দেয়া নেয়ার কথা
give-and-take_0

না না, আমি সেই পুরোনো বাংলা সিনেমার কথা বলছি না। এ হল আচার্য প্রমোদ কৃষ্ণাণ আর প্রধানমন্ত্রীর মোদির দেয়া নেয়ার কথা। এতদিনে সবাই জেনে গেছেন যে রামমন্দির উদ্বোধনে না যাবার জন্য কংগ্রেস নেতৃত্বকে আচ্ছা করে ঠুকেছেন আচার্য। তিনি একসময় প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর উত্তর প্রদেশ সামাল দেবার উপদেষ্টাদের মধ্যে ছিলেন। ২০১৯-এ দাঁড়িয়েছিলেন লাখনৌ থেকে কংগ্রেসের টিকিটে। হেরেছিলেন। তার আগেও ২০১৪-তে হেরেছিলেন আরেকটি কেন্দ্র সম্ভালাতে দাঁড়িয়ে। এবারে কি টিকিটের এবং বিজয়ের দিকে তাক করেই সম্ভালাতে কল্কির মন্দির উদ্বোধনে মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ থেকে প্রধানমন্ত্রী মোদিকে ডাকলেন? উত্তর সময় দেবে।

কিন্তু আমাদের দেয়া নেয়ার কথাটা এসেছে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে। তিনি উদ্বোধন করতে এসে সাম্প্রতিক ইলেকটোরাল বন্ড কেলেঙ্কারি নিয়ে খুবই তাৎপর্যময় উক্তি করেছেন। তিনি যা বলেছেন সেকথা আগে লিখি। আচার্য কৃষ্ণাণ বলেছেন, সবারই কিছু না কিছু দেবার থাকে। কিন্তু তাঁর আবেগ ছাড়া কিছু দেবার নেই। যেমন আবেগে এর আগে তিনি কংগ্রেসের রামমন্দিরের উদ্বোধনে অংশগ্রহণ না করার সমালোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, রাম আর রাষ্ট্র এই দুই ক্ষেত্রে কোনো সমঝোতা করা যায় না। প্রধানমন্ত্রীর রামলালার মন্দির উন্মোচনের ভাষণ মনে করিয়ে দিয়ে। তেমন আবেগ আর কী। প্রধানমন্ত্রী কথাটা শুনে খুব খুশী হয়েছেন। তিনি আচার্যকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন, তাঁর আবেগ ছাড়া কিছুই দেবার নেই শুনে। কেন?

কারণ এ এমন এক পাপী সময় যে কৃষ্ণকে এখন যদি সুদামা তিন মুষ্টি চাল দিতেন এবং কৃষ্ণ তা নিচ্ছেন ভিডিও করা থাকত তাহলেই কেউ পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন করে দিত সুপ্রিম কোর্টে। কোর্টরায় দিত কৃষ্ণকে কিছু দেওয়া হয়েছে দুর্নীতি প্রণোদিত হয়ে, কৃষ্ণ-ও নিয়ে দুর্নীতি করেছেন।

এখানে আমাদের অনেকগুলো ভাবার কথা আছে। সে সব কথায় যাবার আগে আমরা কৃষ্ণ-সুদামার এই পৌরাণিক গল্পটা জেনে নিই একটু ছোট করে। গল্পটা ভাগবতে আছে। কৃষ্ণ-সুদামা প্রাণের বন্ধু ছিলেন। একসঙ্গে পড়েছেন গুরুর কাছে। তারপরে দুজনের পথ দুইদিকে চলে গিয়েছে। কৃষ্ণ যখন দ্বারকাধীশ তখন ব্রাহ্মণ সুদামা অত্যন্ত দরিদ্র। তিনি ভগবৎ চিন্তায় মত্ত থাকেন ইত্যাদি। তাঁর স্ত্রী একদিন সুদামার দারিদ্রে ভেঙে যাওয়া শরীর দেখে তাঁকে বললেন কৃষ্ণের কাছে যেতে সাহায্য চাইতে। তিনদিন উপবাসে থেকে তিন মুঠো চাল বাঁচিয়ে কৃষ্ণের কাছে চললেন তিনি। দেখা হল কষ্ট করে অনেক। দেখা হতে কৃষ্ণ তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা করলেন রাজকীয় চালে। আর সুদামা খুব কুন্ঠায় সেই চাল দিলেন। কৃষ্ণ তার থেকে তৃপ্তিভরে দুই মুঠো আহার করতেই রুক্মিনী তাঁকে থামালেন। বাকীদের জন্যও রাখতে বললেন।

