প্রায় প্রতিদিন নির্বাচনী বন্ড সংক্রান্ত নানান তথ্য উঠে আসছে অনেক বড় বড় প্রশ্নচিহ্ন ঝুলিয়ে। কিভাবে কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলোকে ব্যবহার করেছে মোদী-অমিত শাহ’র সরকার তাদের দলীয় তহবিল ভরাতে, কিভাবেই বা অবৈধ, অস্বচ্ছ, অন্যায় পদ্ধতিতে সরকারি বরাত পাইয়ে সংস্থাগুলোর কাছ থেকে মোটা টাকা আদায় করা হয়েছে, তার ভূরি ভূরি তথ্য এখন প্রকাশ পাচ্ছে। এখন, এই তথ্য বেরিয়ে এল, পর পর তিন বছর লোকসানে চলা সত্ত্বেও বেশ কিছু সংস্থা বিজেপির নির্বাচনী তহবিলে ঢালাও অনুদান দিয়েছে।
দেখা যাচ্ছে, প্রথম সারির এমন ২০০টি সংস্থার মধ্যে অন্তত ১৬টি সংস্থা নির্বাচনী বন্ড কিনেছে যাদের সংস্থাগুলি লোকসানে চলছে। লোকসানে চলা এমন সংস্থাগুলি রাজনৈতিক দলগুলোকে ৭১০ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে, যার মধ্যে ৪৬০ কোটি টাকার ও বেশি (৬০ শতাংশের বেশি) পেয়েছে বিজেপি। সংস্থার শেয়ারহোল্ডারদের কপালে এক কানাকড়িও না জুটলে গোপন পথ ধরে রাজনৈতিক দলগুলো পেয়েছে মোটা অঙ্কের তহবিল।
২০১৭ সালে চারটে আইনকে সংশোধন করে বিজেপি সরকার প্রথম যখন নির্বাচনী বন্ড সংক্রান্ত স্কিম পেশ করে তখনই তদানিন্তন নির্বাচন কমিশন ও রিজার্ভ ব্যাঙ্ক আশঙ্কা প্রকাশ করে যে এর ফলে বিভিন্ন ভূয়ো শেল কোম্পানি তাদের কালো টাকা বন্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর তহবিলে চালান করে দেবে।
বিজেপি আইনের সংশোধন নিয়ে আসার আগে যে নিয়ম ছিল, তা হল, বন্ড কেনার তিনটি অর্থবর্ষ আগে গড় মুনাফার ৭.৫ শতাংশ পর্যন্ত তারা দান করতে পারে। অর্থাৎ, কোনো একটি সংস্থা যদি পর পর তিন বছরে ১০০ লাভ করে থাকে, তবে চতুর্থ বছরে সে সর্বাধিক ৭.৫ শতাংশ দান করতে পারবে। কোনো সংস্থা যদি লাভের তুলনায় অনেক বেশি টাকার বন্ড কেনে তা হলে বুঝতে অসুবিধে হয় না যে চোরা পথে সেই টাকা এসেছে। ২০১৭ সালের কেন্দ্রীয় বাজেটে মোদী সরকার কোম্পানি আইনের এই ধারাটি তুলে দেয়।
কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক : টেলিকম সংস্থা ভারতী এয়ারটেল এই তালিকার শীর্ষে রয়েছে। ২০২০-২১ এবং ২০২২-২৩’র অর্থবর্ষে এই সংস্থাটি গড় লোকসান হয় ৯,৭১৬ কোটি টাকা। আগেকার অর্থবর্ষে পর পর আর্থিক লোকসান হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক দলগুলিকে এয়ারটেল দিয়েছে ১৯৭.৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিজেপিকে দিয়েছে ১৯৭ কোটি টাকা, আর ৫০ লক্ষ ন্যাশনাল কনফারেন্স ও ১০ লক্ষ জুটেছে আরজেডি’র কপালে।
ডিএলএফ কমার্শিয়াল ডেভেলপার্স লিঃ ২০১৯-২০’র অর্থবর্ষে ২০ কোটি টাকা দিয়েছে যদিও ওই একই অর্থবর্ষে তার লোকসান হয় ২১০ কোটি টাকা। এই সংস্থাটি মোট ১৩০ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড কেনে যার সবটাই গেছে বিজেপির সিন্দুকে।
লোকসানে চলা ১৬টির মধ্যে এগুলো ছাড়া আরও ৩১টি সংস্থা রয়েছে যারা তাদের বিগত তিন বছরের গড় মুনাফার তুলনায় বহুগুণ বেশি অনুদান দিয়েছে। কলকাতা স্থিত মদ বিক্রেতা সংস্থা ক্যাশেল লিকার প্রাইভেট লিঃ গত তিনবছরে গড়ে মাত্র ৬ লক্ষ লাভ করলেও ৭.৫ কোটি টাকা দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোকে যা ১১৮ গুণ বেশি! এর প্রায় ৯০ শতাংশ অর্থাৎ ৬.৮ কোটি টাকা বিজেপি পেয়েছে আর বাদবাকি ৭০ লক্ষ টাকা গেছে আরজেডি’র পকেটে।
২০২৩ এপ্রিল থেকে মোট চারটে কিস্তিতে এই টাকা ওই সংস্থাটি দিয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষের হিসাব না পেলেও দেখা যাচ্ছে ঠিক তার আগের বছরে এই সংস্থাটি মাত্র ১২ লাখ টাকা লাভ করেছে। আগের তিন বছরে এই সংস্থাটির লাভের পরিমাণ যথাক্রমে ৫ লাখ, ২ লাখ ও শূন্য!
দেশে লটারি ব্যবসার ‘মুকুটহীন সম্রাট’ সান্টিয়াগো মার্টিন ফিউচার গেমিং এবং হোটেল সার্ভিস প্রাইভেট লিঃ সর্ববৃহৎ অঙ্কের নির্বাচনী বন্ড কিনেছে — গত তিন বছরের গড় মুনাফার ১৬ গুণ বেশি! এই সংস্থাটি মোট ১৩৬৮ কোটি টাকার বন্ড কিনেছে যার মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছে ৫৪০ কোটি টাকা, ৫০৯ কোটি ডিএমকে, ১৫৯ কোটি ওয়াইএসআর কংগ্রেস, ১০০ কোটি বিজেপি, ৮০ লক্ষ সিকিম ক্রান্তিকারী মোর্চা এবং ৫০ লক্ষ সিকিম ডেমোক্রাটিক ফ্রন্ট।
একই ভাবে, রিল্যায়েন্সের কুইক সাপ্লাই চেন তৃতীয় বৃহত্তম দাতা হিসাবে সামনে উঠে এসেছে, যারা তাদের লাভের তুলনায় ১৫ গুণ বেশি দান করেছে। এই সংস্থাটি দিয়েছে ৩৭৫ কোটি টাকা (৯০ শতাংশের বেশি) বিজেপিকে, ২৫ কোটি টাকা শিবসেনা’কে আর বাদবাকি ১০ কোটি এনসিপি’কে।
প্রথম ১০টি দাতার মধ্যে রয়েছে কলকাতা ভিত্তিক কেভেন্টার গ্রুপের মদনলাল কোম্পানি লিঃ। তারা তাদের গত তিন বছরের গড় মুনাফার তুলনায় ৫৬ গুণ বেশি দান করেছে রাজনৈতিক দলগুলোকে। ২০১৯-২০’র অর্থবর্ষে তারা ১৮৫.৫ কোটি দিয়েছে, যার মধ্যে বিজেপির তহবিলে ঢুকেছে ১৭৫.৫ কোটি আর অবশিষ্ট ১০ কোটি কংগ্রেসের পকেটে।
তথ্য ঋণ : রিপোর্টার্স কালেক্টিভ,
২২ মার্চ, ২০২৪
এত হিংস্র, এত প্রতিশোধ পরায়ণ কেন্দ্রীয় শাসককে দেশবাসী আগে কখনও দেখেনি। নিজের দলীয় তহবিলে বিপুল টাকা আদায়ের জন্য মোদী সরকার কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলোকে লেলিয়ে একের পর এক কর্পোরেট সংস্থার তল্লাশি ও হয়রানি করিয়ে যে ঘোর অপরাধ করছে, সেই কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলোকেই বিরোধীদের দমনের হাতিয়ারে পরিণত করল মোদী সরকার। ঝাড়খন্ডের মুখ্যমন্ত্রীর পর দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেপ্তার করল দুর্নীতির অভিযোগে, আপ’এর দলীয় অফিস সিল করে দেওয়া, মহুয়া মৈত্র’র বাড়ি সহ দলীয় কার্যালয়ে হানা ও তল্লাশি দেখিয়ে দেয় বিরোধী দমনে গণতন্ত্রকে পুরোপুরি হত্যা করতে কী মারাত্মক মরিয়া হয়ে উঠেছে মোদী সরকার ঠিক নির্বাচনের আগে। শুধু তাই নয়, শতাব্দী প্রাচীন পার্টি কংগ্রেসের দলীয় তহবিল ফ্রিজ করে দেওয়ার পেছনে রয়েছে আর্থিকভাবে ওই দলটিকে পঙ্গু করার ভয়ঙ্কর দুরভিসন্ধি। এদিকে, দুর্নীতিগ্রস্ত বিজেপির একজন নেতার ঘরেও কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলোকে কড়া নাড়তে দেখা যাচ্ছে না। বরং ওই সম্ভাবনা থাকলেই তারা বিজেপিতে যোগ দিয়ে সমস্ত তদন্ত অনুসন্ধান থেকে পার পেয়ে যাচ্ছে।
দেশের সংবিধানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুমড়ে মুছড়ে, কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলোর গলায় বকলশ পরিয়ে এবার দেখা গেল দেশের বৃহত্তম ব্যাঙ্ক — স্টেট ব্যাঙ্ককে অনুগত প্রজা বানিয়ে নির্বাচনী বন্ড সংক্রান্ত তথ্য চেপে রাখার নোংরা খেলায় শরিক বানিয়ে ফেলল। নেহাত সুপ্রিম কোর্টের ধমকের পর স্টেট ব্যাঙ্ক সুড়সুড় করে সব তথ্য নির্বাচন কমিশনের কাছে তুলে দিতে বাধ্য হল।
যে তথ্যগুলো প্রকাশ করতে জুন মাসের ৩০ তারিখ পর্যন্ত স্টেট ব্যাঙ্ক সময়সীমার আবেদন করে, দেখা গেল তা উদ্ধার করতে সময় লাগে কয়েকটা মিনিট মাত্র! বন্ডগুলোর সাথে যে ইউনিক আল্ফা নিউমেরিক নম্বর ছিল স্টেট ব্যাঙ্কের আস্তিনে, তাকেও অন্যায় ভাবে কাজে লাগিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। প্রতিটি বন্ড কেনার ১৫ দিনের মধ্যে তা ভাঙানোর শেষ সময়সীমা এসবিআই নির্দিষ্ট করে দেয়। কিন্তু দেখা গেল বেশ কিছু বন্ড সেই নির্দিষ্ট মেয়াদের পর ভাঙানো হয়েছে, যা দেখিয়ে দেয় এ প্রশ্নেও বিজেপি সরকার পুরোপুরি অন্যায় সুযোগ নিয়েছে, স্টেট ব্যাঙ্কের নিয়ম লঙ্ঘন করে।
