আবার মহানগরে বেআইনি বহুতল নির্মাণ ভেঙে পড়ল তাসের ঘরের মতো। কেড়ে নিল গরিব বস্তিবাসীর প্রাণ। আবার সেই পুরাতন অভিযোগ — এই বেআইনি কর্মকাণ্ড চলছিল গত একবছর ধরে, স্থানীয় কাউন্সিলার, পুলিশ প্রশাসনের নাকের ডগায়। শাসক পার্টির অনুগামী প্রোমোটার এই বেআইনি বহুতল নির্মাণ চালিয়ে যাচ্ছিলেন জলাশয় বুজিয়ে। দুর্ঘটনার অব্যবহিত পরেই এলাকায় তীব্র ক্ষোভের মুখে পুলিশ প্রোমোটারকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হয়। ধরানো হয় তিন পৌর ইঞ্জিনিয়ারকেও কারণ দর্শনোর নোটিশ। গার্ডেনরিচের ফতেপুর ব্যানার্জিপাড়া লেনে ঝুপড়ির ওপর ভেঙে পড়ায় এ পর্যন্ত প্রায় ১০ জন গরিব, ঝুপড়িবাসীর প্রাণ গেছে। ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে আহত হয়েছেন অনেকে। এখনও চলছে উদ্ধার কাজ।
খোদ মেয়রের খাসতালুকে পুর আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অবাধে পুকুর ভরাট করে, বা নির্মাণ কাজের অন্যান্য বিধিকে অমান্য করে ওই এলাকায় একের পর এক গজিয়ে ওঠে বহুতল, যার দায় মেয়র অস্বীকার করতে পারেন না। এই বিষয়টা যে কলকাতা পৌরসভার সর্বোচ্চ স্তরে, বা বিভিন্ন দপ্তরের অজানা ছিল, তাও নয়। এক্ষেত্রেও ক্ষমতাসীন দলের সাথে অভিযুক্ত প্রোমোটার ও স্থানীয় কাউন্সিলার-প্রশাসনের অশুভ আঁতাত থাকায় ওই সমস্ত বেআইনি কাজকর্মগুলোকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়। বিগত বাম জমানা থেকেই কলকাতায় জলা জমি বুজিয়ে, পরিবেশ সংক্রান্ত বিধিকে লঙ্ঘন করে পরিকল্পনাহীন, অবৈজ্ঞানিক ও অবৈধ রিয়াল এস্টেট ব্যবসা যে প্রোমোটার চক্র চালিয়ে আসছে, তার উপর আজও লাগাম টানা গেল না। রাজনৈতিক পালাবদলের সাথে সাথে ওই প্রোমোটার বাহিনী নিজেদের রঙ পালটায়, রাজনৈতিক আশ্রয়প্রাপ্ত ওই দুষ্টচক্র ক্ষমতার ছত্রছায়ায় থেকে ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এখন পুরসভার কর্তাব্যক্তিরা এই ঘটনায় একে অপরের উপর দায় ঠেলে দিচ্ছেন। সমস্ত অন্যায় অপরাধের জন্য বিগত বাম জমানাকে দায়ী করে মেয়র নিজের হাত ধুয়ে ফেলার মরিয়া প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।
জলাশয় বুজিয়ে, পরিবেশ ও নির্মাণ বিধি অমান্য করে শুধু বহুতল বানানোই নয়, নগরায়ণের যে মডেল অনুসৃত হচ্ছে তা গরিব, মধ্যবিত্ত মানুষকে ক্রমে ক্রমেই এই মহানগর থেকে নীরবে উৎখাত করে দিচ্ছে। জলস্তর ক্রমেই নীচে নেমে যাচ্ছে, আর্সেনিক আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। বেঙ্গালুরুর মতো আধুনিক এক প্রযুক্তি নিবিড় শহরকে সম্প্রতি নজিরবিহীন যে জলসংকট গ্রাস করেছে, তা আগামী দিনে সমস্ত শহরের ক্ষেত্রে বিরাট এক বিপদের বার্তা বহন করে।
এই শহরকে রক্ষা করার জন্য কলকাতাবাসীকে গড়ে তুলতে হবে এক নাগরিক আন্দোলন। গরিব-নিম্নবিত্ত মানুষকে স্থানচ্যুত করে ধনী, অত্যন্ত বিত্তবানের কব্জায় কলকাতার চলে যাওয়া ঠেকাতে হবে। ক্রমে লুপ্ত হওয়া সবুজকে ফিরিয়ে কলকাতার দূষণ ও পরিবেশ প্রশ্নে নাগরিক সচেতনতার কাজও শুরু করা দরকার। সমস্ত আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এই শহরটিকে ক্ষমতাসীন দলের মদতপুষ্ট প্রোমোটারদের অবাধ মৃগয়া ক্ষেত্রে রূপান্তরিত হতে দেওয়া চলবে না।