সারা দেশ যখন নির্বাচনী নির্ঘণ্ট ঘোষণার অপেক্ষায় তখন একের পর এক বড় বড় রাজনৈতিক ঘটনা সামনে আসছে। ইলেক্টোরাল বন্ড বিক্রি ও ভাঙানোর প্রাসঙ্গিক তথ্যাবলী জমা দেওয়ার সময়সীমা বাড়ানোর এসবিআই’র আবেদন সুপ্রিম কোর্ট নাকচ করে দিয়েছে। নির্বাচন না মেটা পর্যন্ত ইলেক্টোরাল বন্ডের তথ্য গোপন রাখতে মোদি সরকার ও এসবিআই’র মরিয়া প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে এবং এখন ইলেকশন কমিশন কর্তৃক সেই তথ্য প্রকাশের অপেক্ষায় আছে দেশ।
দ্বিতীয় বড় বিষয় হল নির্বাচন কমিশনার অরুণ গোয়েলের রহস্যজনক পদত্যাগ, যিনি ২০২২-এর নভেম্বরে প্রথাবহির্ভূতভাবে নিযুক্ত হয়েছিলেন এবং যার পদের মেয়াদ ছিল ২০২৭ পর্যন্ত। নতুন আনা ‘নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন’-এর বলে এখন নতুন কমিশন গঠনের মঞ্চ প্রস্তুত। নির্বাচন কমিশন দ্বারা ইলেক্টোরাল বন্ডের তথ্য জনসমক্ষে আনার জন্য যে দিন ধার্য করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট, সেই ১৫ মার্চেই নরেন্দ্র মোদি তাঁর ইচ্ছে মাফিক ব্যক্তিদের নিয়ে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন।
১১ মার্চ সারা দেশ যখন ইলেক্টোরাল বন্ড তথ্যাবলী জমা দেওয়ার সময়সীমা বাড়ানোর এসবিআই’র আবেদন প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের অপেক্ষায় ছিল তখন মোদি সরকার নাগরিকত্ব সংশোধন আইন ২০১৯-এর দীর্ঘ প্রতীক্ষিত রুলসের বিজ্ঞপ্তি জারি করল। ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর এই আইন পাস হয়েছিল এবং তার রুলস বিবৃত করতে মোদি সরকারের লেগে গেল একান্ন মাস! বুঝতে বাকি থাকে না যে সরকার ২০২৪-এর নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে এটা তুলে রেখেছিল। নির্বাচক মণ্ডলীকে সাম্প্রদায়িক লাইনে মেরুকরণের উদ্দেশ্যে। এবং যে ইস্যুতে সরকার সম্পূর্ণ উন্মোচিত হয়ে পড়েছে তা থেকে জনগণের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতে।
লোকসভা নির্বাচনের ঠিক প্রাক্কালে হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে মনোহর লাল খট্টরকে সরিয়ে নায়ব সিং সাইনিকে বসানোর বিস্ময়কর ঘটনা এবং বিহারে লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচন একসাথে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে বিহার বিধানসভা ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য ক্রমাগত হইচই চালানো থেকে বোঝা যাচ্ছে যে আগামী দিনে আরো নতুন নতুন ষড়যন্ত্রমূলক কারসাজি সামনে আসতে পারে। এইসব মরিয়া পদক্ষেপ ও কারসাজি স্পষ্টতই দেখায় যে ৪০০ আসন জেতার লম্বাচওড়া ভাষণবাজির আড়ালে আসলে ক্রমবর্ধমান গণক্ষোভে টলোমলো মোদি সরকার ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য সবরকম অপকৌশল কাজে লাগানোর মরিয়া প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
ইলেক্টোরাল বন্ড কে কাকে দিয়েছে সেই দাতা-প্রাপক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে বিশেষজ্ঞ ও তদন্তমুখী সাংবাদিকদের হয়তো কিছুটা সময় লাগবে কিন্তু এসবিআই যে ইলেক্টোরাল বন্ডের তথ্য লুকিয়ে রাখতে সর্বৈব চেষ্টা চালালো এবং সুপ্রিম কোর্ট তার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা শুরু করার হুমকি দেওয়ার পরই যে তারা তথ্য জমা করল এই সত্যই তো বিজেপির এই সময়ের অন্যতম বিরাটাকার দুর্নীতিকে প্রকট করে দিল। ফলত, কায়েমী রাজনৈতিক স্বার্থ ও কর্পরেট স্বার্থবাহীরা যে এই তথ্য প্রকাশে ইসিআইকে এখনও বাধা দিয়ে যাচ্ছে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। মোদি-আদানি আঁতাতকে যে এমপি ও সাংবাদিকরা চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন ও উন্মোচিত করেছেন তাঁদের ওপর উৎপীড়ন চালানো থেকে শুরু করে ইলেক্টোরাল বন্ড প্রকাশের সুপ্রিম কোর্টের আদেশকে অমান্য করার প্রচেষ্টা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে মোদি সরকার বিপুল আর্থিক ও রাজনৈতিক দুর্নীতিতে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে।