নিজেদের হাজারো কুকর্ম ও দুর্নীতিকে পুরোদমে চালাতে ও বিপরীতে বাছাই করে বিরোধীদের দমন করতে কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলোকে ব্যবহার করা, নাগরিক সমাজের উপর নামিয়ে আনা হামলা, প্রতিবাদ — ভিন্ন স্বর ও বিরোধী মতামতকে কণ্ঠরুদ্ধ করা, গোটা দেশকে জেলখানায় পরিণত করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে আপাদমস্তক এক ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম করল মোদী সরকার। সাংবিধানিক গণতন্ত্র আজ ফ্যাসিবাদের পায়ের তলায় ক্ষতবিক্ষত, মুমূর্ষু।
এর বিরুদ্ধে গোটা দেশকে রুখে দাঁড়াতে হবে ঘোর তমসাচ্ছন্ন নিথর রাত্রি ঘনিয়ে ওঠার আগে।
এসবিআই ইলেক্টোরাল বন্ড নিয়ে যেসর তথ্য পেশ করেছে, তা অসম্পূর্ণ হলেও, অধুনা বাতিল অসাংবিধানিক প্রকল্পটিকে ঘিরে এক বিরাট সন্দেহজনক বাতাবরণকে ইতিমধ্যেই উন্মোচিত করেছে। সেখানে বেশ কিছু বেনিয়ম আর ফাঁকফোকর রয়েছে, বিশেষ করে ‘ইউনিক’ বন্ড নাম্বারগুলোর ব্যাপারটা — যা এসবিআই প্রকাশ করেনি। যে কারণে এখনও নির্দিষ্ট দাতা-গ্রহীতা সংযোগ নির্ণয় করা যায়নি। অবশ্য একবার যদি এসবিআই-কে ঐ চেপে রাখা ও ‘হারিয়ে ফেলা’ তথ্যগুলো বিশদে প্রকাশ করতে বাধ্য করা যায়, ঐ যোগসূত্রগুলো সম্পর্কে জানা যাবে। কিন্তু যে নমুনাটুকু প্রকাশ্যে এসেছে, তাতেই বলা যায়, নির্বাচনী বন্ড প্রকল্প মোদী সরকারের সবচেয়ে বেপরোয়া, নির্লজ্জতম এক দুর্নীতি। স্কিমের মধ্যেই তৈরি করা হয়েছে নামহীনতা ও গোপনীয়তার সুযোগ। আর তাকে কাজে লাগিয়ে সরকার যথার্থই এটিকে জুলুম চালানোর এক অবৈধ চক্র হিসেবে ব্যবহার করে বিভিন্ন কোম্পানিকে ভয় দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়েছে। আর প্রতিদানে দাতারাও আইনি সুরক্ষাসহ নানা লোভনীয় প্রকল্প আর কনট্রাক্ট হাতে পেয়ে গেছে।
এই মুহূর্তে, বন্ড ক্রেতাদের তালিকায় তিনটি বড় কর্পোরেট সংস্থার সরাসরি উপস্থিতি চোখে পড়বে না। অনুসন্ধানকারী সাংবাদিকরা বন্ডগুলোকে ট্র্যাক করে অবশ্য ৪০০ কোটি টাকার বেশি মূল্যের বন্ডে আম্বানিদের উপস্থিতি ধরে ফেলেছেন। টাটারা রাজনৈতিক চাঁদা দেওয়ার ক্ষেত্রে সম্ভবত নিজেদের ট্রাস্টের (প্রোগ্রেসিভ ইলেক্টোরাল ট্রাস্ট) মাধ্যমই পছন্দ করে। আর আদানির সংযোগ সম্ভবত শেল কোম্পানি ও অন্ধকারাচ্ছন্ন দাতাদের স্তরের নিচে লুকিয়ে আছে। অন্য শীর্ষস্থানীয় কর্পোরেট সংস্থাগুলো অবশ্য তালিকায় খানিকটা স্পষ্টভাবেই বিদ্যমান। শীর্ষস্থানীয় দাতারা অবশ্য নিজেরাই উন্মোচিত, ভারতের ক্রমবর্ধমানভাবে অসৎ আর বেপরোয়া হয়ে ওঠা স্যাঙাৎ পুঁজির নিচের দিকে তাদের অবস্থান। ইলেক্টোরাল বন্ড কিনতে কোম্পানিগুলো যে টাকা খরচ করেছে তা করমুক্ত, কিন্তু আসল সুবিধেটা রয়েছে, অবৈধ লেনদেনের বোঝাপড়ার (কুইড প্রো কো — “এটার জন্যে ওটা” অর্থাৎ একটার বিনিময়ে আরেকটা) মধ্যে, কেনা বন্ড এবং পাওয়া কনট্রাক্ট-এর পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে, যে লেনদেনে আইনকে বুড়ো আঙুল দেখানো হয়েছে এবং সমস্ত অর্থনৈতিক অপরাধের জন্যে শাস্তিকেও এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
২০১৭-২০২২ আর্থিক বর্ষে রাজনৈতিক দলগুলোর দাখিল করা আয়কর রিটার্ন এবং নির্বাচনী বন্ডের নগদ রূপান্তর সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনের প্রকাশিত সর্বশেষ পর্যায়ের তথ্য (যা ২০২৩ আর্থিক বর্ষের আয়কর রিটার্নে প্রতিফলিত হবে) মিলিয়ে দেখলে পরিষ্কার বোঝা যাবে রাজনৈতিক দলগুলির নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে মোট কত আয় হয়েছে। এই সামগ্রিক ছবির ভিত্তিতে, বিজেপি মোট ১৬,৫৯২ কোটি টাকার অর্থ মূল্যের ৫০ শতাংশেরও বেশি, ৮২৫২ কোটি টাকার বন্ড থলিতে পুরেছে। মোট ১৯৫২ কোটি টাকার বন্ড পেয়ে দ্বিতীয় হলেও অনেক পিছনে আছে কংগ্রেস। আর ১৭০৫ কোটি টাকার বন্ড পেয়ে তৃতীয়স্থানে আছে তৃণমূল-কংগ্রেসের সামান্য পিছনে। বিআরএস ১৪০৮ কোটি এবং বিজেডি ১০২০ কোটি টাকার বন্ড পেয়ে যথাকারমে চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে আছে।
অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুর্নীতিকে বৈধতা দিতেই বিজেপি একটা অসাংবিধানিক প্রকল্পকে চাপিয়ে দিয়েছে — সুপ্রিম কোর্টের এই অভিযোগের উত্তর দেওয়ার পরিবর্তে বিজেপি এখন এই নির্বাচনী বন্ড কেলেঙ্কারিকে উড়িয়ে দিতে ব্যস্ত। তার দাবি আসলে বিরোধী দলগুলোর থেকে সে নাকি অনেক কম টাকা পেয়েছে! তার আরও যুক্তি, দলটি যে টাকা পেয়েছে তা আসলে তার নির্বাচনী শক্তির অনুপাতেও কম। বিজেপি’র আইটি সেল মানুষকে ভুল বোঝানোর জন্যে সরাসরি মিথ্যা পরিসংখ্যান প্রচার করছে। আসলে যেটা বুঝতে হবে — নির্বাচনী বন্ড স্কিম কর্পোরেট সংস্থাগুলোর বড় পার্টিগুলোকে টাকা দেওয়ার প্রচলিত ব্যবস্থার বিষয়টাকে মাত্রাগত ও তহবিলের প্রকৃতিগত (বিদেশি অর্থাগম থেকে শুরু করে শেল কোম্পানিগুলির মাধ্যমে বেআইনি টাকা পাচার পর্যন্ত সমস্ত অস্বচ্ছ সূত্র সহ) — উভয় প্রশ্নেই এক সম্পূর্ণ নতুন স্তরে নিয়ে গেছে আর সেই সঙ্গে ন্যায়সঙ্গত পরিস্থিতির ধারণাটিকেও (যেখানে সবার সমান সুযোগ থাকবে) সম্পূর্ণ ধ্বংস করেছে।
নির্বাচনী বন্ড স্কিমের অসাংবিধানিকতা এটির চরম অস্বচ্ছতা ও অসামঞ্জস্যের মধ্যেই নিহিত আছে। যা clientelism’কে প্রতিষ্ঠানিক করে তুলেছে আর দুর্নীতিকে আগলমুক্ত করেছে। স্যান্টিয়াগো মার্টিনের ফিউচার গেমিং অ্যান্ড হোটেল সার্ভিসেস কোম্পানিতে ধারাবাহিক ইডি হানা এমনকি সম্পত্তির আটকের পরপরই সেটির ধারাবাহিক ভাবে নির্বাচনী বন্ড কেনা প্রমাণ করে দেয় এই স্কিমের সম্পূর্ণ সন্দেহজনক প্রকৃতির (মার্কি নেচার)। এসবিআই-এর তথ্য দেখাচ্ছে, সামান্য আদায়কৃত মূলধন ও লাভ সম্পন্ন কোম্পানিগুলো তাদের জ্ঞাত আর্থিক শক্তির বেশ কয়েক গুণ বেশি টাকা দিয়ে নির্বাচনী বন্ড কিনেছে। আর সরকার যখন জানে কোন কোম্পানির কোন দলকে কত টাকা দিচ্ছে, আম জনতা এবং বিরোধীদলগুলো তহবিলের প্রবাহ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রয়েছে। তথ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং ইডি, সিবিআই এবং কর-কর্তৃপক্ষ থেকে এমনকি ব্যাংক ব্যবস্থা পর্যন্ত, বিভিন্ন এজেন্সির অপব্যবহার — স্কিমটিকে সম্পূর্ণ ভাবে বিজেপি’র অনুকূলে চালিত করেছে, যদিও কয়েকটি বড় রাজ্যে ক্ষমতাসীন (যেমন টিএমসি, বিআরএস, বিজেডি, ডিএমকে, ওয়াইএসআরসিপি) দলগুলোরও বেশ বড়সড় অংশ রয়েছ। কর্পোরেট তহবিল এবং নির্বাচনী বন্ডের কাদা থেকে মুক্ত একমাত্র কম্যুনিস্ট এবং অন্যান্য বাম দলগুলো।
