কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন লোকসভা নির্বাচনের নির্ঘণ্ট প্রকাশ করেছেন। ঘোষণার সাথে সাথেই নির্বাচনী বিধি লাগু হয়ে গেছে দেশ জুড়ে। পশ্চিমবঙ্গে ১৯ এপ্রিল থেকে ১ জুন – এই সময়সীমার মধ্যে ৭টি দফায় ভোটপর্ব সমাধা হওয়ার কথা।
এবারের নির্বাচন ভারতের সংবিধানসম্মত মৌলিক অধিকার, গণতন্ত্রের কাঠামো ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ রক্ষার দায়বদ্ধতার প্রশ্নকে সামনে রেখে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। বিগত দশ বছরের নিরঙ্কুশ আধিপত্যে কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় আসীন মোদী-শাহ-নাড্ডা পরিচালিত বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার সংবিধানের বাহিরি কাঠামোকে অক্ষুণ্ণ রেখে তার অন্তর্বস্তুকে দুর্বল করে তুলতে একের পর এক অন্তর্ঘাতমূলক নীতিমালা গ্রহণ করেছে। আরএসএস সহ সংঘ পরিবারভূক্ত ফ্যাসিবাদী সংগঠনগুলির ঈপ্সিত হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যকে পাখির চোখ করে দেশের নাগরিকদের সমস্ত গণতান্ত্রিক আকাঙ্খাকে বুলডোজারের নীচে গুঁড়িয়ে দিতে সচেষ্ট মোদী সরকার। কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপ, বাবরি মসজিদের বিতর্কিত স্থানে রামমন্দির গঠন ও অভিন্ন দেওয়ানী বিধি লাগু করার মাধ্যমে তাদের সাম্প্রদায়িক অ্যাজেন্ডাগুলিকে জনগনের মাথায় চাপিয়ে দিতে তারা সমর্থ হয়েছে। অন্যদিকে দেশের আর্থিক মেরুদন্ডকে দুমড়ে ফেলে স্যাঙাৎ কর্পোরেট পুঁজিপতিদের হাতে দেশের প্রাকৃতিক ও শ্রমসম্পদকে বিলিয়ে দেওয়ার নীতি নিয়েছে। কৃষিক্ষেত্রের কর্পোরেটকরণের লক্ষ্যে কৃষক বিরোধী আইন প্রবর্তন, বনআইন ও খনি আইনের আমূল পরিবর্তন, শ্রমকোডের মাধ্যমে শ্রমদাসত্ব চালু করা, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন দিয়ে সংখ্যালঘু মুসলমান নাগরিকদের রাষ্ট্রহীন করে তোলার প্রচেষ্টা – এসবই ‘বিশ্বগুরু’, ‘হিন্দু হৃদয় সম্রাট’ মোদীজি, অধুনা যিনি রামের অবতারের ভূমিকায় অভিনয় করে চলেছেন, তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারের নজিরবিহীন ‘সাফল্যের’ খতিয়ান।
উপরন্তু ভারতের প্রতিষ্ঠিত বিদেশনীতি’র জোট নিরপেক্ষতার আদর্শকে জলাঞ্জলি দিয়ে প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতাকামী জনতার ওপর সাম্রাজ্যবাদী, সম্প্রসারণবাদী জায়োনিস্ট ইজরায়েলের নির্মম হামলাকে স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে বিজেপি সরকার এক ভুবনব্যাপী ধিকৃত অবস্থান গ্রহণ করেছে।
পেল্লায় মাপের দুর্নীতিতে এই সরকার জগতজুড়ে প্রায় প্রথম স্থানে ‘সমাদৃত’। অতীতে মধ্যপ্রদেশে ব্যাপম নিয়োগ দুর্নীতি, রেড্ডি ভার্তৃদ্বয় ও কর্ণাটকের তদানিন্তন মুখ্যমন্ত্রী ইয়েদুরাপ্পার পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি, অধুনা দিল্লীতে দ্বারকা এক্সপ্রেস হাইওয়ে নির্মাণে বিপুল পরিমাণ দুর্নীতি পেরিয়ে এখন গদী মিডিয়ার বাইরে থাকা সামান্য অংশের সাংবাদিক ও দেশের সর্বোচ্চ আদালতের তৎপরতায় নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে ‘কুইড প্রো কো’ নীতি ( কোনো কিছুর বিনিময়ে অন্য কিছু সুবিধা প্রত্যর্পন) গ্রহন করা হয়েছে। অর্থাৎ যেনতেন প্রকারেন ভীতি প্রদর্শন বা উৎকোচের বিনিময়ে অনৈতিক ব্যবসা পরিচালনা করার ছাড়পত্র প্রদান ও বিনিময়ে বিজেপির অর্থকোষকে প্রবলভাবে পরিপুষ্ট করতে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাকে কাজে লাগানোর কারসাজি আজ প্রকাশ্যে এসেছে।
