চলে গেলেন বালির পার্টির অন্যতম নেতা তথা সংগঠক কমরেড রঘুপতি গাঙ্গুলী
raghupathi-ganguly-passed-away

বালির দীর্ঘদিনের একনিষ্ঠ পার্টিকর্মী তথা সংগঠক কমরেড রঘুপতি গাঙ্গুলী গত ১৬ মার্চ সকাল ৬.৩০ মিনিটে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন, মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। কমরেড রঘুপতি গাঙ্গুলীর বামপন্থী আন্দোলনের দীর্ঘ কর্মজীবন শুরু হয় ৬০এর দশকের শুরুর দিকে। তখন তিনি সিপিএমের সাথে যুক্ত ছিলেন। পরবর্তিতে নকশালবাড়ি আন্দোলনের শুরু থেকেই তিনি ঐ আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। ঐ অগ্নিগর্ভ সময় পেরিয়ে জরুরি অবস্থার সময় গোপন পার্টির ব্যবস্থায় পার্টিকে রক্ষা করা, পার্টির গোপন পরিকাঠামোর অঙ্গীভূত হয়ে কষ্টসাধ্য ত্যাগের মধ্য দিয়ে পার্টিকে এগিয়ে নিয়ে চলেন। তাঁর পরিবার এই সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রাজনৈতিক কারণে তাঁকে একাধিক বার জেলে যেতে হয়েছিল। পরবর্তীতে এলাকার কাজে তাঁর ধারাবাহিক অংশগ্রহণ ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগ্রহণ পার্টিকে সমৃদ্ধ করে। শ্রমিক সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠন মহিলা সংগঠন গড়ে তুলতে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

তিনি দীর্ঘদিন হাওড়া জেলা কমিটির সদস্য ছিলেন। বালি-বেলুড় লোকাল কমিটির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন কিছু বছর, এবং পার্টির বালি-বেলুড় লোকাল কমিটির সদস্য ছিলেন আমৃত্যু।

অজাতশত্রু এই মানুষটির সততা ও আদর্শবাদী সাধারণ জীবন যাপনের জন্য দলমত নির্বিশেষে মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধা করত। একই সাথে রাজনৈতিক কর্মী, নাট্যকর্মী এবং সাংস্কৃতিক কর্মী হিসাবে তাঁর বহু বিস্তৃত কর্মজীবন আমাদের প্রত্যেকের কাছে চিরদিনের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

এরই পাশাপাশি স্থানীয় বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথে তিনি যুক্ত ছিলেন। বালির বিভিন্ন গ্রন্থাগার, বালি উৎসব কমিটি, বালি সিনে গিল্ড ও বিভিন্ন নাট্য সংস্থায় তাঁর ছিল অবাধ বিচরণ।

বাড়িতে পড়ে গিয়ে বেশ কিছু দিন শয্যাশায়ী হয়ে থাকার পরে হঠাৎ ১৬ তারিখ ভোরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি না ফেরার দেশে চলে যান।

১৬ তারিখ বেলা বাড়তেই বহু মানুষ ও পার্টির নেতা-কর্মীরা জড়ো হতে থাকে বালির জোড়া অশ্বত্থতলা পার্টি অফিসে। আজীবন কমিউনিস্ট কমরেড রঘুদার শেষ ইচ্ছানুসারে মরণোত্তর ক্ষুদান করা হয় বালী এ্যপেক্স ক্লাবের সহযোগিতায়। পরবর্তীতে তাঁর মরদেহ তাঁর পুরনো বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সিপিআইএম-এর সংগঠন থেকে মাল্যদানের মধ্য দিয়ে তাঁকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। সিনেগিল্ড, বালি উৎসব কমিটি ও নাট্যদল থেকে মাল্যদান করে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হয়।

এর পরে পার্টির সাথীরা তাঁদের প্রিয় কমরেডের মরদেহ বালি পার্টি অফিসে নিয়ে আসা হলে সেখানে রাজ্য পার্টির সম্পাদক কমরেড অভিজিৎ মজুমদার মরদেহে রক্তপতাকা ও মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। পার্টির অনান্য রাজ্য ও জেলা নেতৃবৃন্দ ও পার্টি কর্মীরা মালা দিয়ে তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানান। উপস্থিত ছিলেন রাজ্য সম্পাদক কমরেড অভিজিৎ মজুমদার, কমরেড কার্তিক পাল, হুগলী জেলা সম্পাদক কমরেড প্রবীর হালদার, হাওড়া জেলা সম্পাদক কমরেড দেবব্রত ভক্ত ও এলাকার কর্মী ও নেতৃবৃন্দ। কমরেড অভিজিৎ মজুমদার বলেন যে সারাজীবন ধরে রঘুপতি গাঙ্গুলীর আত্মত্যাগ আমাদের কাছে প্রেরণা স্বরূপ।

কমরেড কার্তিক পাল বলেন যে রঘুপতি গাঙ্গুলী ছিলেন নীরব কর্মী। তিনি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগুলি সম্পন্ন করতেন সেগুলি প্রচারবিহীন ভাবেই থাকত। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

