সকলের ফোনে ফোনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিজ্ঞাপন পৌঁছে যেতে দেখা গেল। নির্বাচন ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পর সরকারি খরচে নিজের এই প্রচার চালালেন প্রধানমন্ত্রী। নির্বাচন ঘোষণা হওয়ার সাথে সাথেই আদর্শ আচরণ বিধি লাগু হয়ে যায়। নির্বাচন ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পরে সরকার আর ভোটারদের প্রভাবিত করার কোনোরকম প্রচার করতে বা প্রকল্প ঘোষণা করতে পারে না। নিজের ঢাক পেটানো চিঠি কোটি কোটি ভোটারের ফোনে ফোনে পাঠিয়ে আদর্শ আচরণ বিধি ভঙ্গ করলেন এখনো পদে থাকা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। চণ্ডিগড়ের এক ব্যক্তির দায়ের করা অভিযোগ খতিয়ে দেখে চণ্ডিগড়ের নির্বাচন কমিশনার মোদির চিঠিকে বিধি ভঙ্গ বলে সাব্যস্ত করে ভারতের নির্বাচন কমিশনের কাছে সোপর্দ করেছেন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য। নির্বাচন কমিশন কি আদৌ সত্য বলার সাহস দেখাবে?
ভারতে গণতন্ত্রের বিকাশ ও প্রসারের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হিসেবে নির্বাচনী ব্যবস্থা অশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। ভারতের গণতান্ত্রিক শাসন প্রক্রিয়ার মূল ভিত্তি নির্বাচন। সেই নির্বাচনী প্রক্রিয়া অবাধ, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ পদ্ধতিতে সম্পন্ন করার মূল সাংবিধানিক দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা নির্বাচন কমিশন। স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচন সংগঠিত হয়েছিল জাত-ধর্ম-লিঙ্গ নির্বিশেষে সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের অবাধ ও সার্বিক ভোটাধিকার প্রয়োগ নিশ্চিতকরণের মধ্যে দিয়ে এবং তা করার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও বিপুল সক্রিয়তার ভূমিকা পালন করেছিল ভারতের নির্বাচন কমিশন। লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে অক্লান্ত পরিশ্রমে প্রথম সাধারণ নির্বাচনের জন্য ভারতের বহু কোটি সর্বসাধারণকে প্রস্তুত করার কাজ সংগঠিত করেছিল। পরবর্তী ছয় দশক ধরে নির্বাচন কমিশনের এই স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ভূমিকা সামগ্রিকভাবে বজায় ছিল। সরকারি ও বিরোধী – সমস্ত দলের কাছেই এক বিশ্বাসযোগ্য ও মান্য অবস্থান নির্বাচন কমিশনের ছিল এবং বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতিবাচক ভূমিকার সরাসরি বিরুদ্ধাচরণ করতেও তাকে দেখা গেছে।
নির্বাচন কমিশনের এই গৌরবময় যাত্রা উল্টোদিকে ঘুরতে শুরু করে কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি সরকার আসার পর থেকে। শাসক দল বিজেপি নির্বাচন কমিশনকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। এবং গত বছর নতুন আইন এনে এই নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ পাকাপোক্ত করে ফেলেছেন মোদি। নতুন আইন অনুযায়ি নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ ও তাদের বেতন সংক্রান্ত চূড়ান্ত ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে। তিনজন নির্বাচন কমিশনারের অন্যতম অরুণ গোয়েলের অকস্মাৎ পদত্যাগের পর এখন শুধুমাত্র একজন কমিশনারই পুরোটা চালাচ্ছেন, বাকি পদ পুরণের ক্ষমতা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর হাতে। ফলত বিধি ভেঙ্গে ফোনে ফোনে এভাবে প্রচার চালানোকে নিষিদ্ধ করার সৎসাহস কমিশনের হবে কী না সে প্রশ্ন উঠেছে।
আরেকটা প্রশ্ন হল, প্রধানমন্ত্রী কি এভাবে কোটি কোটি মানুষের ব্যক্তিগত ফোন নাম্বারে মেসেজ পাঠাতে পারেন? কীভাবে ওই মেসেজিং সংস্থা আমাদের ফোন নাম্বার পেল? বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার জন্য সরকার আমাদের ব্যক্তিগত ফোন নাম্বার সংগ্রহ করতেই পারে। কিন্তু এক উদ্দেশ্যে নেওয়া কোনও ব্যক্তিগত তথ্য অন্য কোনও উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার অধিকার সরকারের নেই। করলে তা দেশবাসীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ভঙ্গ করা, বেআইনি।
গত দশ বছরের মোদি-বিজেপি শাসনে আমাদের বহু অধিকারের ওপরই ক্রমাগত আক্রমণ নেমেছে। আদিবাসীদের ভাষা-ধর্ম-সংস্কৃতি ও অরণ্যের অধিকার, দলিত এসসি- এসটিদের নিপীড়ন নিবারণ আইন, সংবিধান স্বীকৃত সংরক্ষণ ব্যবস্থা, নারীর স্বাধীন ইচ্ছা ও সমানাধিকার, পরিবেশ সুরক্ষা, শিক্ষা-স্বাস্থ্যকাজের অধিকার, কৃষকের ফসলের দাম আর শ্রমিকের মজুরি ও জোট বাঁধার অধিকার — এই সবই মোদি জমানায় বিপন্ন। এমনকি সমস্ত অধিকার পাওয়ার মূলে আছে যে সম নাগরিকত্বের স্বীকৃতি তার ওপরই প্রবল আঘাত হানছে বিজেপি। সিএএ-এনআরসি প্রকল্পের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের নাগরিকত্বকেই নাকচ করে দিচ্ছে মোদি-বিজেপি সরকার।