এই সাধারণ নির্বাচনে বিজেপিকে সর্বৈবভাবে পরাস্ত করার ক্ষেত্রে প্রচার ও প্রত্যয়ের শিথিলতার অর্থ হল ভারতের স্বাধীনতা, জনতার সার্বভৌমত্ব, সংবিধান, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ঘোষিত আদর্শকে ধ্বংসকারী ক্ষমতার মদমত্ততাকে আরও বেশি সর্বনাশী, বিপর্যয়কারী ভূমিকায় দেখতে পাওয়া।
বিজেপিকে পরাস্ত করতে তাই গণতন্ত্রপ্রেমি, শ্রমজীবী, মেধাজীবী, পেশাজীবী, ছাত্র-যুব, কৃষক-শ্রমিকদের মধ্যে বিজেপি-আরএসএসের সর্বগ্রাসী রাজনৈতিক প্রকল্পের সারবস্তু সহজভাবে তুলে ধরাই এখন আমাদের একমাত্র কাজ হিসাবে দ্ব্যর্থহীন প্রত্যয়ে গ্রহন করতে হবে।
বাংলার এখনকার রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তে বিরোধী ও শাসক রাজনৈতিক দলগুলির ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা দূর অস্ত্। বরং শাসক তৃণমূলের বাহুবলীদের সাম্প্রতিকতম দুর্নীতি ও সন্ত্রাসী দাপটের ভূমিকাগুলি বাংলার ভোটারদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সাম্প্রতিক সময়ে সন্দেশখালিতে তৃণমূলের স্থানীয় নেতাদের জমি-ভেড়ি দখলদারি, নারী নিপীড়ন ও প্রশাসনের প্রশ্রয়ে নিরঙ্কুশ সন্ত্রাস অব্যাহত রাখা, গার্ডেনরিচে তৃণমূল আশ্রিত প্রোমোটারের নির্মীয়মান বহুতলের ভেঙে পড়া অংশের নীচে চাপা পড়ে বস্তিবাসী গরিব মানুষদের প্রাণহানির ঘটনা এবং এই সমস্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে বৃহত্তর জনমানসে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচনী প্রচারে তৃণমূলকে কোনোমতেই ছাড় দেওয়া সম্ভব নয়। আবার গোদী মিডিয়ার একপেশে প্রচার বিজেপির জনবিরোধী চরিত্রকে লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতে বহুলাংশেই সমর্থ।
পক্ষান্তরে, সিপিএম সহ বাম শিবিরের একপেশে তৃণমূল বিরোধিতা শুধু নয়, সেই সঙ্গে দিদি-মোদী আঁতাতের বস্তাপচা তত্ত্বপ্রচারের মাধ্যমে প্রকারান্তরে বাম ভোটারদের কাছে শাসক তৃণমূলের অত্যাচারের বিপক্ষে বিজেপির সক্ষমতাকে পরোক্ষে মান্যতা প্রদর্শনের নীতি অপর এক বিভ্রান্তিকর অবস্থানকে সূচিত করছে।
এমতাবস্থায় বাংলার অন্যত্র সিপিএম বা বামফ্রন্টের অন্যান্য শরিকদলগুলির প্রার্থীদের ঢালাও সমর্থনের এই মুহূর্তে কোনো বাস্তবতা নেই।
এমন একটি সঙ্কটপূর্ণ রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে বিপ্লবী বামপন্থী কর্মীবাহিনীকে নীতিনিষ্ঠভাবে জনগণের কর্মিষ্ঠ ও গণতান্ত্রিক অংশকে বিজেপি বিরোধিতায় উদ্দীপ্ত করে তোলা ও ভোটারদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার ওপর নির্ভরশীল থেকেই নির্বাচনী প্রচারকে সর্বত্র তুঙ্গে তুলে ধরতে হবে। বিজেপিকে পরাস্ত করা যখন দেশের সামনে এক কেন্দ্রীয় কর্তব্য হয়ে উঠছে তখন তাকে পালন করতে আমরা বাংলার মানুষের বিচার বিবেচনার ওপর ভরসা রাখি।