নির্বাচনী বন্ড, কর্পোরেট রাজনৈতিক তহবিলের অনেক উৎসের মধ্যে মাত্র একটি। এই সন্দেহজনক স্কিমটি চালু করার আগে নির্বাচনী ট্রাস্ট ছিল বৈধ চাঁদা দেওয়ার মুখ্য মাধ্যম (নির্বাচনে কী পরিমাণ অবৈধ অর্থের যোগান এবং ব্যবহার হয় সকলেরই জানা)। বেশ কয়েক বছর ধরে এই ট্রাস্টও বিজেপি’র দিকেই ক্রমশ ঝুঁকেছে। সবচেয়ে বিত্তশালী নির্বাচনী ট্রাস্ট প্রুডেন্ট ইলেকটোরাল ট্রাস্ট ২০১৭’র আর্থিক বছরে তার চাঁদার ৯৫ শতাংশই বিজেপিকে দিয়েছিল। সেই থেকে তার তহবিলের ৮৫ শতাংশই বিজেপির ঝোলায় পড়ে। ২০২৩’এর আর্থিক বছরে পাঁচটি ট্রাস্ট মিলে রাজনৈতিক দলগুলোকে মোট ৩৬৬ কোটি টাকা চাঁদা দিয়েছে যার মধ্যে বিজেপি একাই পেয়েছে ২৫৯•০৮ কোটি টাকা। ২০১৯’এর নির্বাচনের আগে, ২০১৮’র আর্থিক বছরে টাটারা তাদের প্রোগ্রেসিভ ইলেকটোরাল ট্রাস্টের মাধ্যমে বিজেপিকে দিয়েছিল ৩৫৬ কোটি টাকা আর কংগ্রেস পেয়েছিল মাত্র ৫৫ কোটি টাকা। এইসব রাজনৈতিক চাঁদা ছাড়াও, বিজেপি’র আয়ত্তে আছে সরকারি বিজ্ঞাপনের ক্রমবর্ধমান বাজেট এবং বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প যার সবগুলোই মোদী ব্র্যান্ড বেচাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। সরকারি বিজ্ঞাপন আর বিজেপি’র নিজস্ব দলীয় প্রচারের মধ্যে কোন ফারাক নেই। আর এসব এখন শুধু খবরের কাগজ, রেডিও ও দূরদর্শনের চ্যানেলে আটকে নেই, প্রতিটি জনপরিসর এবং প্রতিটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম প্লাবিত করে ফেলছে। এর পর আছে কোভিড অতিমারীর মুখে চালু হওয়া অতিকায় এক অস্বচ্ছ তহবিল যার সংক্ষিপ্ত নাম পিএম কেয়ারস। এই তহবিল তৈরি হয়েছিল রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি এবং বেসরকারি কর্পোরেশনগুলোর মোটা চাঁদা থেকে। শুধু তাই নয়, এই তহবিল নিজেকে গণ পরিসরের কোনো সমীক্ষা বা অনুসন্ধানের আওতাবহির্ভূত বলে মনে করে, কারণ এটা নাকি ব্যক্তিগত ব্যাপার!
মোদী জমানা সমস্ত সম্ভাব্য ভ্রষ্টাচার, অসাংবিধানিক এবং অনৈতিক উপায়কে ব্যবহার করে বিজেপি’র ধনাগার উপচে পড়ছে। লুট আর মিথ্যা, ঘৃণা আর সন্ত্রাসের এই দুর্নীতিগ্রস্ত অত্যাচারী শাসনকে শেষ করার জন্য ভারতীয় জনগণকে ভোটের সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে এই রাজত্বের কফিনে শেষ পেরেকটা পুঁতে দিতে হবে!
(এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ১৯ মার্চ ২০২৪)
কেজরিওয়াল, হেমন্ত সোরেন, মণীষ সিসোদিয়া, সঞ্জয় সিং এবং অন্যান্য বিরোধী নেতৃবৃন্দকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে!
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী (সিপিআইএমএল) তথাকথিত আবগারি কেলেঙ্কারির অভিযোগে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টোরেট-এর (ইডি) হাতে দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়ালের গ্রেপ্তারির তীব্র নিন্দা করছে। দেশে বিরোধী ও গণতান্ত্রিক কণ্ঠস্বরের দমনে মোদী সরকারের লাগামহীন জরুরি অবস্থা ও অভিসন্ধির আর এক অধ্যায় রূপে দেখা দিচ্ছে এই গ্রেপ্তারি।
ঝাড়খন্ডের হেমন্ত সোরেনের পর অরবিন্দ কেজরিওয়াল হলেন দ্বিতীয় নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী যাঁকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যে অভিযোগগুলোর প্রমাণ এখনও অনেক দূরে। মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, সেই একই অভিযোগে দিল্লীতে আম আদমি পার্টির অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নেতা, উপ-মুখ্যমন্ত্রী মণীষ সিসোদিয়া এবং সাংসদ সঞ্জয় সিংকেও কিছুদিন আগে গ্রেপ্তার করা হয়। হালফিলের যা রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে সেই অনুসারে কেউই জামিন না পেয়ে জেলে রয়েছেন, যদিও চার্জশিট প্রদান বা বিচার প্রক্রিয়া শুরুর কোনো চিহ্নই দেখা যাচ্ছে না।
২০১৪ সালে মোদী ক্ষমতায় আসার পর থেকে ইডির চালানো মামলার ৯৫ শতাংশই হয়েছে বিরোধী নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে এই ধারাটা মোদী সরকারের জনবিরোধী নীতিমালার সমালোচকদের বিরুদ্ধে ইডিকে লেলিয়ে দিয়ে প্রতিহিংসা চরিতার্থতার রাজনীতিরই প্রতিফলন।
গত কয়েক বছর ধরে বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার সারা দেশের বিরোধী নেতৃবৃন্দের হেনস্থা ঘটাতে ও তাদের ভয় দেখাতে ইডি ও সিবিআই-এর মতো কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে উদ্ধতভাবে কাজে লাগিয়ে আসছে। অ-বিজেপি দল শাসিত রাজ্য সরকারগুলোর নেতৃবৃন্দকেই মূল নিশানা করা হয়েছে। অতি সম্প্রতি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয়েছে।
অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে এমন সময় গ্রেপ্তার করা হলো যখন বড়-বড় কর্পোরেট সংস্থার কাছ থেকে বিপুল মূল্যের সম্পদ নিজেদের ভাঁড়ারে আনতে নির্বাচনী বন্ডকে কাজে লাগানোর জন্য বিজেপি সরকার পড়েছে জোরদার নজরদারির মুখে। সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি এই বন্ডগুলোকে অসাংবিধানিক বলে অভিহিত করেছে এবং বন্ডগুলোর বিশদ তথ্য সম্প্রতি প্রকাশ্যে এসেছে। এই বিষয়টা থেকে দৃষ্টি ঘোরাতেই কেজরিওয়ালের গ্রেপ্তারি এক মরিয়া কিন্তু দানবীয় পন্থা বলেই মনে হচ্ছে।
লোকসভা নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগে বিরোধী নেতৃবৃন্দের এই গ্রেপ্তারি, তাদের বিরুদ্ধে হুমকিবাজি ও তাদের হেনস্থা দেখাচ্ছে যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি এই সরকারের বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা নেই। বৈষম্যমূলক ও অগণতান্ত্রিক আইন, রাষ্ট্রের মদতপুষ্ট সংখ্যাগুরুবাদী হিংসা, ক্রমবর্ধমান অসাম্য ও বেকারি এবং বড়-বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলোর অভূতপূর্ব মাত্রার সম্পদ ও ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠা — এই সমস্ত কিছুর জন্য দেশ যে পরিমাণে অশান্ত হয়ে উঠেছে তাতে সরকারের আশঙ্কা যে জনগণের ক্ষোভ নির্বাচনে তাদের অবস্থা খারাপ করে দিতে পারে। আর তাই যে কোনো ফলপ্রসূ বিরোধিতাকে নির্মূল করতে সরকার চেষ্টার কোনো খামতিই রাখছে না।
সিপিআই(এমএল) দাবি জানাচ্ছে, অরবিন্দ কেজরিওয়াল, হেমন্ত সোরেন, মণীষ সিসোদিয়া-সহ অন্যান্য বিরোধী নেতাদের অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে। সিপিআই(এমএল) সমস্ত বিরোধী দলের কাছে আবেদন জানাচ্ছে, এই কঠিন সময়ে ঐক্যকে সুদৃঢ় করুন এবং ভারতীয় জনগণের সমর্থনের ভিত্তিতে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে শাসক দলকে মুখের মতো জবাব দিন।
(সিপিআইএমএল কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষে এই বিবৃতিটি ২১ মার্চ প্রকাশ করেন রবি রাই)
নির্মাণ ব্যবসার সাথে যুক্ত ডিএলএফ। ২০১৯’এর অক্টোবর থেকে ২০২২’এর নভেম্বর পর্যন্ত কয়েক দফায় বিজেপি’কে বন্ডের মাধ্যমে অর্থ জোগান দিয়েছে — যার মোট আর্থিক মূল্য ১৭০ কোটি টাকা। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পরে নির্বাচনী বন্ডের প্রকাশিত তথ্য থেকেই তা জানা যাচ্ছে। যে তিনটি ফার্মের মাধ্যমে ডিএলএফ ওই বন্ড কিনেছিল তা হল : ডিএলএফ কমার্শিয়াল ডেভেলপার্স লিমিটেড, ডিএলএফ গার্ডেন সিটি ইন্দোর প্রাইভেট লিঃ এবং ডিএলএফ লাক্সারি হোমস্ লিঃ। সমস্ত বন্ডই বিজেপি-র ঘরে গেছে।
মজার ব্যাপার হল, ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের প্রচারে কংগ্রেস নেত্রী সনিয়া গান্ধীর জামাই রবার্ট বঢরা ও নির্মাণ সংস্থা ডিএলএফ’এর বিরুদ্ধে জমি দুর্নীতির অভিযোগ তুলে হৈচৈ ফেলে দেন মোদী। ২০১২ সালে এই সংস্থার বিরুদ্ধে জমি দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। বিজেপি হরিয়ানা রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর ২০১৯’এর জানুয়ারিতে ডিএলএফ অফিস তল্লাশি করে সিবিআই।