যাই হোক, সাক্ষাৎ এবং অভ্যর্থনা পেয়ে তৃপ্ত সুদামা চললেন তাঁর কুঁড়ের দিকে। সেখানে গিয়ে দেখলেন সে কুঁড়ে প্রাসাদ হয়ে গেছে। সেই প্রাসাদ সারাক্ষণ আনন্দে পূর্ণ, যেমন কৃষ্ণের প্রাসাদ। অজস্র দাসদাসী, অতুল সম্পদ ইত্যাদি সবই সুদামাকে দিয়েছেন কৃষ্ণ বন্ধুর দারিদ্রের কথা বুঝতে পেরে। ভক্তিমানেরা বলেন এই হল ভক্তের সঙ্গে ভগবানের সম্পর্ক।

প্রধানমন্ত্রী এর মধ্যে আলতো করে ভিডিও শব্দটি ঢুকিয়ে দিয়েছেন। যদি সুদামা চাল দিচ্ছে ভিডিও করা থাকত? তবেই না পিআইএল হত কোর্টে! ভিডিও নেই, অতএব কোর্টেগিয়ে বিচার চাওয়ার কিছু নেই। কোর্টও বলবে না দুর্নীতি হয়েছে। অর্থাৎ প্রমাণ থাকা চাই যে দুর্নীতি হয়েছে। ভাবনাটা কি তাহলে ইলেকটোরাল বন্ড নিয়ে? ঐ যে বলে না কার মন যেন বোঁচকার দিকে থাকে?

ইলেকটোরাল বন্ডের যে তথ্য এসবিআই দিয়েছে তাতে এখনো সরাসরি কোন দল কার থেকে কত টাকা নিয়েছে তার প্রমাণ জুটছে না। পরোক্ষ প্রমাণ জুটছে। বিশেষজ্ঞরা সেই সব প্রমাণ নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কয়েকটা কথা আমাদের জন্য উদ্ধার করেছেন। আমরা সেই প্রমাণের দিকে যাব না। বরং আমরা একটু ভক্ত, ভগবান আর ধনী-দরিদ্রের সম্পর্কটাকে দেখে নিই। ঐ কৃষ্ণসুদামা গল্প দিয়েই।

সুদামা চাল দিলেন নিজে না খেয়ে থেকে। কেন? তাঁর প্রাণপ্রিয় বন্ধু এবং ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি এবং প্রীতির জন্য। আচ্ছা, ভক্তের হৃদয়ের যে সুষমা তা যথেষ্ট নয় তাহলে ভগবানের জন্য? যাক সে কথাও না হয় থাক, প্রশ্ন হচ্ছে অমন ভগবানের রাজত্বে দরিদ্র থাকে কেন? কেন সবার পেটে খাবার, মাথার উপর ভাল ছাদ, পরার মতো পোশাক ইত্যাদি থাকে না? এ কেমন ভগবান আর ভক্তের দেশ যেখানে এত এত বৈষম্য?

