ইয়াজান। যুদ্ধ বিধ্বস্ত গাজার এক শিশু। কঙ্কালসার ছোট্ট দেহটিতে গভীর কালো চোখদু’টি কী বাঙ্ময়। সেখানে যেন বিস্ময়ভরা অনুনয়, ‘কেন এমন হয়ে গেল সব? কেন সব কেড়ে নিলে আমাদের?’
বাচ্চাটি এ মাসের গোড়ায় মারা গেছে। স্রেফ না খেতে পেয়ে। রাফার এক স্কুলের শরণার্থী শিবিরে। আরও হাজার হাজার শিশু এভাবেই অনাহারে, তৃষ্ণায়, মহামারিতে মারা যাবে গাজায় - রাষ্ট্রসংঘের আশঙ্কা।
এই শিশুরা, তাদের বাবা-মায়েরা এক উদ্ধত রাষ্ট্রনায়কের ঘৃণার শিকার। ইজরায়েলের দাম্ভিক শাসক গাজাবাসীর গণনিধনে বদ্ধপরিকর। সারা পৃথিবীর প্রতিবাদেও তার ঔদ্ধত্য এতটুকু চিড় খায় না! যেমনটা রাশিয়ার পুতিন।
ভারতেও এই মুহূর্তে ৬৭ লক্ষ শিশু ২৪ ঘণ্টা অনাহারে থাকে, যাদের বয়েস দু’বছরের মধ্যে। তারাও ঘৃণার শিকার — ভারতের কর্পোরেট প্রভুরা আর তাদের সেবাদাসেরা গরিব দলিত আদিবাসী সংখ্যালঘুদের ঘৃণা করে। সীমাহীন নির্লজ্জ বিবেকহীন বৈষম্যে সেই ঘৃণা প্রতিফলিত। (তবুও অনাহারের এই পৃথিবীতে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে ‘স্পেসভিআইপি’র ভাসমান রেস্তোরাঁয় পাঁচ লক্ষ ডলারে ভোজ খাওয়ার লোকের অভাব হবে না! ভারতীয় ধনকুবেরের ছেলের বিয়েতে ১০০০ কোটি টাকা খরচ হয়!)
ক্ষুধার পৃথিবীকে অপ্রাসঙ্গিক করে ক্রমশ প্রকট হচ্ছে ঘৃণার পৃথিবী। এই ঘৃণা বহুস্তরীয়। কোথাও তা বর্ণবিদ্বেষ — মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে গত আড়াই মাসে আট জন ভারতীয়কে হত্যা করা হয়েছে, বেশিরভাগই ছাত্র। তারা বর্ণবিদ্বেষের শিকার হলেও হতে পারে। কোথাও জাতিবিদ্বেষ — ভারতের এক ছোট্ট প্রদেশ মণিপুর গত প্রায় একবছর ধরে ছারখার হয়ে যাচ্ছে সেই আগুনে। আর সারা ভারতকে বিষিয়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে ধর্ম আধারিত সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে। যার ভয়াল চেহারা দেখেছি গুজরাট গণহত্যায়, দু’দশক আগে।
ভারতের বর্তমান শাসকদল বিজেপি-আরএসএস, সংখ্যাগুরু হিন্দুত্বের আধিপত্যকামিতায় সংবিধান সহ গোটা রাষ্ট্রের খোল নলচে পাল্টাতে চায়। সেই উদ্দেশ্যে তাদের তূণীর থেকে একেক সময়ে একেক অস্ত্র বার করে চলেছে। রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক হিংসার আবহে সংখ্যালঘু মানুষকে সব সময় সন্ত্রস্ত রাখা। (ঠিক যেমন নানা অর্থহীন আর্থিক বিধি নিষেধের মারপ্যাঁচে গরিব সাধারণ মানুষকে ভয়ের মধ্যে রাখা যাতে তারা নাগরিক অধিকার দাবি না করতে পারেন।)
ভিড়হিংসা, ধর্মীয় শ্লোগানের রণহুঙ্কার, ঘৃণাভাষণ এমনকি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মাধ্যমে নানা অসত্য, অর্ধসত্য বিকৃত বিষাক্ত প্রচারের মধ্য দিয়ে সেই হিংসা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। তার পরিণতিতে ধারাবাহিক ভাবে সংখ্যালঘু মানুষের হেনস্থা, শারীরিক নিগ্রহ, সম্পত্তিহানি এমনকি হত্যার অসংখ্য ঘটনা দেশ দেখেছে, দেখে চলেছে। নিকট অতীতে আমরা দেখেছি কীভাবে চলন্ত ট্রেনের কামরায় এক সামরিক কর্মী তার আধিকারিক সহ চার মুসলিম নাগরিককে বিনা প্ররোচনায় সার্ভিস রিভলবার থেকে হত্যা করেছে। কতটা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ভিতরে থাকলে এটা সম্ভব! আর তার সাম্প্রতিক চরম আগ্রাসী রূপ-বুলডোজার রাজ। এ তো হচ্ছে দেশবাসীর সঙ্গে। কিন্তু ক’দিন আগে গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদেশি ছাত্রদের ওপর যে হামলা হল তাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রক যথেষ্ট বেকায়দায়।