পরবর্তীতে তাঁর মরদেহ আন্তর্জাতিক গানে মুখরিত মিছিলে পৌঁছোয় বালি সাধারণ গ্রন্থাগারে। সেখানে তাঁকে গ্রন্থাগারের সাথীরা শ্রদ্ধা জানান এবং শেষে বালী পাঠক ঘাট শ্মশানে তাঁর মরদেহ দাহ করা হয়।

কমরেড রঘুদা আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন চিরকাল তাঁর অমলিন হাসিমুখ নিয়ে এবং তাঁর সাথে দেখা হবে বারবার প্রত্যয়ী প্রতিস্পর্ধী মিছিলে। কমরেড রঘুদা লাল সেলাম। কমরেড রঘুদা অমর রহে।

----

নীরব বিদায়

একান্ত নীরবে একেবারের জন্যে বিদায় নিয়ে চলে গেল রঘুপতি গাঙ্গুলী গত ১৪ তারিখ সকালে। এখন তার সম্পদ বলতে ছিল বার্ধক্যে জীর্ণ অশক্ত একটি দেহ যা নিয়ে সে টুকটুক করে হেঁটে চলে বেড়াত বালির রাস্তায় অফুরন্ত প্রাণশক্তি ভর করে, কুশল বিনিময় করতো পরিচিতদের সঙ্গে, সেই রঘুপতিকে আর দেখা যাবেনা কাঁধে ঝোলা নিয়ে বই-এর দোকানে, খবরের কাগজ ও পত্র পত্রিকার দোকানে দাঁড়িয়ে থাকতে।

রঘুপতি বরাবরই বামপন্থী রাজনীতির একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে পরিচিত ছিল বালিতে। সিপিআই করতো কিনা জানা নেই তবে একটা সময় সিপিআইএম করতো এবং জেল খেটেছিল, পরে ১৯৬৯এ সিপিআইএমএল তৈরি হলে আশু বিপ্লব কামনায় চলে আসে নকশালবাড়ি পন্থী রাজনীতিতে। রাজনীতির কারণে বাড়ি ছেড়ে আত্মগোপন করে কাটিয়েছে বহুদিন। সত্তরের মাঝামাঝি পার্টি অনেক গোষ্ঠীতে বিভক্ত হলে খোলা সংগঠন ইন্ডিয়ান পিপলস্ ফ্রন্ট এ যুক্ত হয়, আইপিএফ ব্যানারে বালি পৌরসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করে। এই সময়ে বালিতে তৈরি হয় প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংস্থা, রঘুপতি ছিল এর অন্যতম সংগঠক তবে যোগ ছিল গোপন লিবারেশন গোষ্ঠীর সঙ্গে। নব্বইয়ের দশকের শেষদিকে সিপিআইএমএল (লিবারেশন) গোপনীয়তা ঝেড়ে খোলা কাজ করতে শুরু করে তখন থেকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই দলের কর্মী হিসেবে কাজ করে গেছে রঘুপতি। লোকাল কমিটির সম্পাদক ও হাওড়া জেলা কমিটির সদস্য হিসেবে রঘুপতি একটা সময় দলের কর্মীদের অতি প্রিয় হয়ে ওঠে। এতো গেলো রঘুপতির রাজনৈতিক চেতনার একটা ছবি, এবার দেখা যাক তার অন্য ভাবনার আরেক দিক। রঘুপতি গাঙ্গুলি একজন বইপাঠক, বালি শিশু সমিতি ও বালি সাধারণ গ্রন্থাগারের দীর্ঘদিনের পুরনো সদস্য আমাদের রঘুপতি, লাইব্রেরি এলে শুধু বই পাল্টানো নয় অনেকটা সময় কাটিয়ে যেত, বালি সাধারণ গ্রন্থাগার কর্মীসংঘের আজীবন সদস্যও ছিল সে। ভালোবাসতো গান নাটক, একটা সময় অভিনয় করেছে শিশু সমিতি ও অভিনেয়-র নাটকে। বালির প্রায় প্রতিটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার চেষ্টা করতো, সিনেগিল্ডপ বালি ও বালি উৎসব সমিতির উৎসাহী সদস্য ছিল। বালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি বরাবরই প্রগাঢ় শ্রদ্ধা দেখিয়ে গেছে রঘুপতি। বহু পুরনো লিফলেট, হলুদ হয়ে যাওয়া খবরের কাগজের কাটিং, বিবর্ণ হয়ে যাওয়া পাতলা পত্রিকা পরম মমতায় আশ্রয় পেতো রঘুপতির ঝোলায়। পুরনো দিনের যে কোনো বিষয় নিয়ে লিখতে গেলে রঘুপতির সাহায্য নিতেই হোতো, রঘুপতি ছিল যেন বালির মহাফেজখানার এক ক্ষুদ্র নমুনা। রঘুপতি নম্র, রঘুপতি বিনয়ী, রঘুপতি জানতো ভালোবাসতে, জানতো মানুষকে শ্রদ্ধা করতে, ঐতিহ্যকে সম্মান করতে। আর সেজন্যই রঘুপতি বিপ্লবী, রঘুপতি কমিউনিস্ট। রঘুপতি গাঙ্গুলির প্রয়াণ আমাদের অনেককেই বিষন্ন করে দিয়ে গেল।

– অঞ্জন মুখার্জী

খণ্ড-31
সংখ্যা-10