উত্তর দেবার জন্য প্রাচীন গল্পকারেরা আরেকটা গল্প বানিয়েছেন। কর্মফলের গল্প। এসব সুখ-দুঃখ ধন-দারিদ্র যার যার পূর্বজন্মের কর্মফল। ভগবানের সেখানে হাত দেবার দায় নেই। কিন্তু ভগবানই যদি কর্মের কারণও হয় তাহলে যে কর্মের কারণে দুঃখ বা দারিদ্র সেই কর্ম করতে দিয়েছিলেন কেন? এইখানে প্রাচীন গল্পকারের পুঁথি যায় বন্ধ হয়ে। প্রশ্নকারীকে নাস্তিক কিম্বা পাষণ্ড বলে তিনি আসর থেকে উঠে পড়েন।

ভিডিও-র প্রমাণের তো দরকার নেই এ দেশের দারিদ্র দেখার জন্য। প্রধানমন্ত্রী জানেন না নাকি? এত এত দরিদ্র কেন? উত্তরটা প্রধানমন্ত্রী দেবেন না। কারণ যা হচ্ছে তা মোদির এবং মোদিদের নীতির দৌলতে। ইলেকটোরাল বন্ডে টাকা যারা ঢেলেছে তাদের মধ্যে লটারি কোম্পানিও আছে। যাদের কাজ হল দরিদ্র মানুষের সম্পদ লাভের ইচ্ছা নিয়ে খেলাধুলা করা। তাদের সম্পদ উবিয়ে দিয়ে নিজেদের সম্পদ বাড়ানো। তারাই দিয়েছে সবচেয়ে বেশি টাকা। ইডি, সিবিআই ইত্যাদি রেইড হলেও টাকা গিয়েছে কেন্দ্রের শাসকদলে। মানে চাল হাতে করে না আনলে আপনাদের ব্যবস্থা হাতকড়ির। যদি চাল দিয়ে দেয় আপনাদের তাহলেই হাতকড়ি ভ্যানিশ! আরো কত বেড়াল বেরোনো বাকি আছে এখনো। এবং সবচেয়ে বড় ঝুলিটা তো এখনো খোলেইনি। পিএম কেয়ারস ফান্ড, যার তথ্য নাগরিক জানতে পারবে না এমনই আইন।

এই সব আইন করেন কেন প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দল। আপনাদের স্বচ্ছ ভারতে থাকার জন্য স্বচ্ছ ভাবমূর্তির দরকার হয় না কেন? মুখে বলেন না খাউঙ্গা না খানে দুঙ্গা, কাজে মানেন কি না লোক জানতে চাইবে না? তারা তো দেখছে যে দেশের সব সম্পদ কয়েকটি ধনী পরিবারের হাতে চলে যাচ্ছে। আর সাধারণ নাগরিক এখন সুদামার চাইতেও অসহায়। তার জীবন-জীবিকার কোনোরকম নিশ্চয়তা আর নেই। যে কোোন জিনিসের দাম এমন জায়গাতে ঠেকেছে মানুষ নাভিশ্বাস খাচ্ছে। ধর্মের নামে এক সম্প্রদায়কে অন্যের বিরুদ্ধে হিংস্র করে তুলে ভাবছেন তার আড়ালেই সব চাপা দিয়ে দেবেন?

ভিডিও-তে নাই বা ধরা থাকল আপনাদের সন্ত্রাসের কামাই-এর কথা, লোক কিন্তু বুঝছেই। বুঝছে বলে আপনার অস্বস্তি হচ্ছে এত। চারশো পার হওয়ার স্বপ্নটা অতটা শক্তপোক্ত লাগছে না। কারণ আপনি দেখছেন আওয়াজ একটা উঠতে শুরু করেছে ‘চৌকিদারই চোর’ বলে। ইলেকটোরাল বন্ড সে আওয়াজকে জোরদার করছে। তাই আপনি কৃষ্ণ নাম জপছেন। এহে, বাংলায় আরেকটাও প্রবাদ আছে। অতিভক্তি চোরের লক্ষণ। মনে পড়ে গেল।

– শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষ, সহমন ওয়েব পোর্টালে প্রকাশিত

খণ্ড-31
সংখ্যা-10