“বিজেপি হারাও, শ্রমিক বাঁচাও” ধ্বনি উঠল শ্রমিক কনভেনশনে
labor-convention_0

মোদী হটাও, শ্রমিক বাঁচাও — এই আহ্বান রেখে ১৬ মার্চ অনুষ্ঠিত হল এআইসিসিটিইউ-র শ্রমিক কনভেনশন। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এআইসিসিটিইউ অনুমোদিত ইউনিয়নের নির্মাণ, চটকল, স্কিম কর্মী, সরকারি ও বেসরকারি পরিবহন, ইঁট ভাটা, কন্ট্রাক্ট শ্রমিক, ট্রেক্সটাইল, রেল, প্রতিরক্ষা প্রভৃতি শিল্প সংস্থার শ্রমিক কর্মচারীরা উপস্থিত ছিলেন।

ওই দিন সকালে প্রয়াত বালি অঞ্চলের দীর্ঘদিনের সাথী রঘুপতি গাঙ্গুলী, কল্যাণীর সদ্য প্রয়াত কমরেড অমিতাভ রায় সহ আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়া কমরেডদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন ও নীতীশ রায়-এর উদ্বোধনী সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে কনভেনশন শুরু হয়। এআইসিসিটিইউ-র সাধারণ সম্পাদক বাসুদেব বসু প্রথমেই এক রাজনৈতিক প্রতিবেদন পেশ করে কনভেনশেনের মূল সুর বেঁধে দেন। তিনি বলেন, আমরা আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগেই এই কনভেনশন করছি, স্বাধীনতা পরবর্তীতে যে নির্বাচন আগে কখনও এতো গুরুত্ব ও তাৎপর্য নিয়ে সামনে আসেনি। ভারতের সংবিধান, দেশের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, বিরোধী দল, থাকবে কী থাকবে না, ভবিষ্যতে আদৌ নির্বাচন হবে কী হবে না তা আজ বিরাট এক প্রশ্ন। ২০২৫-এ আরএসএসএর শতবর্ষে হিন্দুরাষ্ট্র বানাবার যে লক্ষ্য রয়েছে, মোদী আবার ফিরে এলে দ্রুত আমাদের দেশ সেই দিকেই এগোবে, সংখ্যালঘুরা এ দেশে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হবেন। এই বিরাট বিপদ, এই বিপর্যয়, সার্বিক ধ্বংস থেকে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে রক্ষা করার দায়িত্ব শ্রমিকশ্রেণিকে নিতে হবে মোদীকে নির্বাচনে হারিয়ে। শ্রমিকশ্রেণির ঐক্যকে ভাঙতে বিজেপি যে সাম্প্রদায়িক তাস খেলছে, সিএএ জারি করে ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেওয়ার যে সংবিধান বিরোধী পদক্ষেপ নিয়েছে, তার বিরুদ্ধে লড়াই করার আহ্বান রাখছে এই কনভেনশন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, দীর্ঘ লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে ভারতের শ্রমিকশ্রেণি যে সমস্ত অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছিল, মোদী সরকার তা আজ ছিনিয়ে নিল চার শ্রম-কোডের মাধ্যমে। দেশের সংবিধানে শ্রম বিষয়টি রাজ্য ও কেন্দ্রের যুগ্ম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও মোদী সরকার রাজ্যগুলোর সাথে কোনো পরামর্শ ছাড়াই একতরফা শ্রমকোডগুলো আনল, কোভিডের সময় যখন সংসদের অধিবেশন চলতে পারছিল না, তখন বিস্তারিত আলাপ আলোচনা ছাড়াই কয়েক মিনিটের মধ্যেই সবগুলো কোড পাশ করিয়ে নেয়। ভারতের দুশো বছরের পুরাতন প্রতিরক্ষা শিল্পকে বেসরকারি করার লক্ষ্যে কর্পোরেশন বানালো, সেই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে যখন দেশব্যাপী ধর্মঘটের প্রস্তুতি নিতে শুরু করল শ্রমিক-কর্মচারীরা তখন নামানো হল দানবীয় এডসা (এসেনশিয়াল ডিফেন্স সার্ভিস অ্যাক্ট), যার মাধ্যমে নিষিদ্ধ করা হল ধর্মঘট, ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার, সমস্ত ধরনের আন্দোলনই আজ নিষিদ্ধ এই শিল্প ক্ষেত্রে।

