হিন্দুত্ববাদী বার্তা দিতেই মোদীর কাশ্মীর সফর
give-hindutva-message

কাশ্মীরের জনগণের উদ্দেশ্যে কিছু বার্তা দিতেই নরেন্দ্র মোদী গত ৭ মার্চ কাশ্মীর সফর করেননি, ঐ সফরের কিছু গূঢ় উদ্দেশ্যও ছিল। ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ৩৭০ ধারা বিলোপ, কাশ্মীরের রাজ্য মর্যাদা হরণ ও রাজ্যটাকে ভেঙে দুটো কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করার প্রায় পাঁচ বছর পর প্রধানমন্ত্রী কাশ্মীর সফরে যেতে মনস্থ করলেন। সেদিন শ্রীনগর সফরে তাঁর সভার অনুষ্ঠান নির্ধারিত হয়েছিল বকসি ফুটবল স্টেডিয়াম। সভা উপলক্ষে স্টেডিয়ামের সব আসন ভরে গিয়েছিল। নরেন্দ্র মোদী তাঁর ভাষণে বলেন, “আমি জানতে পেরেছি ২৮৪টি ব্লকের ১ লক্ষ মানুষ আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন।…” তবে, ঐ স্টেডিয়াম সম্পর্কে অবহিত মানুষরা জানিয়েছেন, সেখানে খুব বেশি হলে তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশ হাজার মানুষ ধরতে পারে। স্টেডিয়ামে ভিড় নিশ্চিত করতে লেফটেন্যান্ট গভর্নর মনোজ সিনহা ও তাঁর অধীনস্থরা প্রচেষ্টায় কোনো ঘাটতি রাখেননি এবং সেই প্রচেষ্টার একটা অঙ্গ অবশ্যই ছিল হুমকি ও জোরজবরদস্তি। সমস্ত সরকারি কর্মীদের যোগদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। সরকারি প্রকল্পে কর্মরত দিন মজুরদেরও সভায় যোগ দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। একেবারে ভোরে অনেক দূর থেকে বাসে করে আনা হয়েছিল বিজেপি সমর্থকদের। ঠিকাদারের কাজ করেন আইজাজ নামে জনৈক ব্যক্তি বলেছেন, “আমার আসার কোনো ইচ্ছাই ছিল না। আমার মনে হল আমাকে জোর করে বাড়ি থেকে বার করা হয়েছে। আমাকে সোজাসাপ্টা বলা হয়েছিল, জনসভায় না গেলে আমার বরাত বাতিল হয়ে যাবে। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে আমরা যারা এখানে এসেছি তাদের ৯০ শতাংশকেই জোর করে আনা হয়েছে।...” (মকতুব মিডিয়া ডট কম-এ গাফিরা কাদরির প্রতিবেদন থেকে) সেদিনের জনসভায় নরেন্দ্র মোদী তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, কাশ্মীরের জনগণের “হৃদয় জয় করার জন্য” তিনি কঠোর পরিশ্রম করে চলেছেন। তবে, কাশ্মীরের জনগণের অধিকার হরণের তাঁর সরকারের পদক্ষেপ সেখানকার জনগণের কাছে হৃদয়স্পর্শী না হৃদয়বিদারক হয়েছে, ঠিকাদার আইজাজ-এর বক্তব্যে সে বিষয়ে সংশয়ের কোনো অবকাশ বোধকরি থাকেনি।

৩৭০ ধারা বাতিলের পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে নরেন্দ্র মোদী সভায় বলেন, কাশ্মীরের কাছে ৩৭০ ধারা ছিল একটা শৃঙ্খল। সেই ধারার অপসারণে কাশ্মীরের জনগণ এখন “স্বাধীনভাবে শ্বাস নিতে পারছেন”। তিনি আরও বলেন, ৩৭০ ধারা বিলোপের পর কাশ্মীরে “শান্তি ও উন্নয়নের” এক নতুন যুগের শুরু হয়েছ – “এই নতুন জম্মু ও কাশ্মীরের জন্য আমরা দশকের পর দশক অপেক্ষা করছিলাম।”