নির্বাচনী বন্ডের তথ্য সামনে আসতেই দেখা যাচ্ছে এই তল্লাশি অভিযানের পরেই ডিএলএফ বিজেপি’কে অনুদান পাঠিয়েছে বন্ডের মাধ্যমে। আর, তা পাওয়ার পরই পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্টে হরিয়ানার সরকার জানায়, ২০১২ সালে বঢরা ও ডিএলএফ’এর জমি লেনদেনে কোনও অনিয়ম হয়নি।
দিল্লির আবগারি মামলায় প্রথম গ্রেপ্তার হন পি শরৎচন্দ্র রেড্ডি। তার সংস্থা বিজেপি’কে বন্ডের মাধ্যমে মোটা টাকা দেওয়ার পরই ইডি জামিনের বিরোধিতা করেনি। রাতারাতি শরৎ চন্দ্র রেড্ডিকে রাজসাক্ষী করে দেওয়া হল। এই হল মোদীর না খায়ুঙ্গা না খিলায়ুঙ্গার আসল স্বরূপ।
২৮ মার্চ সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার এক প্রেস বিবৃতি বলেন — লোকসভা নির্বাচনের নির্ঘণ্ট ঘোষণার পর, সংবাদ মাধ্যমে বিদায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও বিজেপি’র প্রধান প্রচারক নরেন্দ্র মোদীজি ও কৃষ্ণনগরে বিজেপি প্রার্থী ‘রাজমাতা’ অমৃতা রায়ের একটি টেলিফোন বাহিত কথোপকথন প্রকাশ্যে এসেছে। প্রশ্নোত্তরের ধরণধারণ বস্তুত পূর্বনির্ধারিত ছকে বাঁধা। ব্যক্তিগত স্তরের কথোপকথন বিজেপি’র সামাজিক মাধ্যম বিভাগ যে পরিকল্পিতভাবে প্রকাশ্যে এনেছে - সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। মোদী উবাচ এই যে, কেন্দ্রীয় এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) এই বাংলায় দুর্নীতিবাজদের থেকে অদ্যাবধি যে ৩০০০ কোটি টাকা বাজেয়াপ্ত করেছে, বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং সেই টাকা বাংলার বঞ্চিত গরীর জনতার মধ্যে সম্পূর্ণ বিলি করতে আইনি সুযোগ খুঁজতে বিস্তর কাঠখড় পোড়াচ্ছেন এবং তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় ফিরে (!) তাঁর ‘জনদরদী’ সরকার সেই টাকা ইডি’র থেকে হস্তান্তর ঘটিয়ে বিলিবন্টন করার জোরালো প্রতিশ্রুতি রাখছে। এটা মোদী গ্যারান্টির নবতম ‘জুমলা’ তিনি বাংলার, বিশেষ করে কৃষ্ণনগর দক্ষিণের শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করতে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার নিদান দিয়েছেন।
আমরা আইনিভাবে অসংগত ও আদর্শ নির্বাচনী বিধি ভঙ্গকারী এই নবতম ‘জুমলা’ প্রচারের দায়ে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনকে মোদীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাই।
সেইসঙ্গে আইনগত বাধাকে ‘মোদী ম্যাজিকে’ অপসৃত করে ২০১৪ সালের জানুয়ারী থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর মাস অবধি সময়কালে দেশজোড়া দুর্নীতি মামলায় ইডি কর্তৃক বাজেয়াপ্ত নগদ ১,১৬,৭৯২ কোটি এবং বাজেয়াপ্ত সম্পত্তি’র আর্থিক মূল্য ১৬, ৬৩৭.২০ কোটি টাকা ভারতের দরিদ্রতম মানুষের মধ্যে বিলিবন্টনের দাবি জানাই।
ইতিমধ্যে আরও প্রকাশ্যে এসেছে যে কীভাবে দুর্নীতিতে অভিযুক্ত ৪১টি ভারতীয় কোম্পানীকে ইডি, সিবিআই ও আইটি’র জুজু দেখিয়ে আদায়কৃত ২৫৯২ কোটি টাকা বেনামে অসাংবিধানিক ও অন্যায্য ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে বিজেপির কেন্দ্রীয় তহবিল পুষ্ট করেছে।
মোদীজিকে পৃথিবীর বৃহত্তম দুর্নীতিলব্ধ এই টাকার রাশিও নিশ্চিতভাবেই জনগনকে ফেরত দিতে হবে।
জুমলা নয়, জবাব চাই
তিনি হলেন কর্নাটকের ভূতপূর্ব মন্ত্রী, এবং বেআইনি খনি’র রাঘববোয়াল। নাম — জি জনার্দন রেড্ডি। গত বছর বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি থেকে দু-দশকের সম্পর্ক ছিন্ন করে নিজেই তৈরি করেন এক রাজনৈতিক দল — কল্যাণ রাজ্য প্রগতি পক্ষ (কেআরপিপি)। দিন কয়েক আগে, তিনি তার স্ত্রী সহ আরও কয়েকজনকে নিয়ে বিজেপি-তে গিয়ে ভিড়লেন, মিশিয়ে দিলেন তার তৈরি করা দলটিকে। বিজেপির সাথে নিজের দলটিকে মিশিয়ে দেওয়ার আগে তিনি দিল্লিতে গিয়ে অমিত শাহ’র সাথে সাক্ষাৎ করেন। তখনই অমিত শাহ জানিয়ে দেন, বিজেপিকে ওই রাজ্যে বাইরে থেকে সমর্থন না করে তার দলটিকে বিজেপির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। তারপরই তিনি তার দলবল নিয়ে ভিড়ে যান বিজেপিতে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, খনি কেলেঙ্কারির অভিযোগে জনার্দন রেড্ডিকে সিবিআই গ্রেপ্তার করেছিল।
এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টোরেট বা ইডি গত বৃহস্পতিবার ২১ মার্চ দিল্লীর আপ সরকারের চালু করা আবগারি নীতির ভিত্তিতে চালানো দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করল দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী তথা আপ নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে।
এর আগে আরও দুই আপ নেতা সঞ্জয় সিং ও দিল্লীর প্রাক্তন উপ-মুখ্যমন্ত্রী মণীশ সিসোদিয়াকেও একই অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং তাঁরা এখন জেলে রয়েছেন। প্রসঙ্গত, আপ সরকারের আবগারি নীতি চালু হয় ২০২১ সালের নভেম্বরে এবং ঐ নীতি নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে তা বাতিল করা হয় ২০২২’এর সেপ্টেম্বরে। ইডির অভিযোগ, হায়দ্রাবাদের ওষুধ কোম্পানি অরবিন্দ ফার্মার ডিরেক্টর পি শরৎ চন্দ্র রেড্ডি এবং বিআরএস নেত্রী ও তেলেঙ্গানার পূর্বতন মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের কন্যা কে কবিতার উদ্যোগে গড়ে ওঠা “দক্ষিণী জোট” দিল্লীর মদ ব্যবসার দখল নিতে আপকে ১০০ কোটি টাকা ঘুষ দেয় এবং ঐ আবগারি নীতির ভিত্তিতে “দক্ষিণী জোট” দিল্লীর মদ ব্যবসার অন্তত ৩০ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ পায়। ইডির মতে, কেজরিওয়াল ঐ নীতির চাঁই হওয়ায় তিনি অপরাধের দায় এড়াতে পারেন না।
তবে, কেজরিওয়াল গ্রেপ্তার হওয়ার পরপরই সামনে এল কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য। যাঁর বক্তব্যের ভিত্তিতে ইডি কেজরিওয়ালকে আপ সরকারের মদ নীতির “মূল মাথা” বলে সাব্যস্ত করে। তিনি হলেন উপরে উল্লেখিত শরৎ চন্দ্র রেড্ডি, ইডি যাঁকে এই মামলায় আগে গ্রেপ্তার করেছিল এবং যাঁর জামিনের আবেদনে কোনো আপত্তি জানায়নি। ফলে, জামিনে মুক্ত হয়ে তিনি এখন স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কেজরিওয়াল গ্রেপ্তার হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগেই এসবিআই নির্বাচন কমিশনের কাছে নির্বাচনী বন্ডের আলফা নিউমেরিক্যাল নম্বর বা নির্বাচনী বন্ড চিহ্নিত করার সংখ্যা জমা দেয় এবং তার থেকে দেখা যায় ঐ শরৎ চন্দ্র রেড্ডি এবং তাদের কোম্পানি নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে কয়েক দফায় বিজেপিকে বিপুল পরিমাণ চাঁদা দিয়েছে। এবং কিছু নির্বাচনী বন্ড কেনা হয়েছে শরৎ চন্দ্র রেড্ডি গ্রেপ্তার হওয়ার মাত্র পাঁচ দিন পরই। প্রশ্নটা অতএব খুব স্বাভাবিক ভাবেই উঠছে যে — শরৎ চন্দ্র রেড্ডির প্রতি ইডি তথা মোদী সরকারের কৃপা বর্ষণে মূল ভূমিকা থেকেছে কি নির্বাচনী বন্ডেরই? অন্যভাবে বললে, শরৎ চন্দ্র রেড্ডির ব্যবসা স্থলে ইডির হানাদারি ও তাঁর গ্রেপ্তারিই কি নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে বিজেপির ভাঁড়ারে ৫০ কোটিরও বেশি টাকা জমা হওয়ার নির্ধারক শর্ত হয়ে উঠেছিল?