গত ১৬ মার্চ রাতে আহমেদাবাদে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলের ঘরে পাঁচ বিদেশি ছাত্র রমজানের নামাজ পড়ছিলেন। তারা উজবেকিস্তান, আফগানিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা ও শ্রীলঙ্কা থেকে আগত। এর মধ্যেই নিরাপত্তারক্ষীকে ধাক্কা মেরে ২০-২৫ জন দুষ্কৃতী ধর্মীয় শ্লোগান দিতে দিতে ক্যাম্পাসে ঢুকে সোজা হস্টেলের ঘরে গিয়ে তাদের নমাজ পড়তে বারণ করে, “জয় শ্রীরাম” শ্লোগান দিতে বলে এবং বেধড়ক মারধর করে। শুধু তাই নয়, তাদের মোবাইল, ল্যাপটপ, বাইক ভাঙচুর করে। ৫ জনকেই হাসপাতালে নিতে হয়, দু’জনের চোট গুরুতর। অমুসলিম অন্য বিদেশি ছাত্ররা বাঁচাতে এলে তাদেরও মারধর করা হয়।
এই ঘটনার পর ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেছেন, ‘যে হেতু এই ছাত্ররা সকলেই বিদেশি, তাই তাদের ভারতীয় ‘সংস্কৃতির সংবেদনশীলতা’ সম্পর্কে জানা বোঝা উচিত’। বটেই তো! কিন্তু ধর্মীয় বিদ্বেষপুষ্ট যে ‘নিগ্রহের সংস্কৃতি’র সঙ্গে তাদের পরিচিত হতে হল, এরপর আর সেই ‘জানা বোঝার’ উৎসাহ তাদের থাকবে? আর প্রধানমন্ত্রীর সযত্নপ্রসাধিত ও প্রচার-চর্চিত ‘বিশ্বগুরু’ ইমেজ কি একটু হলেও ম্লান হল না এই দুষ্কৃতী তাণ্ডবে!
আসলে বাঁধনহারা লাগামছাড়া ঘৃণাভাষণে, (সুপ্রিম - তিরস্কার সত্ত্বেও) কেউই কম যান না! কিন্তু ছোট বড় মন্ত্রী, নেতা, কর্মী, ধর্মগুরু - সবাই পার পেয়ে যান। কারণ তারা সংখ্যাগুরু। সংসদে বসে অপর সাংসদকে বেনজির কুৎসিত আক্রমণ করলেও, কোনও শাস্তি হয় না! ‘গোলি মারো শালোঁকো’ বলে গলার শির ফুলিয়েছিলেন একজন, এখন তিনি নাকে চশমা এঁটে অধ্যাপক সুলভ গাম্ভীর্যেবঙ্গবাসীকে ‘ভদ্র’ ‘সভ্য’ হওয়ার জ্ঞান বিতরণ করে যান!
কিন্তু উমর খালিদ সমান নাগরিকত্বের সমর্থনে ভাষণ দেওয়ায় ‘দেশদ্রোহী’ হয়ে গেলেন! অন্ধকারান্তরালে তাঁর যৌবনের অমূল্য দিনগুলো কাটিয়ে যাচ্ছেন! সংখ্যালঘু কিনা!
এই ঘৃণার আবহ ভারতবর্ষে এত তীব্র, এত ব্যাপক তো ছিল না! ঘৃণার কারবারিরা যবে থেকে ভারতবর্ষের রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে শুরু করেছিল তখন থেকে সেই সাম্প্রদায়িক ঘৃণা প্রকাশ্য হতে থাকে। আমাদের বাংলায় রামনবমী নিয়ে আগে কখনও সশস্ত্র মিছিল বেরোয়নি। উদ্বেগের প্রহরও গুনতে হত না, এখন হয়! কেন?
কিন্তু যতই প্ররোচনা থাক, ২০১৮-র ২৯ মার্চ আসানসোলের নুরানি মসজিদের ইমাম রশিদের কথাগুলো আমরা মনে রাখব। এক সদ্য পুত্রহারা পিতা কীভাবে সমস্ত ক্ষোভ, যন্ত্রণা, কষ্টকে সংবরণ করে একজন আদর্শ নাগরিক শুধু নয়, এক মহৎ ‘মানুষ’ হয়ে উঠেছিলেন তা কিংবদন্তি হয়ে থাকবে।
ঘৃণার কারবারিরা যাবে তাদের অমোঘ গন্তব্যে - ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। যেমন গেছে হিটলার, মুসোলিনিরা...। মানুষ তাদের সেখানে পাঠাবে।
– জয়ন্তী দাশগুপ্ত