সরকারি বেসরকারি কোনো সাহায্য না নিয়ে ৩৫ বছর ধরে সদস্য ও শুভানুধ্যায়ীদের সাহায্যে ও ডোনেশনে নাগরিক মঞ্চ শ্রম ও পরিবেশের উপর কাজ করে চলেছে। শ্রমজীবীদের অধিকারের লড়াইয়ে পাশে থাকার সংকল্পে নাগরিক মঞ্চ গঠিত হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। সেই সংগঠন কলেবরে বৃদ্ধি পেয়ে নাগরিকদের আধিকারের লড়াইয়ের পাশে যেমন থেকেছে একইসঙ্গে শ্রমিকদের অধিকারের লড়াই, পরিবেশ বাঁচানোর লড়াই সহ বহু আন্দোলনে সরাসরি অংশ নিয়েছে, সহায়তাও দিয়েছে। কলকাতার অদূরে সায়েন্স সিটি থেকে দশ কিলোমিটার দূরে বাসন্তী হাইওয়ের পাশে জলপথে নাগরিক মঞ্চের সাধারণ সভায় নব দত্ত শুরুর বক্তৃতায় সংগঠন গড়ে ওঠা ও ৩৫ বছর ধরে পথ চলার বিবরণ দিলেন ১০ মার্চ ২০০২৪-এ। এই দিন প্রায় ৫০ জন সদস্য সহযোগী সদস্য সহ অন্যান্য বন্ধুদের উপস্থিতিতে সকাল ১১ টা থেকে বিকেল ৪-৩০ পর্যন্ত নাগরিক মঞ্চের সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সাধারণ সভায় সভাপতিত্ব করেন বিশ্বনাথ দাশগুপ্ত, সঙ্গে ছিলেন দীপঙ্কর বসু ও নব দত্ত। প্রায় ১১ জন সভ্য ও দরদী এই দিন সাধারণ সভায় বক্তব্য রাখেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক অঞ্জন চক্রবর্তী ও জেএনইউ’র অর্থনীতির অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ধর দু’জনেই দেশের অর্থনীতির বড়সড় পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে বলে মন্তব্য করেন। অঞ্জন চক্রবর্তীর অভিমত, দেশে এক কাঠামোগত বদল ঘটে গিয়েছে পুঁজির বৈশ্বিক রূপান্তরের সঙ্গে। শাসকদল শ্রমিক শ্রেণিকে বিভাজন করার পদ্ধতিও পাল্টে ফেলেছে। তিনি বলেন ৩০ বছর আগে চালু হওয়া নব্য বিশ্বায়ন, বৈশ্বিক ব্যবস্থা ভেঙে যাচ্ছে। এর সঙ্গে ভারতবর্ষে নতুন এক অক্ষ যুক্ত হয়েছে — রাষ্ট্র নিজের চরিত্রও পরিবর্তন করে নিয়ে ধর্মীয় রাষ্ট্রের রূপ নিয়ে আসতে চাইছে। আগামী দিনে শ্রমিকশ্রেণি বলে কিছু কি থাকবে? এই পরিস্থিতিতে নাগরিক মঞ্চকে চেতনা জাগরণের কাজ করতে হবে। ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার ফারাক করতে পারে নাগরিক মঞ্চ। শ্রম ও পুঁজি, শ্রম ও পরিবেশের সম্পর্ক সম্বন্ধেও নাগরিক মঞ্চকে ভাবতে হবে। কারণ পুঁজির পরিবর্তন যেমন হয়েছে, শ্রমিকশ্রেণিরও পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। এর মধ্যে নাগরিক মঞ্চ কিভাবে কাজ করবে সেটি ভাবতে অনুরোধ করেন অঞ্জন চক্রবর্তী।
অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ধর বলেন শ্রমিকদের সংজ্ঞাটাই পাল্টে গিয়েছে। ওলা-উবের-অ্যামাজনে যারা কাজ করেন তাঁরা সেল্ফ এমপ্লয়েড। ইণ্ডিয়ান ফেডারেশন অব ইন্ডাস্ট্রি থেকে প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক তথ্যে জানা যাচ্ছে ওলা, উবের ও অ্যামাজন উভয় ক্ষেত্রে ৫০০০ জন করে ছিল সেল্ফ এমপ্লয়েড, এখন তাঁরা ওয়ার্কর্স। দ্বিতীয় অশনি সংকেত হল শ্রমিকরা কোথাও হারিয়ে যাচ্ছেন। দেশে তৈরি হয়েছে ডোল ইকনমি, ৮১ কোটি লোককে বিনামূল্যে খাদ্য দেওয়া হবে আগামী পাঁচ বছর মানে ৬০ শতাংশ মানুষ ডোলের উপর নির্ভরশীল। মানুষ তাঁর মর্যাদা হারাচ্ছেন, বৃদ্ধি পাচ্ছে অপুষ্টি যা প্রায় ৮০ শতাংশ। অধিকারের লড়াই কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। শ্রম অধিকারের জায়গায় আনা হয়েছে লেবার কোড। পুঁজির দরকার নমনীয় পরিসর। ফর্মাল ওয়ার্কাররা এখন ইনফর্মাল হয়ে যাচ্ছে। সরকারি চাকরি কনট্রাক্টচুয়াল এবং কনট্রাক্টার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আগামী লোকসভার ৪০০ আসন বর্তমান সরকার পেয়ে গেলে সংবিধান সংশোধন করে নেবে যেখানে কোনও অধিকার নাগরিকদের আর থাকবে না। রাজা প্রজার সম্পর্কে প্রজারই কর্তব্য থাকবে রাজার প্রতি, রাজার কোনো কর্তব্য থাকবে না বলেও মন্তব্য করেন বিশ্বজিৎ ধর। বিশ্বজিৎ ধর আরও বলেন গরিবের বৈষম্য বেড়েছে। পরিসংখ্যানের কারসাজি করে বলা হচ্ছে দেশে এখন মাত্র ৩ শতাংশ কর্মহীন। বলা হচ্ছে আমরা এখন ভাল আছি। সরকার জানাচ্ছে না বর্তমানে বেকার কত।
অন্যান্যরাও নাগরিক মঞ্চের নানা দিক দিয়ে কাজ নিয়ে কথা বলেন। ট্রেড ইউনিয়ন নেতা নবেন্দু দাশগুপ্ত, কুশল দেবনাথ, কলকাতা রাজপথে সাইকেল চালানোর দাবিতে আন্দোলনরত রঘু জানা, জলাভূমি সম্পদ হিসাবে ব্যবহার নিয়ে আন্দোলনের সংগঠক মনীন্দ্র মুখার্জি, ডাঃ শোভন পান্ডা, পবন মুখার্জি, অসীম ঘোষ, আইনজীবী শুভদীপ মুখার্জি, সংযুক্তা সেনগুপ্তা, সন্দীপ সিনহা রায়, দেবাশিস পাল প্রমুখ আন্দোলনের অভিজ্ঞতার কথা জানান। অসীম মুখার্জি জানান গত ৩৫ বছরে নাগরিক মঞ্চ ১৪০টি বই প্রকাশ করেছে, সেগুলি ডিজিটাল করা হচ্ছে।
সভার শেষে আগামী দুবছরের জন্য সভার সবার সম্মতিক্রমে নাগরিক মঞ্চের ১০ জনের কার্যকরী কমিটি ও ১৭ জনের একজিকিউটিভ কমিটি গঠন করা হয়। সভাপতি শুভেন্দু দাশগুপ্ত, সহ সভাপতি মনীন্দ্র নাথ মুখার্জি, লোকেন্দ্র বহুগুনা, স্বাতী গুপ্তা এবং সাধারণ সম্পাদক হিসাবে নির্বাচিত হন নব দত্ত।