আলোচ্য ডিরেক্টর ও তাঁর কোম্পানি নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে কবে কত কোটি টাকা চাঁদা বিজেপিকে দিয়েছে সেদিকে তাকানো যাক। ইডি অরবিন্দ ফার্মার ডিরেক্টর শরৎ চন্দ্র রেড্ডিকে গ্রেপ্তার করে ২০২২’এর ১০ নভেম্বর। এর পাঁচ দিন পরই ১৫ নভেম্বর অরবিন্দ ফার্মা বিজেপির জন্য ৫ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড কেনে এবং বিজেপি ঐ বন্ড ভাঙায় ১৭ নভেম্বর। শরৎ রেড্ডির জামিনের শুনানি হয় ২০২৩’এর মে মাসে এবং ইডি জামিনের বিরোধিতা না করায় তাঁর জামিন লাভ অনায়াস হয়। শরৎ চন্দ্র রেড্ডি জামিন পান ২০২৩’এর মে মাসে, এবং তাঁর রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদনের ভিত্তিতে ও সরকারের অনুমোদনে দিল্লীর এক আদালত ঐ বছরের ১ জুন তাঁকে রাজসাক্ষী হওয়ার অনুমতি দেয়। ঐ বছরের, অর্থাৎ ২০২৩ সালের ৮ নভেম্বর অরবিন্দ ফার্মা বিজেপিকে চাঁদা দেওয়ার জন্য আরও ২৫ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড কেনে যে বন্ড বিজেপি ভাঙায় ১৭ নভেম্বর। ঐ ৮ নভেম্বরেই আবার এ পি এল হেলথকেয়ার এবং ইউজিয়া ফার্মা স্পেশ্যালিটিজ নির্বাচনী বন্ডে বিজেপিকে দেয় যথাক্রমে ১০ ও ১৫ কোটি টাকা। এই দুটোই অরবিন্দ ফার্মার অধীনস্থ সংস্থা এবং শরৎ চন্দ্র রেড্ডি আবার এ পি হেলথকেয়ার-এরও ডিরেক্টর। উল্লেখ্য যে, শরৎ চন্দ্র রেড্ডি গ্রেপ্তার হওয়ার আগেও অরবিন্দ ফার্মা ২০২২’এর জানুয়ারি ও জুলাই মাসে বিজেপিকে নির্বাচনী বন্ডে চাঁদা দিয়েছিল যথাক্রমে ৩ কোটি ও ১.৫ কোটি টাকা। গ্রেপ্তারের আগে ও পরে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে দেওয়া চাঁদার পরিমাণের পার্থক্য বিবেচনা করলে এই অনুমান অস্বাভাবিক নয় যে, ইডির হস্তক্ষেপই বিজেপির ভাঁড়ারে বিপুল পরিমাণ চাঁদা যাওয়ার মাধ্যম হয়ে উঠেছিল। ভাষ্যকাররা এখন যেমন বলছেন, ইডির ভয় দেখানোটাকেই তোলাবাজির হাতিয়ার করে তুলেছিল বিজেপি।
কেজরিওয়ালের গ্রেপ্তারি আরও যে প্রশ্নটাকে সামনে আনছে তা হল, ইডি কি তাঁর দুর্নীতির নির্দিষ্ট প্রমাণ পেয়েছে, নাকি স্বেচ্ছাচারিতাই ছিল ঐ গ্রেপ্তারির ভিত্তি। যে ১০০ কোটি টাকার ঘুষের কথা ইডি বলছে এবং যে টাকা আপ গোয়ার নির্বাচনে ব্যয় করেছে বলে তাদের অভিযোগ, তার কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ কি তাদের হস্তগত হয়েছে? প্রদত্ত ঘুষের কোনো টাকা কি কেজরিওয়ালের কাছ থেকে পাওয়া গেছে? শরৎ চন্দ্র রেড্ডির যে বক্তব্যের ভিত্তিতে ইডি তাঁকে দুর্নীতির “মূল মাথা” বলে চিহ্নিত করছে, সেই বক্তব্য কতটা প্রত্যয়যোগ্য? আপ নেত্রী ও কেজরিওয়াল মন্ত্রীসভার সদস্যা অতীশী প্রশ্ন তুলেছেন, “শরৎ চন্দ্র রেড্ডি সুস্পষ্টভাবেই বলেছিলেন যে তিনি কখনই অরবিন্দ কেজরিওয়ালের সঙ্গে দেখা করেননি বা কথা বলেননি এবং আপ-এর সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই। জেলে কয়েক মাস থাকার পর তিনি তাঁর বক্তব্যকে পাল্টেছেন। কিন্তু টাকা কোথায়? টাকা যাওয়ার (কেজরিওয়ালের কাছে) পথচিহ্ন কোথায়?” অতএব, বক্তব্যকে পাল্টে কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুবিধা হওয়ার বক্তব্য শরৎ চন্দ্র রেড্ডির হাজির করার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার নয়। শরৎ চন্দ্র রেড্ডির জামিন লাভ প্রসঙ্গে নির্বাচনী ক্ষেত্রকে স্বচ্ছ করে তোলার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত এনজিও কমন কজ-এর নেত্রী অঞ্জলি ভরদ্বাজ বলেছেন, “২০২৩’এর মে মাসে রেড্ডি দিল্লী হাইকোর্টে জামিনের আবেদন করেন। কোমরে ব্যাথার যুক্তি দেখিয়ে জামিন চাওয়া হলেও ইডি তার বিরোধিতা করেনি। ইডি জামিনে সায় দিয়েছে, এমন কটি মামলা আছে? এর পর রেড্ডি জুন মাসে রাজসাক্ষী হয়ে যান।...” কেজরিওয়ালের গ্রেপ্তারির বৃত্তান্ত এবং আনুষঙ্গিক ঘটনাবলী বিরোধী নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে নরেন্দ্র মোদীর প্রতিহিংসাপরায়ণতাকে, রাজনৈতিক ময়দানে তাদের উদ্যোগকে নিষ্ক্রিয় করে তোলার দুরভিসন্ধিকেই প্রতিপন্ন করছে। সম্প্রতি সামনে আসা নির্বাচনী বন্ড সম্পর্কিত সমাচার মোদীর দুর্নীতি-বিরোধী অঙ্গীকারকেও এক নির্ভেজাল কপটাচার বলেই জানান দিচ্ছে। বেশ কিছু নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে প্রদত্ত চাঁদা দেখাচ্ছে যে, অস্বচ্ছ পথে অর্জিত টাকার প্রাপক কেউ হলে তা কেজরিওয়াল নন, বরং নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি। আর এ সমস্ত কিছুর প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে মোদী কথিত গণতন্ত্রের জননীর বিবমিষার উদ্রেক হচ্ছে, তিনি ক্ষুব্ধও হচ্ছেন!
আরও জোরের সাথে, কার্যকরীভাবে, আরও বেশি তথ্যসমৃদ্ধ হয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে প্রচার মানুষের কাছে নিয়ে যেতে হবে। এই দাবিতে ২৩ মার্চ ধুবুলিয়া হাই স্কুলের অঘোর কামিনী হলে অনুষ্ঠিত হল পার্টির নদীয়া জেলা কর্মী বৈঠক। শুরুতে ধুবুলিয়া অফিসে ভগত সিং’এর শহীদ দিবস পালন করা হয়। তারপর জেলার বিভিন্ন ব্লক থেকে আগত প্রায় ৬৪ জন কর্মীর উপস্থিতিতে কর্মী বৈঠকের আলোচ্য বিষয় ছিল — ‘‘আসন্ন লোকসভা নির্বাচন এবং আমাদের কর্তব্য’’। কর্মী সভা সঞ্চালনা করেন জেলা সম্পাদক জয়তু দেশমুখ। শুরুতে বক্তব্য রাখেন পার্টির রাজ্য কমিটি সদস্য বাসুদেব বসু। এরপর বক্তব্য রাখেন রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার। তিনি বিজেপি আরএসএস’এর রাজনীতি সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা রাখেন। তিনি বলেন মোদী সরকারের রাজত্বে নেমে আসা বিপর্যয়ের বিভিন্ন দিকগুলি এ রাজ্যে বহুল চর্চিত নয়। সমগ্র দেশকে ফ্যাসিবাদের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করতে আমাদের রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। দেশ জুড়েই জনগণের প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে উঠছে। তিনি চলমান কৃষক আন্দোলনের বৈশিষ্ট্যগুলি ব্যাখ্যা করে বলেন নকশালবাড়ির কৃষক আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এই আন্দোলন এগিয়ে চলেছে।
শ্রমিকশ্রেণী ও ছাত্র-যুবরা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। এগুলির সাথে আমাদের একাত্মতা আরো বাড়িয়ে তুলতে হবে।
এ রাজ্যের প্রেক্ষিতে তিনি বলেন, “একটা বড় অংশের মানুষ আছেন যারা গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে চান। অন্তত একটা ভোটাধিকারের মাধ্যমেও তারা গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেন। তাঁদের উপরই আমাদের নির্ভর করতে হবে। নদীয়া জেলায় আমাদের প্রার্থী নেই। তবুও আমাদের আরও জোরের সাথে, আরও কার্যকরীভাবে, আরও বেশি তথ্যসমৃদ্ধ হয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে প্রচার মানুষের কাছে নিয়ে যেতে হবে। এটাই আমাদের মূল কাজ। আমরা বলেছি বিজেপিকে প্রতিহত করতে ভারতের জনগণ ২০০৪ সালে তাদের বুদ্ধিমত্তা ও বিবেচনাকে প্রমাণ করেছেন। ২০২১ সালে যখন বিজেপি বাংলা দখলে উঠে পড়ে লেগেছিল, তখন তৃণমূলে ভাঙ্গন দেখা গিয়েছিল। অনেকেই তৃণমূল ছেড়ে চলে যাচ্ছিল। সেসময় বাংলার মানুষ বিজেপি বিরোধী প্রচারের ফলেই হোক কিংবা নিজেদের চিন্তা চেতনার জায়গা থেকেই হোক বিজেপিকে ক্ষমতায় আসতে দেয়নি। তারা যে সবাই তৃণমূলের সমর্থক ছিল এমনটা নয়। তবুও মানুষের বিজেপি বিরোধী আকাঙ্ক্ষা নির্বাচনে প্রতিফলিত হয়েছিল। সে সময় তৃণমূলের জেতার কথা ছিল না। কিন্তু জিতেছিল, কারণ কোন বিকল্প ছিল না। বামেরা শূন্য হয়ে গিয়েছিল। ৩৪ বছর ক্ষমতায় থেকে বামদের গ্রহণযোগ্যতা এখনও মানুষের মধ্যে নেই। তারা চেষ্টা করছেন। যুব বাহিনী দিয়ে ব্রিগ্রেড ভরিয়েছেন। তবুও এখনও তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা আসেনি।