মোদীর ১০ বছরের শাসনকালে আদানি-আম্বানির মতো হাতে গোনা কয়েকজনের সম্পদ আকাশ ছুঁয়েছে, আর বিপরীতে দেশের শ্রমিক সহ শ্রমজীবী মানুষের আয় থেকে গেছে একই জায়গায়। ২০১৪-১৫ ও ২০২১-২২’র পর্যায়ে দেশের শ্রমজীবী মানুষের প্রকৃত আয় প্রতি বছর বাড়ার বদলে কমেছে এক শতাংশ হারে, নির্মাণ শ্রমিকদের ক্ষেত্রে কমেছে ০.২ শতাংশ। অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত ৯১ শতাংশ শ্রমিকের নেই সামাজিক সুরক্ষা। পৃথিবীতে দ্রুততম আর্থিক বিকাশ হচ্ছে বলে মোদী নিজের পিঠ চাপড়ালেও আর কোনো জি-২০ দেশে এত বিপুল পরিমাণে শ্রমিক ইনফর্মাল সেক্টারে নেই।

নেই শ্রম আইনের রক্ষাকবচ। লক্ষ লক্ষ নারী শ্রমিকদের দিয়ে অতি প্রয়োজনীয় আশা অঙ্গনওয়াড়ি মিডডেমিল-এর কাজ করালেও নেই শ্রমিক হিসাবে তাঁদের স্বীকৃতি, ন্যূনতম মজুরি, সামাজিক সুরক্ষা। ভারতে ৯.৫ কোটি নারী বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করছেন। সরকার এগুলোকে রোজগার হিসাবে দেখালেও আইএলও তার মান্যতা দেয় না। রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে বেলাগাম বেসরকারিকরণ, বিলগ্নীকরণ, রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্ক থেকে নেওয়া প্রায় ১৫ লক্ষ কোটি টাকার ঋণ মুকুব, কর্পোরেট ট্যাক্সে ঢালাও ছাড় — নানা দিক থেকে এত সুযোগ সুবিধা পেলেও বেসরকারি সংস্থাগুলো খুব কম বিনিয়োগ করছে দেশের শিল্প ক্ষেত্রে।

labor-convention_1

আমাদের রাজ্যেও সরকারি ক্ষেত্রগুলোতে মাত্রাছাড়া ইনফর্মাল কর্মী নিয়োগ করা হচ্ছে। খুঁড়িয়ে খুড়িয়ে বাড়ছে ন্যূনতম মজুরি। শুধুমাত্র নতুন কলকারখানার অভাবের জন্যই নয়, আমাদের রাজ্যে সমস্ত কর্মক্ষেত্রে অত্যন্ত নিম্ন হারের মজুরির কারণে বিপুল সংখ্যক পরিযায়ী শ্রমিক ভিন রাজ্যে পাড়ি দেয় রুটি রুজির সন্ধানে। রাষ্ট্রীয় পরিবহনের অবসরপ্রাপ্ত কর্মীরা বিধিবদ্ধ অবসরকালীন সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত, ওই সংস্থায় সরকার বিরোধী ট্রেড ইউনিয়ন করতে দেওয়া হয় না। শিল্প সংস্থাকে খুশি করতে এ রাজ্যে ধর্মঘটকে কার্যত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে, ধর্মঘটের জন্য শ্রমদিবস নষ্ট হওয়া শূন্যে ঠেকলেও, লক আউটের ফলে শ্রমদিবস নষ্ট হয়েছে একশ শতাংশ!

সম্প্রতি চটকল শ্রমিকরা তাঁদের দীর্ঘদিনের দাবি সনদের মিমাংসা করেছে। এই চুক্তি রূপায়ন করাটা চটকল শ্রমিকদের কাছে এক বড় চ্যালেঞ্জ। বহু বঞ্চনা, উপেক্ষার পর রাজ্যের স্কিম কর্মীরাও তাঁদের পাওনা বুঝে নিতে শুরু করেছেন। ন্যায় সংহিতার যে ধারাগুলো পরিবহন শ্রমিকদের সর্বনাশ ডেকে আনত, তার বিরুদ্ধে তাঁদের আচমকা দেশব্যাপী ধর্মঘটে কেন্দ্রীয় সরকার পিছু হটেছে।

দেশ জুড়ে সংগঠিত ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনই এখন প্রধান প্রবণতা। বারে বারে শ্রম-কোডের বিরুদ্ধে ধর্মঘটের ফলে উদ্ধত মোদী সরকার এখনো তা লাগু করতে পারছে না। একমাত্র মোদী সরকারকে নির্বাচনে হারিয়েই চার শ্রম-কোডকে নিক্ষিপ্ত করা যাবে আস্তাকুঁড়ে।

