরে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এই আশায় এইবার তারা সায়ত্ত্ব শাসন পাবেন ও নিজস্ব বিধানসভা গড়ে জীব-জড়ের মঙ্গল সাধন করবেন। ২০১৯ সালের বিজেপি দলের নির্বাচনী ইশতেহারের প্রথম সারিতে তার উল্লেখ ছিল। সেখানে লাদাখকে ষষ্ঠ তপশিল তালিকা ভুক্ত করার আশ্বাস দেওয়া হয়। এরপর লাদাখবাসীর প্রতিনিধিদের সঙ্গে কেন্দ্র সরকারের নিয়মিত কথা চলে। কিন্ত শেষ পর্যন্ত ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মাননীয় অমিত শাহ জানান তারা এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না। তাই বাধ্য হয়ে এই আন্দোলনের ডাক।

ষষ্ঠ তালিকা ভুক্ত হওয়ার অর্থ কি? ভারতের সংবিধানের ২৪৪ ধারা অনুসারে ভারতের জনজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলের মানুষের জল, জঙ্গল, জমি ও সংস্কৃতি বজায় রাখার উদ্দেশ্যে এ এক বিশেষ সাংবিধানিক অধিকার। আর লাদাখের ৯৭% মানুষ জনজাতি তালিকা ভুক্ত। এই ধারা আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরাতে ইতিমধ্যে বলবৎ আছে। জেলা স্তরে স্বায়ত্তশাসন সুনিশ্চিত করতে এই ধারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ladakh-people

আন্দোলনের দাবি কি?

১) ভোট প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে লাদাখ বিধানসভা গঠন করা এবং লাদাখবাসীর হাতে ভূখণ্ডের মানুষসহ সহনশীল বাস্তুতন্ত্র রক্ষা করা পূর্ণ রাজ্য সরকার গঠন।

২) ষষ্ঠ তফশিলি তালিকাভুক্ত করে প্রান্তিক মানুষের জেলা স্তরে ক্ষমতায়ন।

আমরা কেন কেন লাদাখবাসীর সংহতিতে? জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সর্বত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে। বোঝা দরকার পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্র একটি বৃহৎ জালের মতন। তার কোনো একটি জায়গায় যদি ছিদ্র হয় তাহলে সেই জালের কার্যকারিতা হ্রাস পায়, তথা তা ক্রমে বিনষ্ট হয়। হিমালয়ের হিমবাহ ভারত ভারতবাসীর প্রাণ প্রবাহ জলের আঁধার। এই হিমালয়কে বাঁচিয়ে রাখা অত্যন্ত জরুরি। তাই বিজ্ঞানী ও হিমবাহ সংলগ্ন অঞ্চলে মানুষেরা বারবার দাবি তুলেছেন হিমবাহ সংরক্ষণে যথার্থ ব্যবস্থা গড়ে উঠুক। সমতল ভূমির মতন চওড়া রাস্তা, সেই রাস্তায় অসংখ্য গাড়ির যাতায়াত, উচু উঁচু ইমারত, যথেচ্ছ খনিজ উত্তোলন হিমবাহগুলির ক্ষতি ডেকে আনছে। হিমালয়ের সহজ সাধারণ সহনশীল জীবন-যাপন হিমবাহ রক্ষার সহযোগী। আমাদের বোঝা দরকার সমতলের মতন একই ধাঁচে হিমালয়ের উন্নয়ন আমাদের অর্থাৎ সমতলেরও জীবন-জীবিকার পরিপন্থী। ইতিমধ্যেই বৃষ্টিপাত ও আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনায় দেশজুড়ে কখনও অতি বৃষ্টি-বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়সহ আরো নানাবিধ প্রাকৃতিক ক্ষতিকারক ঘটনা ঘটে চলেছে। একমাত্র স্থানীয় সুষ্ঠু যথার্থ ব্যবস্থাপনা মধ্য দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা সম্ভব, আর তাই চাইছেন লাদাখবাসী। তাই নদী-পরিবেশ আন্দোলনে যুক্ত বিভিন্ন গণসংগঠন লাদাখবাসীর সংহতিতে ২৪ মার্চ ১২ ঘণ্টার প্রতীকী অনশন ও ধর্মতলার মোড়ে চারটে থেকে ছটা মানববন্ধনের ডাক দিয়েছিলেন।

in-solidarity-of-ladakh-people

লাদাখের অনশন সত্যাগ্রহ বাস্তুতন্ত্র রক্ষার লড়াই, স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম

অনশন সত্যাগ্রহ’র ২১তম দিন ২৬ মার্চ সকালে সোনাম ওয়াংচুক সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে বলেন, “আমার #জলবায়ু অনশন’এর ২১তম দিন। রাতে আমার সাথে ৩৫০ জন মানুষ শুয়ে ছিলেন মাইনাস দশ ডিগ্রি তাপমাত্রায়, দিনের বেলা ছিলেন ৫০০০ মানুষ। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে এখনও একটাও শব্দ উচ্চারিত হয়নি। সততা, দূরদৃষ্টি ও প্রজ্ঞা সম্পন্ন রাষ্ট্রনেতৃত্ব প্রয়োজন এদেশের, অদূরদর্শী চরিত্রহীন নেতা নয়...”।

বর্তমান শিল্পায়নের ফলে লাদাখের সংবেদী বাস্তুতন্ত্রে যে মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে তা তুলে ধরে তাঁর ২১ দিনের এই অনশন কর্মসূচি দেশ জুড়ে মানুষের সমর্থন পেয়েছে। কিন্তু মোদী-শাহ শাসন যে বাস্তুতন্ত্র বা জনজীবনের প্রশ্নকে তোয়াক্কা করেন না তা হিমালয়ের যোশীমঠ শহরের ধ্বস বা উত্তরকাশীর টানেল বিপর্যয় থেকে দেশবাসীর কাছে অনেকটাই স্পষ্ট।

২০১৯ সালে সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলুপ্তির মাধ্যমে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের অধিকার কেড়ে নিয়ে তিন টুকরো করা হয় এবং তখন আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল লাদাখ এক পূর্ণাঙ্গ রাজ্যে উন্নীত হবে। কিন্তু এই আশ্বাস ছিল মোদী-শাহর আরেক জুমলা হয়ে দেখা দিয়েছে। লাদাখবাসীর অধিকাংশই পাহাড়ের আদিবাসী, এবং সংবিধানের ষষ্ঠ তপশীল অনুযায়ী স্বায়ত্ত্বশাসন পাওয়ার কথা তাঁদের। ষষ্ঠ তপশীলভূক্ত হলে নিজেদের বিকাশের পথ ঠিক করার অনেক অধিকার পাবেন তাঁরা। বর্তমান সময়ের পরিবেশধ্বংসী উন্নয়নের বিরুদ্ধে খাড়া হবে শক্তিশালী প্রতিরোধ।

পূর্ব ঘোষিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ি ২১ দিন অনশন সত্যাগ্রহ চালিয়ে আন্দোলনের প্রথম অধ্যায় সমাপ্ত করলেন সোনাম ওয়াংচুকের নেতৃত্বে লাদাখবাসীরা। পরদিন, অর্থাৎ ২৭ মার্চ থেকেই শুরু হচ্ছে আন্দোলনের দ্বিতীয় অধ্যায়। এবার অনশনে থাকবেন লাদাখের মহিলারা। তাঁরা টানা ১০ দিন অনশন করবেন। তারপর যুবরা। এবং তারপর বৌদ্ধ ভিক্ষুরা গণ অনশনে বসবেন। ধারাবাহিক চলবে এই সংগ্রাম। এই সংগ্রাম কঠিন, আর লাদাখবাসীর সংগ্রামী মনোবল হিমালয়ের মতোই বিশাল, অটুট।

খণ্ড-31
সংখ্যা-11