অপরদিকে তৃণমূল কিছু সংস্কারের কথা বলছে। যেমন লক্ষীর ভান্ডারে ওরা ৫০০ টাকা বাড়িয়ে ১০০০ টাকা করেছে। কিন্তু একে আমরা কেবলমাত্র একটি শব্দবন্ধ — খয়রাতি বলছি না। মানুষ যে আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে রয়েছে সেখানে একটি গরিব পরিবারের কাছে পাঁচশো বা হাজার টাকা জীবনধারণের জন্য একটা বড় অবলম্বন। এটাকে কখনই আমরা “ভিক্ষা” বলবো না। কিন্তু এটা দিয়ে সমাধানের তো কিছু হবে না। সমাধান কিছুটা হতে পারত যদি কর্মসংস্থানের জায়গাটা প্রশস্ত করা হতো। আজ রন্ধনকর্মীদের সামান্য ৫০০ টাকা ভাতা বাড়ানো হয়েছে, আশা, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের ভাতা কিছুটা বাড়ানো রয়েছে। কিন্তু এটা থেকে কোনো স্থায়ী সমাধানের জায়গা কি আমরা পাচ্ছি? প্রকল্প কর্মীদের দাবি ছিল শ্রমিক মর্যাদা ও একটা বেতন কাঠামো তৈরি করা। যদি সদিচ্ছা থাকতো তাহলে ১৩ বছর ক্ষমতায় থেকে তারা এটা করতেই পারতেন। কিন্তু করলেন না। চা বাগানে বিগত ১০ বছর ধরে নূন্যতম মজুরি ঘোষণা করা হচ্ছে। কিন্তু বিভিন্নভাবে সেটাকে সরিয়ে রাখা হচ্ছে। নতুন আইন করে চা বাগানের শ্রমিকদের লিজের জমি ফ্রিহোল্ড করে পুঁজিপতিদের হাতে ওরা তুলে দিতে চাইছে।
তাই নির্বাচনেই সবকিছু শেষ হয়ে যাচ্ছে না। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী লড়াই আমাদের চালিয়ে যেতে হবে। জনগণের চেতনা, বুদ্ধি বিবেচনার উপর আমাদের আস্থা রাখতে হবে। আমরা বিজেপির বিরুদ্ধে প্রচার চালাতে গিয়ে তৃণমূল সম্পর্কে চুপ করে থাকবো না। বামপন্থী হিসেবে একটা দায়বদ্ধতা আমাদের আছে। তবে আমরা কখনই সিপিএমের মতো প্রচার করব না। যেমন ওরা তৃণমূল নিয়ে লম্বা ফিরিস্তি দেয় অথচ বিজেপি নিয়ে কিছুই বলে না। এর বিপরীতে আমাদের রাজনৈতিক অবস্থান খুবই সুস্পষ্ট। আমাদের আহ্বান — ‘‘বিজেপিকে হারাও। গণতন্ত্র বাঁচাও। সংবিধান বাঁচাও।’’ আসন্ন ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন একটা যুগান্তকারী নির্বাচন হতে চলেছে। বিজেপিকে প্রতিহত করতে আমাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে। এরপর এক প্রশ্নোত্তর পর্বে কর্মীরা বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। মূলত আমরা সরাসরি কোনো শক্তিকে ভোট দিতে বলবো কিনা এই প্রশ্ন আসে। আলোচনায় উঠে আসে যে পার্টির স্ট্যান্ডে কোনো ফাঁক নেই। ইন্ডিয়া জোট থাকলে আমরা জোটের জন্য ভোট দিতে বলতাম। যখন জোট নেই তখন আমরা শুধু বিজেপিকে পরাজিত করার কথা বলব। এর চেয়ে বেশি প্রকাশ্যে আমাদের বলার কোনো প্রয়োজন নেই। বাকিটা জনগণ ঠিক করে নেবেন।
কর্মী বৈঠকের পর ধুবুলিয়া নেতাজি পার্কে এক প্রচার সভা হয়। বিজেপি হারাও দেশ বাঁচাও! গণতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষা করতে সমস্ত মানুষ এক হোন! ইলেকটোরাল বন্ডের মাধ্যমে দেশের সবচেয়ে বড় তোলাবাজ বিজেপির মুখোশ খুলে দিন! প্রভৃতি শ্লোগানে এলাকা মুখরিত হয়ে ওঠে।
২১ মার্চ নেতাজি নগর অঞ্চলে শ্রী দেবাশীষ সেনগুপ্তর আত্মহত্যার কারণে রাজ্য রাজনীতি উত্তাল হয়ে ওঠে। ২২ মার্চ, সকালে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন ও গণফ্রন্টের একটি দল এই ঘটনার তথ্যানুসন্ধানে ঐ অঞ্চলে যান। দলে ছিলেন — সৌমিত্র বসু, প্রবীর পাল, জয়ন্ত ঘোষ মজুমদার, সোমনাথ গুহ।
তাঁরা প্রথমে নেতাজি নগর থানার ওসি, শ্রী এস লামার সঙ্গে দেখা করেন। শ্রী লামা জানান ছেলেটির বাবা তপন সেনগুপ্ত একটি কমপ্লেইন দায়ের করেছেন, এফআইআর নয়। ২০ তারিখে সুভাষগ্রামে মামার বাড়িতে উনি আত্মহত্যা করেন। এই এলাকা সোনারপুর থানার অধীন। ওখানেই পোস্ট মর্টেম হয়। যে রিপোর্ট এখনও আসেনি। ওসি বলেন ছেলেটি ছোটখাটো কাজ করতেন এবং উনি নতুন নাগরিকত্ব আইনের কারণে কিছুটা অবসাদগ্রস্ত ছিলেন। ছেলেটির ঠিকানা জানান — ২/৪৪এ, নেতাজি নগর।
এর পর তাঁরা প্রয়াত দেবাশীষের বাড়ি যান। ওনার পিতা কথা বলার মতো অবস্থায় ছিলেন না। ওনার মাসী শোভা রায় প্রতিনিধি দলের সাথে কথা বলেন। তিনি রাজ্য সরকারের ক্যাজুয়াল কর্মী। জানা যায় পরিবার অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল এবং এঁরা ইতিপূর্বে কালীঘাট, গড়িয়ায় ভাড়া বাড়িতে থেকেছেন। গড়িয়াতে মায়ের মৃত্যু হয়। ছেলেটির এক দিদি আছে। ২০১৯ সালেও সিএএ’এর কারণে ছেলেটি অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। মাসী বলেন, দেবাশীষের সব নথিপত্র আছে এবং সেগুলি নেতাজিনগরের ঠিকানাতে করা। তবুও তিনি বাবার কোনো ডকুমেন্টস নেই বলে চিন্তায় ভুগতেন। শোভা রায় এখন শ্রী তপন সেনগুপ্তকে নিয়ে চিন্তিত এবং জিজ্ঞাসা করেন যে, তাঁর জন্য যদি পেনশনের ব্যবস্থা করা যায়। ছেলেটিকে উদ্ধার করতে গিয়ে সুভাষগ্রামে মামার বাড়িও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি আশা করছেন সেটি মেরামতের জন্যও সরকারের কাছ থেকে সাহায্য পাওয়া যাবে।
প্রতিনিধি দলের সদস্যরা পাড়ার চায়ের দোকানগুলিতেও কথা বলেন। জানা গেলো দেবাশীষকে অঞ্চলে খুব বেশি কেউ চেনেন না। কিন্তু তাঁরা জানালেন যে প্রয়াত দেবশীষের জন্ম চিত্তরঞ্জন সেবা সদনে এবং তিনি সাউথ সুবর্বন স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। পাড়ায় রাজনৈতিক নেতাদের ভিড়ের কারণে অনেকেই বিরক্ত।
২৭ মার্চ দুপুর বারোটা নাগাদ হঠাৎ ঢাকুরিয়া রেল বস্তি কলোনিতে আগুন লাগে। আগুনে বহু ঘর পুড়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলির সাথে শ্রমজীবী মহিলা ও স্কীম কর্মী ঐক্য মঞ্চের পক্ষ থেকে দেখা করতে যাওয়া হয়। এখানে এসে দেখা গেল ১২টি পরিবারের ঘর আগুনের পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে গেছে। আগুন লেগেছিল রান্নার গ্যাস সিলিন্ডার থেকে। পরিবারগুলির অন্য জিনিস আগুন থেকে রক্ষা করা যায়নি। গুরুত্বপূর্ণ আধার কার্ড, ভোটার কার্ড, ব্যাংকের বই কিছুই তারা বাঁচাতে পারেনি। সকাল ১২টা থেকে ১টার মধ্যে আগুন লাগে। সিপিআই(এমএল)’এর ঢাকুরিয়া আঞ্চলিক কমিটির পক্ষ থেকে একটি টিম রাজ্য কমিটির নেতা বাবুন চ্যাটার্জি’র নেতৃত্বে ভরত দাস এবং শ্রমজীবী মহিলা ও স্কীম কর্মী ঐক্য মঞ্চের পক্ষ থেকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। তাঁরা স্থানীয় কাউন্সিলার মধুছন্দা দেব’এর সাথে দেখা করেন ও অবিলম্বে ক্ষতিগ্রস্ত গৃহহীন পরিবারগুলির জন্য পুনর্বাসনের দাবি করেন। দেখা গেল সাময়িক কিছু ত্রাণের ব্যবস্থা স্থানীয় কাউন্সিলারের পক্ষ থেকে করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলির নামও নথিভুক্ত করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য কিছু ত্রাণ সামগ্রি নিয়ে যাওয়ারও পরিকল্পনা নিয়েছে শ্রমজীবী মহিলা ও স্কীম কর্মী ঐক্য মঞ্চ।
গত মাসেই অসংখ্য মানুষের আধার কার্ড বাতিল করে দিয়ে নাগরিকত্ব এ্যাজেন্ডা নতুন করে সামনে আনা হয়েছিল। নদীয়া জেলা, যেখানে জনসংখ্যার প্রায় ৪৫ শতাংশ মানুষ মতুয়া বা নমশূদ্র সম্প্রদায়ের। যারা জীবন-জীবিকার তাগিদে বাংলাদেশ থেকে এদেশে এসে নাগরিক অধিকার অর্জন করে বসবাস করছেন। প্রধানত এই জনগোষ্ঠীকে টার্গেট করে নির্বাচনের প্রাক্কালে আধার কার্ড বাতিল করা হয়েছিল। এরই প্রেক্ষিতে রানাঘাট লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত কৃষ্ণগঞ্জ ব্লকের বগুলা তারকনগর এলাকায় পার্টির এক প্রতিনিধিদল সরেজমিন তদন্ত অনুসন্ধান চালায়। যাদের নাগরিকত্ব প্রশ্নের মুখে ফেলে দেওয়া হয়েছে সেই ধরনের অসংখ্য আতঙ্কিত মানুষজনের সাথে কথাবার্তা চালায়।
কিছুদিন আগেই সিএএ বিধি লাগু করা হয়েছে। অসহায় মতুয়া সমাজকে প্রথমে বেনাগরিক করে দিয়ে তারপর তাঁদের নাগরিকত্ব প্রদানের টোপ দেওয়া হচ্ছে। এটা কেবলমাত্র নির্বাচনে আশু ফললাভের জন্যই নয়! বিজেপির লক্ষ্য আরও সুদুরপ্রসারী। উদ্বাস্তু মানুষের এদেশে চলে আসার নানাবিধ কারণকে একমাত্রিক করে তুলে তাকে একটা ধর্মীয় বিদ্বেষে জারিত করবার গভীর চক্রান্ত বিজেপি করছে। সিএএ বিধিতে একটি মাত্র ধর্মীয় সম্প্রদায় তথা মুসলিমদের বিযুক্ত করে তাঁদের শত্রু বলে পরিগণিত করা হয়েছে। যা সম্পূর্ণ সংবিধান-বিরোধী। এর ধারাবাহিকতায় আসছে এনআরসি। এসবের যুক্তিসঙ্গত পরিণতি হিসাবে হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে তারা এগিয়ে যেতে চাইছে।