সিএএ প্রশ্নে বিজেপি আরো একবার জনতাকে বিপথে চালনা করছে একে ‘নাগরিকত্ব প্রদানের আইন, কারো নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার হাতিয়ার নয়’ বলে প্রচার চালিয়ে। এর থেকে নির্জলা মিথ্যা আর কিছু হতে পারে না। চার বছর আগে সিএএ পাস করার সময় অমিত শাহ স্পষ্টভাবে বলেছিলেন যে সিএএ হল দেশজুড়ে এনআরসির পূর্বসূরী। আসামে এনআরসির অভিজ্ঞতা ইতিমধ্যেই ভাষা ও ধর্মসম্প্রদায় নির্বিশেষে গরিব ও যথেষ্ট কাগজপত্র না থাকা মানুষদের এনআরসি পরীক্ষার বিপন্নতাকে দেখিয়ে দিয়েছে। একইসাথে সিএএ হল নাগরিকত্বের এক বিদ্বেষপূর্ণ সাম্প্রদায়িককরণ যা সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ নীতির মূলে আঘাত করে। এই বিষয়টা বুঝেই সিএএ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে শাহীনবাগের সমনাগরিকত্ব আন্দোলন দেশজুড়ে ব্যাপক ভিত্তিক সমর্থন পেতে শুরু করেছিল এবং কোভিড মহামারী এসে পড়ার পর বিজেপি দিল্লিতে সাম্প্রদায়িক হিংসা সংগঠিত করে এই আন্দোলনকে দমন করতে এবং আন্দোলনের বেশ কয়েকজন অগ্রণী নেতানেত্রীকে মিথ্যা মামলা সাজিয়ে গ্রেপ্তার করতে সফল হয়।
বিজেপির মেরুকরণের প্রচেষ্টা এবং সিএএ-কে ধরে মানুষকে বিপথে চালিত করার প্রচারকে আমাদের যোগ্য জবাব দিতে হবে এবং সিএএ-এনআরসি প্যাকেজের বিপর্যয়কর পরিণতি সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করতে হবে। যে মানুষদের সিএএ’র আওতায় নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে তাঁদের তো নিজেদেরকে আগে বেআইনি অভিবাসী বলে স্বীকার করে নিতে হবে এবং নাগরিকত্বের এই প্রহেলিকাময় প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত করার সিএএ পরীক্ষায় খুব অল্প সংখ্যক মানুষই প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট জমা দিতে পারবেন। এটা আরেকটি নিষ্ঠুর মোদি জুমলা; বাধ্য হয়ে ভারতে এসেছেন এবং বহু বাধাবিঘ্ন ও দুর্দশা সহ্য করে নতুন করে আবার জীবনের আশালতা বাঁচিয়ে তুলেছেন এরকম মানুষদের আশা আকাঙ্খা ও সেন্টিমেন্টের সাথে মোদির নিষ্ঠুর খেলা। ন্যায় প্রদানের নামে সিএএ তাঁদের জীবনকে আরো ছিন্নভিন্নই করে দেবে এবং আবার এক অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার জগতে ছুঁড়ে দেবে।
ভারতের জনগণ একের পর এক মোদি জুমলাকে সাফল্যের সাথে পেরিয়ে, নোটবন্দী থেকে শুরু করে লকডাউন পর্যন্ত একের পর এক মোদি চালিত বিপর্যয় মোকাবিলা করে শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলেছে। সেই সব আন্দোলনকে, এমএসপির আইনি স্বীকৃতির জন্য কৃষকদের সংগ্রাম, পুরনো পেনশন প্রকল্প ফিরিয়ে আনতে কর্মচারিদের আন্দোলন, বেসরকারিকরণ ও অস্থায়িকরণের বিরুদ্ধে যুব আন্দোলন, শ্রমিক-স্বীকৃতি ও ন্যায্য মজুরির জন্য প্রকল্পকর্মীদের আন্দোলন, জাত জনগণনা ও সম্প্রসারিত সংরক্ষণ ব্যবস্থার দবিতে দলিত-বহুজন আন্দোলন – এই সমস্ত আন্দোলনকেই সিএএ-এনআরসির মেরুকরণের ছক প্রত্যাখ্যান করতে হবে। সংঘ ব্রিগেডের প্রতিটি ষড়যন্ত্রমূলক কারসাজিকে পরাস্ত করা এবং একেকটি ভোট হিসেবে এনে মোদি সরকারকে ছুঁড়ে ফেলার সময় এসে গেছে।
এমএল আপডেট সম্পাদকীয়
১২ - ১৮ মার্চ ২০২৪