দিল্লির জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে এবারের নির্বাচনটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাঁচ বছর নির্বাচন হয়নি মাঝে। দীর্ঘদিন পর ছাত্র আন্দোলনের চাপে শেষ পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ নির্বাচন করার সবুজ সঙ্কেত দেয়। লোকসভা নির্বাচনের মুখে দাঁড়িয়ে বিজেপি আরএসএস মরীয়া ছিল দেশের অন্যতম সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিকে নিজেদের দখলে আনতে। এবিভিপিকে জেতানোর জন্য প্রশাসনকেও তারা নানাভাবে কাজে লাগিয়েছিল।
অন্যদিকে বামেরা এই নির্বাচন জেতার জন্য নিজেদের মধ্যেকার নানা বিতর্ককে পাশে সরিয়ে রেখে লড়েছিল ঐক্যবদ্ধভাবে। সিপিআই(এমএল) লিবারেশন প্রভাবিত ছাত্র সংগঠন আইসা, সিপিআই(এম)’এর এসএফআই, সিপিআই’এর এআইএসএফ একমঞ্চে এসে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়ে। অনেক আগে বামেরা নিজেদের মধ্যে লড়ত এবং তারাই ছিল জেএনইউ নির্বাচনে পরস্পরের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী। এবিভিপি’র উত্থানের পর বামেরা নিজেদের মধ্যেকার বিতর্ককে পাশে সরিয়ে রেখে একসঙ্গে লড়া শুরু করে কয়েক বছর আগে থেকেই। এই নির্বাচনেও সেই বোঝাপড়া অক্ষুণ্ণ ছিল।
বামেদের মধ্যেকার নির্বাচনী বোঝাপড়া মানে এই নয় তাদের মধ্যেকার বিতর্কগুলি মুছে গেছে। এ হল পরিস্থিতি অনুযায়ী বিতর্ক ও বোঝাপড়ার ঐক্যর দ্বান্দ্বিকতাকে পাশাপাশি নিয়ে চলা। আমরা আমাদের জীবনেও বিতর্ক ও বোঝাপড়াকে একসঙ্গে নিয়ে চলি নানাক্ষেত্রেই। রাজনীতিও তার ব্যতিক্রম নয়।
জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় তার প্রগতিশীল বাম মনোভাবাপন্ন মানসিকতার জন্য দেশের দক্ষিণপন্থী শিবির, বিশেষ করে আরএসএস, বিজেপির আক্রমণের শিকার হয়েছে বারেবারে৷ এই আক্রমণ শুধুই মতাদর্শগত ছিল না। ছিল অনেক সময়েই একেবারে প্রত্যক্ষ ও শারীরিক আক্রমণ। তৎকালীন এআইএসএফ/সিপিআই ছাত্রনেতা, অধুনা কংগ্রেস শিবিরে যোগ দেওয়া কানহাইয়া কুমারের পরিঘটনা সবারই মনে পড়বে৷ সে সময় আক্রমণের লক্ষ হয়েছিলেন কাশ্মীরের ছাত্রনেত্রী এআইএসএ’র শেহলা রশীদও।
আগামী দিনেও দক্ষিণপন্থী শিবির আরএসএস-বিজেপি যে নানাভাবে জেএনইউ’কে তথা প্রগতিশীল বাম মনোভাবাপন্ন ছাত্র আন্দোলন ও তার মতাদর্শকে টার্গেট করবে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। শুধু জেএনইউ’ই নয়, বাংলার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় সহ যেখানে যেখানেই প্রগতিশীল বাম ছাত্র আন্দোলন শক্তিশালী হবে, সেখানেই তাদের বিশেষ নজর পড়বে ও তারা আক্রমণ নামিয়ে আনতে চাইবে।
লোকসভা নির্বাচনের বিরাট কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ সামনে। প্রায় একশো কোটি ভোটার সেখানে দেশের ভাগ্য নির্বাচন করবেন। জেএনইউ নির্বাচনের হাজার দশেক ভোটের লড়াই সে তুলনায় গোষ্পদ মাত্র। কিন্তু এবিভিপি এখানে জিতলে তাকে অবশ্যই লোকসভা নির্বাচনের বড় ময়দানে বিজেপি নানাভাবে ব্যবহার করে নিত। বিভিন্ন মিডিয়া হাউজকে যে একাজে প্রস্তুত রাখা হয়েছিল গণনার প্রথম পর্বে যখন এবিভিপি এগিয়েছিল, তখন তা দেখাও যাচ্ছিল। শেষমেষ বড় ব্যবধানে বামেদের জয় সেই পরিকল্পনাকে বাতিল করতে বাধ্য করল। এখন মিডিয়া জেএনইউ নির্বাচনকে হয়ত আর ইস্যু হিসেবে বিবেচনা করবেই না।
লোকসভা নির্বাচন বামেদের জন্য এক কঠিন লড়াই। কেরালা ছাড়া অন্যত্র তারা একক শক্তিতে কতটা জিততে পারবেন তা নিয়ে সন্দেহ আছে। অনেক জায়গাতে বিজেপি বিরোধী জোটও মসৃণ হয়নি। যে সব জায়গায় তা হয়েছে বা হতে চলেছে বলে মনে হয় — যেমন তামিলনাড়ুতে বা বিহার ও ঝাড়খণ্ডে — সেখানে বামেদের কয়েকটি আসন বেশ সম্ভাবনাময়। তামিলনাড়ুতে সিপিআই এবং সিপিআই(এম) কয়েকটি আসন জিততে পারে৷ ত্রিপুরাতেও তাদের আসন জেতার সম্ভাবনা আছে। বিহার এবং ঝাড়খণ্ডে একাধিক আসন জেতার লড়াইতে আছে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন। কঠিন সময়ে বামেরা যত বেশি আসন জিততে পারেন, দেশের নানা প্রান্ত থেকে যত বেশি সংখ্যক বাম সংসদ লোকসভাতে পৌঁছতে পারেন, ততই মঙ্গল।
বামেরা তাদের শক্তিকে কতটা বাড়াতে পারবেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মনে রাখতে হবে ২০২৪’এর লোকসভা ভোট নানা কারণেই কেবল বাম শক্তির সংহতিকরণের ভোট নয়। এই মহাগুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের মূল প্রশ্ন বিজেপিকে পরাস্ত করা যাবে কীনা, লোকসভার সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে তাদের দূরে রেখে বিরোধীদের বোঝাপড়া সম্মত এক সরকার গঠন করা যাবে কীনা। বামেরা কয়েকটি আসন বাদে অন্যত্র জেতার লড়াইতে নেই। এমনকী অনেক জায়গায় তাঁরা প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করছেন না। কিন্তু সেই সমস্ত আসনেও বিজেপিকে হারানোর প্রশ্নটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সেই কাজে বাম কর্মী সমর্থকরা যেখানে যতটা পারেন তাঁদের শক্তি ও উদ্যোগকে বিজেপিকে পরাস্ত করার কাজে নিশ্চিতভাবে ব্যবহার করবেন। বাম শক্তির পুনরুজ্জীবনের প্রশ্নটি বিজেপির পরাজয় নিশ্চিত করার জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টার থেকে বিচ্ছিন্ন কোনও ব্যাপার নয়।
- সৌভিক ঘোষাল