তাই, দেশ বাঁচাতে, সংবিধান রক্ষা করতে, সামনের নির্বাচনে আমাদের স্লোগান বিজেপি হারাও, দেশ বাঁচাও, বিজেপি হারাও শ্রমিক বাঁচাও।

পার্টি রাজ্য কমিটির সম্পাদক অভিজিত মজুমদার মোদী সরকারের নামিয়ে আনা ফ্যাসিবাদী রাজের নানান দিককে উন্মোচন করে আসন্ন নির্বাচনে বিজেপি সরকারকে হারানোর ডাক দেন।

চটকলের সাম্প্রতিক ত্রিপাক্ষিক চুক্তি, বেশ কয়েক দশক পর তাদের ঘরভাড়া বৃদ্ধি সহ অন্যান্য কিছু অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া সহ যা অর্জিত হয়েছে, তা রক্ষা করা, ঐক্যবদ্ধ ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে মজবুত করার জোর দেন বিসিএমএফ এর রাজ্য সভাপতি নবেন্দু দাশগুপ্ত।

স্কিম কর্মীদের দীর্ঘ বঞ্চনা, উপেক্ষা ও শ্রমিক হিসাবে স্বীকৃতি না দেওয়া, সরকার এই গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে নারী শ্রমকে মর্যাদা না দিয়ে তাকে বেগার শ্রম হিসাবে গণ্য করা, এলাহাবাদের ইতিবাচক রায়কে বাস্তবায়িত না করে আজ পর্যন্ত স্কিম কর্মীদের ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা না করা বিষয়কে তুলে ধরেন সারা ভারত স্কিম ফেডারেশন-এর নেত্রী জয়শ্রী দাস।

প্রতিরক্ষা শিল্পের জয়দেব দে উন্মোচিত করেন কীভাবে মোদী সরকার প্রতিরক্ষা, রেল, বিমা সহ রাষ্ট্রায়ত্ব ও সরকারি সংস্থায় ঢালাও বেসরকারিকরণ, বিলগ্নিকরণ করে এতদিন ধরে গড়ে ওঠা সমগ্র রাষ্ট্রীয় সেক্টারকেই কী ভয়ঙ্কর বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে, মনিটাইজেশন পাইপলাইনের মাধ্যমে কর্পোরেটদের কাছে বেচে দিচ্ছে জাতীয় সম্পদ।

কনভেনশেনের শেষ বক্তা ছিলেন রাজ্য সভাপতি অতনু চক্রবর্তী। নতুন শ্রম-কোড কিভাবে কেড়ে নিল সামাজিক সুরক্ষার এতদিনের প্রাপ্য সুযোগ সুবিধা, কিভাবে শ্রমিকশ্রেণির ধর্মঘটের হাতিয়ারকে অপ্রাসঙ্গিক করে দিল মোদী সরকার, ট্রেড ইউনিয়নের দর কষাকষির ক্ষমতা ও অধিকারকে হরণ করা হল, তা ব্যাখ্যা করেন। বিগত দিনে কৃষক আন্দোলনকে আর্থিক সাহায্য করার জন্য দেশে ডাক-কর্মীদের বহু পুরাতন স্বীকৃত সর্বভারতীয় ইউনিয়নের স্বীকৃতি বাতিল করা, সমস্ত স্তরের শ্রমিকদের মজুরি বা বেতনে সংকোচন, বিপুল অসংগঠিত শ্রমিকদের উপর নেমে আসা দুর্দশাকে উল্লেখ করে বলেন, আসন্ন নির্বাচনে শ্রমিক শ্রেণিকে আংশিক, ক্ষুদ্র পেশাগত, আর্থিক দাবিদাওয়ার ঊর্ধ্বে উঠে পালন করতে হবে দেশপ্রেমের কর্তব্য। আর তা হল, সংবিধান বিপন্নকারী, গণতন্ত্র ধ্বংসকারী, সমস্ত দিক থেকে সর্বনাশের পথে দেশ ও দেশবাসীকে ঠেলে দেওয়ার জন্য যে ফ্যাসিবাদী মোদী সরকার দায়ী, সেই বিজেপিকে হারাতে হবে আসন্ন নির্বাচনে।

উদ্দীপনার সাথে স্লোগান ধ্বনির মাধ্যমে শেষ হয় শ্রমিক কনভেনশন।

খণ্ড-31
সংখ্যা-10