“নতুন ভারতে” এই “নতুন কাশ্মীর” কাশ্মীরের জনগণের কাছে কতটা উপভোগ্য হয়েছে তা অবশ্যই বিবেচনার দাবি রাখে। প্রায় ছ-বছর হয়ে গেল কাশ্মীরে কোনো নির্বাচিত সরকার নেই। ২০১৮ সালে বিধানসভা ভেঙে দেওয়ার পর সরকার সেখানে এখনও নির্বাচন করে উঠতে পারেনি। সুপ্রিম কোর্ট ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বিধানসভা নির্বাচন করতে হবে বলে নির্দেশ দিলেও মোদী সে সম্পর্কে কোনো উচ্চবাচ্য এখনও করেননি। ৩৭০ ধারা বিলোপের পর নির্বিচারে রাজনৈতিক কর্মীদের ধরপাকড় চলে। মিছিল-মিটিং এবং জনসভা অনুষ্ঠানের ওপর নিয়ন্ত্রণ এখনও পুরোদমে বহাল। ইন্টারনেট বন্ধ থাকে মাসের পর মাস। সংবাদ মাধ্যম কঠোর নিষেধাজ্ঞার কবলে – সরকারের সমালোচনা হলেই সাংবাদিকদের কাছে কৈফিয়ত দাবি করা হচ্ছে ও তাদের জেলে পোরা হচ্ছে। বিচার ছাড়াই আটক রাখার জন্য ব্যাপক হারে প্রয়োগ হয়ে চলেছে কুখ্যাত ও দানবীয় জনসুরক্ষা আইন। একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য (‘রাজ্য’ অভিধা এখন অবশ্য নেই) কাশ্মীরে হিন্দু মুখ্যমন্ত্রী বসানোর আরএসএস-বিজেপির দুরভিসন্ধি সমানভাবে সক্রিয় রয়েছে। এই লক্ষ্যে তাদের কুটিল কৌশলের অন্যতম হল বিধানসভা ও লোকসভা আসনগুলোর এলাকার পুনর্বিন্যাস। এই পুনর্বিন্যাসে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জম্মু অঞ্চলের আসন সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে ছটি, আর কাশ্মীরের জনসংখ্যা বেশি হওয়া সত্ত্বেও সেখানে আসন বেড়েছে মাত্র একটি। হিন্দু অধ্যুষিত রাজৌরি ও পুঞ্চের এলাকা অনন্তনাগ সংসদীয় ক্ষেত্রের অন্তর্ভুক্ত করে বিজেপির লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা জোরালো করা হয়েছে। গণতন্ত্রের নাভিশ্বাস ওঠা এই পরিস্থিতি নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহদের কাঙ্খিত হতে পারে, এর জন্য আরএসএস-বিজেপি ‘দশকের পর দশক’ অপেক্ষা করতে পারে, কিন্তু এই পরিস্থিতিতে কাশ্মীরের জনগণ কতটা স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতে পারেন?

নরেন্দ্র মোদীর শ্রীনগর সফরকে কেন্দ্র করে শহরকে সেনা নিরাপত্তায় মুড়ে দেওয়া হয়েছিল। ৫০ মিটার অন্তর সেনা প্রহরা বসানো হয়েছিল। শহর দিয়ে বহমান ঝিলাম নদীতে মোটর বোটে প্রহরা জারি রেখেছিল নৌ-সেনারা। শ্রীনগরকে “সাময়িক লাল এলাকা” বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। অনুমতি পাওয়া ছাড়া অন্যান্য গাড়ির চলাচল নিষিদ্ধ ছিল। শ্রীনগর আক্ষরিক অর্থেই হয়ে উঠেছিল দুর্ভেদ্য দুর্গ। নরেন্দ্র মোদীর মতে কাশ্মীরের পরিস্থিতি এখন “স্বাভাবিক”, আর অমিত শাহ বলেছিলেন কাশ্মীরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই তার রাজ্য মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়া হবে। কাশ্মীর এখনও কেন্দ্রের শাসনাধীন এবং কি বিধানসভা নির্বাচন কি রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়া — নরেন্দ্র মোদীদের মুখে এখনও কুলুপ। নরেন্দ্র মোদী শ্রীনগর সফরে গিয়েছিলেন কাশ্মীরের জনগণকে কোনো বার্তা দিতে নয়। তাঁর আসল উদ্দেশ্য ছিল লোকসভা নির্বাচনের আগে সংখ্যাগুরুবাদে আসক্ত হিন্দু জনগণের কাছে ৩৭০ ধারা বিলোপকে আরএসএস-বিজেপির এক জয় হিসাবে জাহির করতে, কাশ্মীরকে কেন্দ্রের পদানত হিসাবে তুলে ধরতে।

খণ্ড-31
সংখ্যা-9