এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টোরেট বা ইডি গত বৃহস্পতিবার ২১ মার্চ দিল্লীর আপ সরকারের চালু করা আবগারি নীতির ভিত্তিতে চালানো দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করল দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী তথা আপ নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে।
এর আগে আরও দুই আপ নেতা সঞ্জয় সিং ও দিল্লীর প্রাক্তন উপ-মুখ্যমন্ত্রী মণীশ সিসোদিয়াকেও একই অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং তাঁরা এখন জেলে রয়েছেন। প্রসঙ্গত, আপ সরকারের আবগারি নীতি চালু হয় ২০২১ সালের নভেম্বরে এবং ঐ নীতি নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে তা বাতিল করা হয় ২০২২’এর সেপ্টেম্বরে। ইডির অভিযোগ, হায়দ্রাবাদের ওষুধ কোম্পানি অরবিন্দ ফার্মার ডিরেক্টর পি শরৎ চন্দ্র রেড্ডি এবং বিআরএস নেত্রী ও তেলেঙ্গানার পূর্বতন মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের কন্যা কে কবিতার উদ্যোগে গড়ে ওঠা “দক্ষিণী জোট” দিল্লীর মদ ব্যবসার দখল নিতে আপকে ১০০ কোটি টাকা ঘুষ দেয় এবং ঐ আবগারি নীতির ভিত্তিতে “দক্ষিণী জোট” দিল্লীর মদ ব্যবসার অন্তত ৩০ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ পায়। ইডির মতে, কেজরিওয়াল ঐ নীতির চাঁই হওয়ায় তিনি অপরাধের দায় এড়াতে পারেন না।
তবে, কেজরিওয়াল গ্রেপ্তার হওয়ার পরপরই সামনে এল কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য। যাঁর বক্তব্যের ভিত্তিতে ইডি কেজরিওয়ালকে আপ সরকারের মদ নীতির “মূল মাথা” বলে সাব্যস্ত করে। তিনি হলেন উপরে উল্লেখিত শরৎ চন্দ্র রেড্ডি, ইডি যাঁকে এই মামলায় আগে গ্রেপ্তার করেছিল এবং যাঁর জামিনের আবেদনে কোনো আপত্তি জানায়নি। ফলে, জামিনে মুক্ত হয়ে তিনি এখন স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কেজরিওয়াল গ্রেপ্তার হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগেই এসবিআই নির্বাচন কমিশনের কাছে নির্বাচনী বন্ডের আলফা নিউমেরিক্যাল নম্বর বা নির্বাচনী বন্ড চিহ্নিত করার সংখ্যা জমা দেয় এবং তার থেকে দেখা যায় ঐ শরৎ চন্দ্র রেড্ডি এবং তাদের কোম্পানি নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে কয়েক দফায় বিজেপিকে বিপুল পরিমাণ চাঁদা দিয়েছে। এবং কিছু নির্বাচনী বন্ড কেনা হয়েছে শরৎ চন্দ্র রেড্ডি গ্রেপ্তার হওয়ার মাত্র পাঁচ দিন পরই। প্রশ্নটা অতএব খুব স্বাভাবিক ভাবেই উঠছে যে — শরৎ চন্দ্র রেড্ডির প্রতি ইডি তথা মোদী সরকারের কৃপা বর্ষণে মূল ভূমিকা থেকেছে কি নির্বাচনী বন্ডেরই? অন্যভাবে বললে, শরৎ চন্দ্র রেড্ডির ব্যবসা স্থলে ইডির হানাদারি ও তাঁর গ্রেপ্তারিই কি নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে বিজেপির ভাঁড়ারে ৫০ কোটিরও বেশি টাকা জমা হওয়ার নির্ধারক শর্ত হয়ে উঠেছিল?
