সমনাগরিকত্ব আন্দোলন প্রসঙ্গে
regarding-the-common-citizenship-movement_0

ভারতের নাগরিকত্ব আইন বদলে ফেলে সকল ভারতবাসীর নাগরিকত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেওয়া হয় ২০০৩ সালের সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে। বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারের পাস করা ২০০৩ সালের এই নতুন আইনে তিনটি পরিবর্তন আনে বিজেপি-আরএসএস। প্রথমত, এই আইনে দেশ জুড়ে একটি নাগরিকপঞ্জি তৈরি করার কথা বলা হয়। অর্থাৎ প্রত্যেক ভারতবাসীকে নির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ দাখিল করে নিজেকে ভারতের নাগরিক হিসেবে প্রমাণ করে তালিকায় নাম তুলে নাগরিকত্বের পরিচয়পত্র নিতে হবে। এর নাম ‘ন্যাশনাল রেজিস্টার অব ইন্ডিয়ান সিটিজেনস’ আদ্যাক্ষরে এনআরআইসি, প্রচলিত ভাষায় এনআরসি।

দ্বিতীয়ত, কোনো ব্যক্তি নাগরিক হিসেবে গণ্য হবেন তখনই যখন তাঁর এদেশে জন্মানোর প্রমাণ থাকবে এবং তাঁর জন্মের সময়ে তাঁর বাবা ও মা উভয়েই যে ভারতের নাগরিক ছিলেন তার প্রমাণ থাকবে। স্বাধীন ভারতে নাগরিকত্বের আদি আইনে (১৯৫৫) জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব স্বীকৃত ছিল, উত্তরাধিকার সূত্র ছিল অপ্রয়োজনীয়।

তৃতীয় যে পরিবর্তনটি ২০০৩-এর এই আইনের মাধ্যমে আনে বিজেপি সরকার তা বিপুল সংখ্যক মানুষকে এক কথায় বেআইনি অনুপ্রবেশকারী বানিয়ে দেয়। নতুন সংজ্ঞার মাধ্যমে স্পষ্টত বলে দেওয়া হয়, অন্য দেশ থেকে এদেশে এসে পাকাপাকিভাবে যারা থেকে গেছেন তাঁরা সকলেই বেআইনি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে গণ্য হবেন এবং তাঁরা ভারতের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতেও পারবেন না।

২০০৩ সালে আনা এই ভয়ঙ্কর আইনি পরিবর্তন প্রায় নিঃশব্দেই ঘটে যায়। সবচেয়ে আশঙ্কিত ও সচকিত হয়ে পথে নামেন কেবল নমশুদ্র জনগোষ্ঠির মানুষেরা। স্বাধীনতাকালে দেশভাগের সময় থেকে শুরু করে একান্নর ভাষা আন্দোলন ও শেষে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ – ওপার বাংলা থেকে যে বিপুল সংখ্যক শরণার্থীরা এপারে এসেছেন তাঁদের মধ্যে বড় অংশ নমশুদ্র জনগোষ্ঠির। এবং পালিয়ে আসার বাস্তবতা না থাকলেও উন্নততর সুযোগসুবিধার আশায় এপারে চলে আসার গতি পরবর্তীতে কখনই সম্পূর্ণ থেমে যায়নি। এবং পশ্চিমবাংলার পূর্বদিক বরাবর জেলাগুলির কৃষি ও ব্যবসার উন্নতিতে এঁদের শ্রম ও উদ্যম বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। ২০০৩ সালে বিজেপি সরকারের আনা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনে এই মানুষেরা চরম বিপন্নতায় পড়েন। এই আইন বাতিলের দাবিতে তখন থেকেই তাঁরা নানারূপে আন্দোলন চালিয়ে আসছেন।

এনআরসি সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষ সচকিত হয়ে আলোচনা শুরু করেন আসামের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা সামনে আসার পর। আসামের এনআরসি এসেছিল সেখানকার নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ও তত্ত্বাবধানে। নাগরিকত্বের প্রমাণ হাজির করতে কোটি কোটি মানুষের চরম হয়রানি, আতঙ্ক, জমিজায়গা বেচতে বাধ্য হওয়া, বহু মানুষের আত্মহত্যা, ডিটেনশন ক্যাম্পের বিভীষিকা, জাতি ধর্মভাষা নির্বিশেষে ১৯ লক্ষ মানুষের বেনাগরিক হয়ে যাওয়া, শরণার্থীদের প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহের “উইপোকো” উক্তি – সব মিলিয়ে মানুষের কাছে দ্রুত স্পষ্ট হয়ে যায় এনআরসির ফলাফল। এনআরসির বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিরোধের মেজাজ সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়তে শুরু করায় মোদি-শাহ সামনে আনেন নাগরিকত্ব আইনের নবতর সংশোধনী।