এই বিষয়গুলিকে তুলে ধরে গত ২৪ মার্চ তারকনগর রেলস্টেশনের পার্শ্ববর্তী এলাকায় এক প্রচারসভা সংঘটিত হয়। বিভিন্ন গণসংগঠন যথা এআইপিএফ, আরওয়াইএ, এআইসিসিটিইউ’এর ব্যানারে অনুষ্ঠিত প্রচারসভা এলাকার ব্যাপক মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বহু মানুষ দীর্ঘ সময় ধরে চলা সভার বক্তব্য শোনেন। অনেকেই সহমর্মিতা জানান। শুরুতে মলয় তেওয়ারি ভারতবর্ষে নাগরিকত্ব আইনের মূল মর্মবস্তুকে বিভিন্ন পর্যায়কে ধরে ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন সংবিধান প্রণীত নাগরিকত্বের মৌলিক ধারণাকেই বিজেপি পাল্টে দিতে চাইছে। কেড়ে নিতে চাইছে সমস্ত নাগরিক অধিকার। এটা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ব্যাপক মানুষের জীবনে চরম বিপর্যয় ডেকে আনবে। সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারা লঙ্ঘন করে কেবলমাত্র ধর্মীয় নিপীড়নকেই নাগরিকত্ব প্রদানের শর্ত রূপে গণ্য করা সংবিধান বিরোধী।
তমাল চক্রবর্তী বিজেপি নেতাদের তীব্র আক্রমণ করে বলেন, আইন ও বিধি অনুযায়ী কেউই কাগজপত্র দেখাতে পারবে না। সেই লক্ষ কোটি মানুষের কি হবে? এর জবাব বিজেপি নেতাদের কাছ থেকে চাইতে হবে। কারণ এটা স্পষ্ট যে সমস্ত আবেদনকারীকে আগেই নিজেকে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে ঘোষণা করতে হবে এবং এযাবৎ কাল পর্যন্ত পাওয়া সমস্ত আইনী অধিকার ত্যাগ করে দিতে হবে। শাসকদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে। সেই আবেদন সমাধানের জন্য অনির্দিষ্টকাল অপেক্ষা করতে হবে। সমস্ত নাগরিক অধিকার হারিয়ে তাদের স্থান কোথায় হবে এখনো অজানা। তারা ডি-ভোটার হয়ে যাবে কিনা সেটাও ঠিক নেই। প্রশাসন ইচ্ছে করলেই নানা রকম হয়রানি করতে পারবে। তাদেরকে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানো হবে কিনা, সেটাও বোঝা যাচ্ছে না।
বাসুদেব বসু বলেন, ১৯৫৫ সালের জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব আইন পাল্টে দিয়ে উত্তরাধিকার সূত্রে নাগরিকত্বের আইন নিয়ে এসে সংশোধন করা হয়েছে। সকলকেই নথিপত্র দিয়ে নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হবে। যাকে বলা হচ্ছে এনআরসি। অন্য দেশ থেকে এসে এদেশে বসবাসকারী সকলকেই বলা হবে অনুপ্রবেশকারী। অর্থাৎ সকলকেই অনুপ্রবেশকারী বলার মধ্য দিয়ে তাদের মাথায় ঝুলিয়ে দেওয়া হবে এনআরসির খাড়া। জয়তু দেশমুখ বলেন, দেশের শাসকদল মানুষকে অসহায় করে দিয়ে জোর করে আনুগত্য আদায় করতে চাইছে। যারা কৃষকের ফসলের লাভজনক দামের গ্যারান্টি দিতে পারেনা, উল্টে শ্রমজীবী মানুষের কাজ খাদ্য শিক্ষার অধিকার কেড়ে নিচ্ছে, কেন্দ্রের ফ্যাসীবাদী সরকারের বিরুদ্ধে এক হয়ে লড়তে হবে। দিকে দিকে আওয়াজ তুলতে হবে বিজেপিকে পরাস্ত করুন। সভা সঞ্চালনা করেন জীবন কবিরাজ।
মুর্শিদাবাদের বিস্তীর্ণ উর্বর জমিতে নীরবে এক পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে। একশ দিনের কাজে যে সমস্ত নারী পুরুষ একসময়ে কাজ পেতেন, তাঁরা এখন দলে দলে ভিন্ রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছেন পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে। গত দু’বছর যাবত এই একশ দিনের কাজের প্রকল্প যা গ্রামীণ কর্মসংস্থানের একটা স্নায়ুকেন্দ্র ছিল, ক্রমেই শুকিয়ে যাচ্ছে।
গ্রামে যখন কৃষি কাজ থাকত না, তখন এই একশ দিনের কাজের প্রকল্প গ্রামীণ ভারতে কর্মসংস্থানের একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র ছিল। মুর্শিদাবাদেও তাই ছিল। কিন্তু কেন্দ্র-রাজ্য বিবাদের জেরে ২০২১’এর ডিসেম্বরের পর থেকে এই খাতে তহবিল আসা বন্ধ হওয়ায় একশ দিনের কাজ মুখ থুবড়ে পড়তে শুরু করেছে। কেন্দ্র সরকার এই খাতে বরাদ্দ বন্ধ করায় গত দু’বছর চরম সংকটে পড়েছে গ্রামীণ রোজগার প্রকল্পটি। ডাউন টু আর্থ’এর পক্ষ থেকে মুর্শিদাবাদের গ্রামগুলিতে এক সমীক্ষা চালাতে গিয়ে সমীক্ষক দল এমন অনেক গ্রাম খুঁজে পেয়েছেন যা এখন রীতিমতো ‘ভূতুড়ে গ্রামে’ পরিণত হয়েছে, যেখানে সক্ষম ব্যক্তিরা গ্রাম ছেড়ে মালদা, দুবাই, উত্তরাখন্ড, রাজস্থান, কেরল, গোয়া-য় পাড়ি দিচ্ছেন। যারা বাইরে যেতে পারছেন না তাঁরা দু’বেলা পেটের খাবার জোটাতে বিভিন্ন কাজের খোঁজে রয়েছেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য, মুর্শিদাবাদের অনেক গ্রামে ৮০-৯০ শতাংশ মানুষের হাতে কোন কাজ না থাকায় তাঁরা বাইরে চলে যাচ্ছেন।
২১ ডিসেম্বর, ২০২১’এর পর থেকে নরেগা খাতে বরাদ্দ বন্ধ করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। যদিও বেশ অনেকেই অভিযোগ করেন যে তার বহু আগে থেকেই মজুরি পাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। বিডিও’র কাছে বারে বারে নালিশ করা সত্ত্বেও কোন সুরাহা হয়নি।
সমীক্ষায় এটাও উঠে এসেছে, ঠিকাদাররা যে সমস্ত প্রতিশ্রুতি দিয়ে গ্রামবাসীদের অন্য রাজ্যে নিয়ে যায়, সেই প্রতিশ্রুতি তারা পালন করেন না। এমন অনেকের সাক্ষাত মিলেছে, যারা গত তিন মাস কোনো মজুরি পাননি। ন্যায্য মজুরি প্রদানে ঠিকাদারদের বাধ্য করার কোনো বিধি ব্যবস্থা না থাকায় এই বঞ্চনা ক্রমে বেড়েই চলেছে।
- তথ্যসূত্র : ডাউন টু আর্থ, ২২ মার্চ, ২০২৪
বিশ্বব্যাঙ্কের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, বিশ্ব পুঁজিকে নিজের দেশে টেনে আনার বদলে এফডিআই বিনিয়োগ ক্রমাগত পতনের মুখে। ২০১৫ সালে এফডিআই বিনিয়োগের হার ছিল জিডিপি’র ২.১ শতাংশ। তা ২০২২’এ আরও নিচে ১.৫ শতাংশে নেমেছে। এই হার নতুন কাজ তৈরি করতে পারছে না। ভারতকে সামনে দিকে এগোতে হলে এই পরিসংখ্যানগুলি চেপে রাখার বদলে বরং নজরে রাখা উচিত।
- অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু’র এক্স হ্যান্ডেল থেকে
আমাদের ফেলে আসা বছরটি, অর্থাৎ ২০২৩ সাল বিশ্ব উষ্ণায়নের পুরনো সব রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে। স্বাভাবিকভাবেই তার প্রভাব পড়েছে সমুদ্রের জলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও হিমবাহের ব্যাপক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে। তবে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার এমন পরিবর্তন হঠাৎ করে ঘটেনি। গত এক দশক ধরেই পৃথিবীর আবহাওয়া এদিকে মোড় নিচ্ছে। পৃথিবীর দ্রুত উষ্ণতা বৃদ্ধির ভয়ঙ্কর ছবিটি সামনে নিয়ে এসে চরম বিপদের সঙ্কেত দিল সম্প্রতি রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রকাশিত আবহাওয়া সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট। এই রিপোর্টে সবচেয়ে উষ্ণ দশক হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে ২০১৪ থেকে ২০২৩’এর সময়সীমাকে।
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা ১৯ মার্চ যে রিপোর্ট’ প্রকাশ করেছে, তাতে বলা হয়েছে, ভূপৃষ্টের তাপমাত্রা গত বছরে গড়ে প্রায় ১.৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাওয়া খুবই উদ্বেগের একটি বিষয়। কারণ, ২০১৫ সালে প্যারিসে জলবায়ু সম্মেলনে তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিপদের যে মাত্রা স্থির করেছিল, এটি তাকে প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছে। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার প্রধান আন্দ্রিয়া সাওলো একে দুনিয়ার জন্য ‘রেড অ্যালার্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর সতর্কবাণী, তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের দিকটি আরও ব্যাপক হয়ে উঠবে।