আলোচ্য ডিরেক্টর ও তাঁর কোম্পানি নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে কবে কত কোটি টাকা চাঁদা বিজেপিকে দিয়েছে সেদিকে তাকানো যাক। ইডি অরবিন্দ ফার্মার ডিরেক্টর শরৎ চন্দ্র রেড্ডিকে গ্রেপ্তার করে ২০২২’এর ১০ নভেম্বর। এর পাঁচ দিন পরই ১৫ নভেম্বর অরবিন্দ ফার্মা বিজেপির জন্য ৫ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড কেনে এবং বিজেপি ঐ বন্ড ভাঙায় ১৭ নভেম্বর। শরৎ রেড্ডির জামিনের শুনানি হয় ২০২৩’এর মে মাসে এবং ইডি জামিনের বিরোধিতা না করায় তাঁর জামিন লাভ অনায়াস হয়। শরৎ চন্দ্র রেড্ডি জামিন পান ২০২৩’এর মে মাসে, এবং তাঁর রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদনের ভিত্তিতে ও সরকারের অনুমোদনে দিল্লীর এক আদালত ঐ বছরের ১ জুন তাঁকে রাজসাক্ষী হওয়ার অনুমতি দেয়। ঐ বছরের, অর্থাৎ ২০২৩ সালের ৮ নভেম্বর অরবিন্দ ফার্মা বিজেপিকে চাঁদা দেওয়ার জন্য আরও ২৫ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড কেনে যে বন্ড বিজেপি ভাঙায় ১৭ নভেম্বর। ঐ ৮ নভেম্বরেই আবার এ পি এল হেলথকেয়ার এবং ইউজিয়া ফার্মা স্পেশ্যালিটিজ নির্বাচনী বন্ডে বিজেপিকে দেয় যথাক্রমে ১০ ও ১৫ কোটি টাকা। এই দুটোই অরবিন্দ ফার্মার অধীনস্থ সংস্থা এবং শরৎ চন্দ্র রেড্ডি আবার এ পি হেলথকেয়ার-এরও ডিরেক্টর। উল্লেখ্য যে, শরৎ চন্দ্র রেড্ডি গ্রেপ্তার হওয়ার আগেও অরবিন্দ ফার্মা ২০২২’এর জানুয়ারি ও জুলাই মাসে বিজেপিকে নির্বাচনী বন্ডে চাঁদা দিয়েছিল যথাক্রমে ৩ কোটি ও ১.৫ কোটি টাকা। গ্রেপ্তারের আগে ও পরে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে দেওয়া চাঁদার পরিমাণের পার্থক্য বিবেচনা করলে এই অনুমান অস্বাভাবিক নয় যে, ইডির হস্তক্ষেপই বিজেপির ভাঁড়ারে বিপুল পরিমাণ চাঁদা যাওয়ার মাধ্যম হয়ে উঠেছিল। ভাষ্যকাররা এখন যেমন বলছেন, ইডির ভয় দেখানোটাকেই তোলাবাজির হাতিয়ার করে তুলেছিল বিজেপি।
কেজরিওয়ালের গ্রেপ্তারি আরও যে প্রশ্নটাকে সামনে আনছে তা হল, ইডি কি তাঁর দুর্নীতির নির্দিষ্ট প্রমাণ পেয়েছে, নাকি স্বেচ্ছাচারিতাই ছিল ঐ গ্রেপ্তারির ভিত্তি। যে ১০০ কোটি টাকার ঘুষের কথা ইডি বলছে এবং যে টাকা আপ গোয়ার নির্বাচনে ব্যয় করেছে বলে তাদের অভিযোগ, তার কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ কি তাদের হস্তগত হয়েছে? প্রদত্ত ঘুষের কোনো টাকা কি কেজরিওয়ালের কাছ থেকে পাওয়া গেছে? শরৎ চন্দ্র রেড্ডির যে বক্তব্যের ভিত্তিতে ইডি তাঁকে দুর্নীতির “মূল মাথা” বলে চিহ্নিত করছে, সেই বক্তব্য কতটা প্রত্যয়যোগ্য? আপ নেত্রী ও কেজরিওয়াল মন্ত্রীসভার সদস্যা অতীশী প্রশ্ন তুলেছেন, “শরৎ চন্দ্র রেড্ডি সুস্পষ্টভাবেই বলেছিলেন যে তিনি কখনই অরবিন্দ কেজরিওয়ালের সঙ্গে দেখা করেননি বা কথা বলেননি এবং আপ-এর সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই। জেলে কয়েক মাস থাকার পর তিনি তাঁর বক্তব্যকে পাল্টেছেন। কিন্তু টাকা কোথায়? টাকা যাওয়ার (কেজরিওয়ালের কাছে) পথচিহ্ন কোথায়?” অতএব, বক্তব্যকে পাল্টে কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুবিধা হওয়ার বক্তব্য শরৎ চন্দ্র রেড্ডির হাজির করার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার নয়। শরৎ চন্দ্র রেড্ডির জামিন লাভ প্রসঙ্গে নির্বাচনী ক্ষেত্রকে স্বচ্ছ করে তোলার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত এনজিও কমন কজ-এর নেত্রী অঞ্জলি ভরদ্বাজ বলেছেন, “২০২৩’এর মে মাসে রেড্ডি দিল্লী হাইকোর্টে জামিনের আবেদন করেন। কোমরে ব্যাথার যুক্তি দেখিয়ে জামিন চাওয়া হলেও ইডি তার বিরোধিতা করেনি। ইডি জামিনে সায় দিয়েছে, এমন কটি মামলা আছে? এর পর রেড্ডি জুন মাসে রাজসাক্ষী হয়ে যান।...” কেজরিওয়ালের গ্রেপ্তারির বৃত্তান্ত এবং আনুষঙ্গিক ঘটনাবলী বিরোধী নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে নরেন্দ্র মোদীর প্রতিহিংসাপরায়ণতাকে, রাজনৈতিক ময়দানে তাদের উদ্যোগকে নিষ্ক্রিয় করে তোলার দুরভিসন্ধিকেই প্রতিপন্ন করছে। সম্প্রতি সামনে আসা নির্বাচনী বন্ড সম্পর্কিত সমাচার মোদীর দুর্নীতি-বিরোধী অঙ্গীকারকেও এক নির্ভেজাল কপটাচার বলেই জানান দিচ্ছে। বেশ কিছু নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে প্রদত্ত চাঁদা দেখাচ্ছে যে, অস্বচ্ছ পথে অর্জিত টাকার প্রাপক কেউ হলে তা কেজরিওয়াল নন, বরং নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি। আর এ সমস্ত কিছুর প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে মোদী কথিত গণতন্ত্রের জননীর বিবমিষার উদ্রেক হচ্ছে, তিনি ক্ষুব্ধও হচ্ছেন!