২০১৯-এর সিএএ-কে বিজেপি তুলে ধরে ২০০৩-এর সিএএ’র ভুল শুধরানোর ভঙ্গীমার আবরণে। বাস্তবে সিএএ-২০০৩ ও সিএএ-২০১৯ একই সূত্রে বাঁধা। নমশুদ্র জনগোষ্ঠির নাগরিকত্বের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার নামে সিএএ-২০১৯-এর মাধ্যমে বিজেপি-আরএসএস ভারতের সংবিধানে হিন্দুরাষ্ট্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে। নাগরিকত্বের অধিকারে ধর্মীয় পরিচিতি বিচার স্বীকৃত হয় এই আইনে। ধর্মীয় পরিচিতিতে মুসলমান হলে ভারতে নাগরিকত্বের আবেদন জানানোর অধিকার থাকবে না। সংখ্যার জোরে সিএএ-২০১৯ পাশ করালেও সুপ্রিম কোর্টে এর বিরুদ্ধে ২০০-র অধিক আবেদন শুনানির অপেক্ষায় আছে এবং বহু আইনজ্ঞ একে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়েছেন। সংবিধানের ১৪ নং ধারায় ভারতে বসবাসকারী যে কোনও ব্যক্তিকে আইনের চোখে সমান হিসেবে দেখার নির্দেশকে উল্লঙ্ঘন, অন্যান্য সমস্ত ধরণের নিপীড়নকে বাদ দিয়ে কেবল ধর্মীয় কারণে হওয়া নিপীড়নকেই নাগরিকত্ব প্রদানের জন্য গণ্য করা, ধর্মীয় পরিচিতিগুলির মধ্যেও বিশেষ কয়েকটিকে মান্যতা দিয়ে বাকিগুলিকে বাইরে ফেলা ইত্যাদি সুস্পষ্ট কারণে সিএএ সংবিধান বিরোধী। উৎপীড়িত শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার মানবিক উদ্দেশ্যের লেশমাত্র থাকলে মোদি-বিজেপি সরকার তো বিপন্ন নিরাশ্রয় রোহিঙ্গ্যাদের আশ্রয় দেওয়ার কথা ভাবত!

সিএএ-২০১৯ -এর সাম্প্রদায়িক বিভাজনকামী উদ্দেশ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বারবার স্পষ্ট করে দিয়েছেন। ১১ মার্চ রুলস জারি করার সাথে সাথে এরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তার বিরোধিতা করে যখন বলেন যে এই আইন নতুন কিছুই দেবে না বরং এতদিন যাদের নানাই নাগরিক অধিকার ছিল সেগুলিকেই কেড়ে নেওয়ার সম্ভাবনা থাকছে, তখন অমিত শাহ মুখ্যমন্ত্রীকে হুমকি দিয়ে বলেন যে শরণার্থী ও অনুপ্রবেশকারীর মধ্যে পার্থক্য করতে হবে। স্পষ্টতই তিনি হিন্দুদের সরণার্থী ও মুসলমানদের অনুপ্রবেশকারী হিসেবে দেখার নির্দেশ দিচ্ছেন। তাঁর কথারই অনুরণন তুলে বিজেপি নেতা তথাগত রায় দাবি করেন যে নাগরিকত্বের আবেদনকারীর শিস্ন পরীক্ষাও করতে হবে।

সিএএ-২০১৯ পাকিস্তান বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে ধর্মীয় উৎপীড়নের কারণে পালিয়ে আসা হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বললেও তা লাগু করার নিয়ম বা রুলস কিছুতেই সামনে আনছিল না মোদি সরকার। বাংলার নমশুদ্র জনগোষ্ঠি এই রুলসের অপেক্ষায় ছিলেন। প্রতিটি নির্বাচনের আগেই বিজেপি তাঁদের প্রতিশ্রুতি দিত। কিন্তু রুলস আসত না। অবশেষে একান্ন মাস ধরে মোট ন’বার পিছিয়ে, ২০২৪এর সাধারণ নির্বাচন ঘোষণার পাঁচ দিন আগে, গত ১১ মার্চ সিটিজেনশিপ এমেন্ডমেন্ট রুলস বা সিএআর-২০২৪ জারি হল। এই ঘোষণায় নমশুদ্র সম্প্রদায়ের একাংশ প্রাথমিকভাবে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেও তা অতিদ্রুত থিতিয়ে যায় এবং গভীরতর ক্ষোভ ও হতাশা সামনে আসতে শুরু করে। বস্তুত সিএআর-২০২৪ অনুযায়ি নাগরিকত্বের আবেদন জানানোর অর্থ নিজেকে এবং নিজের পরিবারকে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে ঘোষণা করে এযাবৎ পাওয়া সমস্ত আইনি অধিকার খুইয়ে পুলিশ ও প্রশাসনের কাছে আত্মসমর্পন করে আবেদন মঞ্জুরির জন্য অনির্দিষ্টকাল অপেক্ষা করা।

এর সাথে সর্বদাই মাথার ওপর ঝোলানো আছে এনআরসির খাঁড়া। কিছুদিন আগে একলপ্তে বেশ কয়েক লক্ষ আধার একাউন্ট সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিয়ে মোদি-বিজেপি এক ভীতির আবহ তৈরি করেছে। অমিত শাহ ক্রনোলজি বুঝিয়েই রেখেছেন, সিএএ’র পর এনআরসি। ভোটের আগে সিএএ হল, ভোটের পরেই আসছে এনআরসি। সেখানে হিন্দু, মুসলমান, বাঙালি, সাঁওতাল সকলকেই নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে হবে চোদ্দ পুরুষের নথি জমা করে। বলাই বাহুল্য, ধর্ম জাতি ভাষা নির্বিশেষে কোটি কোটি সাধারণ মানুষ বাকি সব অধিকার ছেড়ে দিশাহারা হয়ে ছুটে বেড়াবে নিজের ও পরিবারের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে, আর আদানি-আম্বানিদের নিয়ে মোদি-শাহ মহানন্দে লুটের রাজত্ব বাড়িয়ে চলবে।

– মলয় তেওয়ারি

খণ্ড-31
সংখ্যা-10