সাওলোর মতে, ২০২৩ সালটি সমুদ্রের জলের তাপমাত্রার অভূতপূর্ব পরিবর্তনের সাক্ষী থেকেছে। হিমবাহ গলে যাওয়ার মাত্রায় ব্যাপক বৃদ্ধি হয়েছে। রিপোর্ট আরও জানিয়েছে, ২০২৩’এর গোটা বছরটির কোনও না কোনও সময়ে সমুদ্রগুলির ৯০ শতাংশ এলাকার গরম হাওয়া বয়ে গিয়েছে। আর সাগরের জল গরম হয়ে সেখানকার বাস্তুতন্ত্রে বিরাট ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে।
উষ্ণায়নের এই প্রভাব দুনিয়া জুড়ে মানুষের জীবনে যে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে চলেছে, রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্টে সেই উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। বিশেষ করে বন্যা ও খরা, চরম তাপমাত্রার প্রভাবে মানুষের বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা কিংবা খাদ্য সংকটের সম্ভাবনা সামনে এসেছে। রিপোর্ট বলছে, খাদ্যে নিরাপত্তা নেই, এমন মানুষের সংখ্যা কোভিড পর্বের আগের তুলনায় দ্বিগুণ হয়েছে ইতিমধ্যেই।
- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২০ মার্চ, ২০২৪
দিল্লির জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে এবারের নির্বাচনটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাঁচ বছর নির্বাচন হয়নি মাঝে। দীর্ঘদিন পর ছাত্র আন্দোলনের চাপে শেষ পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ নির্বাচন করার সবুজ সঙ্কেত দেয়। লোকসভা নির্বাচনের মুখে দাঁড়িয়ে বিজেপি আরএসএস মরীয়া ছিল দেশের অন্যতম সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিকে নিজেদের দখলে আনতে। এবিভিপিকে জেতানোর জন্য প্রশাসনকেও তারা নানাভাবে কাজে লাগিয়েছিল।
অন্যদিকে বামেরা এই নির্বাচন জেতার জন্য নিজেদের মধ্যেকার নানা বিতর্ককে পাশে সরিয়ে রেখে লড়েছিল ঐক্যবদ্ধভাবে। সিপিআই(এমএল) লিবারেশন প্রভাবিত ছাত্র সংগঠন আইসা, সিপিআই(এম)’এর এসএফআই, সিপিআই’এর এআইএসএফ একমঞ্চে এসে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়ে। অনেক আগে বামেরা নিজেদের মধ্যে লড়ত এবং তারাই ছিল জেএনইউ নির্বাচনে পরস্পরের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী। এবিভিপি’র উত্থানের পর বামেরা নিজেদের মধ্যেকার বিতর্ককে পাশে সরিয়ে রেখে একসঙ্গে লড়া শুরু করে কয়েক বছর আগে থেকেই। এই নির্বাচনেও সেই বোঝাপড়া অক্ষুণ্ণ ছিল।
বামেদের মধ্যেকার নির্বাচনী বোঝাপড়া মানে এই নয় তাদের মধ্যেকার বিতর্কগুলি মুছে গেছে। এ হল পরিস্থিতি অনুযায়ী বিতর্ক ও বোঝাপড়ার ঐক্যর দ্বান্দ্বিকতাকে পাশাপাশি নিয়ে চলা। আমরা আমাদের জীবনেও বিতর্ক ও বোঝাপড়াকে একসঙ্গে নিয়ে চলি নানাক্ষেত্রেই। রাজনীতিও তার ব্যতিক্রম নয়।
জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় তার প্রগতিশীল বাম মনোভাবাপন্ন মানসিকতার জন্য দেশের দক্ষিণপন্থী শিবির, বিশেষ করে আরএসএস, বিজেপির আক্রমণের শিকার হয়েছে বারেবারে৷ এই আক্রমণ শুধুই মতাদর্শগত ছিল না। ছিল অনেক সময়েই একেবারে প্রত্যক্ষ ও শারীরিক আক্রমণ। তৎকালীন এআইএসএফ/সিপিআই ছাত্রনেতা, অধুনা কংগ্রেস শিবিরে যোগ দেওয়া কানহাইয়া কুমারের পরিঘটনা সবারই মনে পড়বে৷ সে সময় আক্রমণের লক্ষ হয়েছিলেন কাশ্মীরের ছাত্রনেত্রী এআইএসএ’র শেহলা রশীদও।
আগামী দিনেও দক্ষিণপন্থী শিবির আরএসএস-বিজেপি যে নানাভাবে জেএনইউ’কে তথা প্রগতিশীল বাম মনোভাবাপন্ন ছাত্র আন্দোলন ও তার মতাদর্শকে টার্গেট করবে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। শুধু জেএনইউ’ই নয়, বাংলার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় সহ যেখানে যেখানেই প্রগতিশীল বাম ছাত্র আন্দোলন শক্তিশালী হবে, সেখানেই তাদের বিশেষ নজর পড়বে ও তারা আক্রমণ নামিয়ে আনতে চাইবে।
লোকসভা নির্বাচনের বিরাট কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ সামনে। প্রায় একশো কোটি ভোটার সেখানে দেশের ভাগ্য নির্বাচন করবেন। জেএনইউ নির্বাচনের হাজার দশেক ভোটের লড়াই সে তুলনায় গোষ্পদ মাত্র। কিন্তু এবিভিপি এখানে জিতলে তাকে অবশ্যই লোকসভা নির্বাচনের বড় ময়দানে বিজেপি নানাভাবে ব্যবহার করে নিত। বিভিন্ন মিডিয়া হাউজকে যে একাজে প্রস্তুত রাখা হয়েছিল গণনার প্রথম পর্বে যখন এবিভিপি এগিয়েছিল, তখন তা দেখাও যাচ্ছিল। শেষমেষ বড় ব্যবধানে বামেদের জয় সেই পরিকল্পনাকে বাতিল করতে বাধ্য করল। এখন মিডিয়া জেএনইউ নির্বাচনকে হয়ত আর ইস্যু হিসেবে বিবেচনা করবেই না।
লোকসভা নির্বাচন বামেদের জন্য এক কঠিন লড়াই। কেরালা ছাড়া অন্যত্র তারা একক শক্তিতে কতটা জিততে পারবেন তা নিয়ে সন্দেহ আছে। অনেক জায়গাতে বিজেপি বিরোধী জোটও মসৃণ হয়নি। যে সব জায়গায় তা হয়েছে বা হতে চলেছে বলে মনে হয় — যেমন তামিলনাড়ুতে বা বিহার ও ঝাড়খণ্ডে — সেখানে বামেদের কয়েকটি আসন বেশ সম্ভাবনাময়। তামিলনাড়ুতে সিপিআই এবং সিপিআই(এম) কয়েকটি আসন জিততে পারে৷ ত্রিপুরাতেও তাদের আসন জেতার সম্ভাবনা আছে। বিহার এবং ঝাড়খণ্ডে একাধিক আসন জেতার লড়াইতে আছে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন। কঠিন সময়ে বামেরা যত বেশি আসন জিততে পারেন, দেশের নানা প্রান্ত থেকে যত বেশি সংখ্যক বাম সংসদ লোকসভাতে পৌঁছতে পারেন, ততই মঙ্গল।
বামেরা তাদের শক্তিকে কতটা বাড়াতে পারবেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মনে রাখতে হবে ২০২৪’এর লোকসভা ভোট নানা কারণেই কেবল বাম শক্তির সংহতিকরণের ভোট নয়। এই মহাগুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের মূল প্রশ্ন বিজেপিকে পরাস্ত করা যাবে কীনা, লোকসভার সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে তাদের দূরে রেখে বিরোধীদের বোঝাপড়া সম্মত এক সরকার গঠন করা যাবে কীনা। বামেরা কয়েকটি আসন বাদে অন্যত্র জেতার লড়াইতে নেই। এমনকী অনেক জায়গায় তাঁরা প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করছেন না। কিন্তু সেই সমস্ত আসনেও বিজেপিকে হারানোর প্রশ্নটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সেই কাজে বাম কর্মী সমর্থকরা যেখানে যতটা পারেন তাঁদের শক্তি ও উদ্যোগকে বিজেপিকে পরাস্ত করার কাজে নিশ্চিতভাবে ব্যবহার করবেন। বাম শক্তির পুনরুজ্জীবনের প্রশ্নটি বিজেপির পরাজয় নিশ্চিত করার জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টার থেকে বিচ্ছিন্ন কোনও ব্যাপার নয়।
- সৌভিক ঘোষাল
বিচারপতি ন্যায়বিচারের প্রতি একনিষ্ঠ হলে “সংঘর্ষ হত্যায়” হাত পাকানো পুলিশ অফিসারের পক্ষেও সাজা এড়ানো যে অসম্ভব হয়ে ওঠে সেরকমই এক বার্তা কয়েকদিন আগে এল মহারাষ্ট্র থেকে। পুলিশ অফিসার প্রদীপ শর্মার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ সুবিদিত যে তিনি ১৫ বছরে ১১২টা ভুয়ো সংঘর্ষে যুক্ত থেকেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে আগে মামলা হলেও সাজাকে পাশ কাটাতে তাঁর অসুবিধা হয়নি। এবার কিন্তু বোম্বে হাইকোর্টের বিচারপতি রেবতী মোহিতে দেড়ে ও বিচারপতি গৌরী গডসের বেঞ্চ সজ্ঞানে গুলি করে হত্যাকে “সংঘর্ষে হত্যা” বলে চালানোর তাঁর কৌশলকে খণ্ডন করে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করেন এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। তাঁর সঙ্গে কারাবাসের সাজা পেয়েছেন আরও ১২ পুলিশ কর্মী। হত্যাকাণ্ডের যে মামলায় প্রদীপ শর্মার এই সাজা তার ঘটনার দিকে তাকানো যাক।
দুর্বৃত্ত শিরোমণি ছোটা রাজনের সহযোগী বলে পরিচিত রামনারায়ণ গুপ্তা ওরফে লখন ভাইয়াকে মুম্বইয়ের ভাসির বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে খুন করা হয় ২০০৬’এর ১১ নভেম্বর। আর এই ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন লখন ভাইয়ার বন্ধু অনিল ভেদা। আদালতে তাঁর সাক্ষ্য দেওয়ার কথা ছিল ২০১১’র ১৬ নভেম্বর। কিন্তু ১১ নভেম্বর নভি মুম্বইয়ের ভাসির বাড়ি থেকে তাঁকে অপহরণ করা হয় এবং চারদিন পর থানের মালে থেকে তাঁর আগুনে দগ্ধ পচাগলা দেহ উদ্ধার হয়। পুলিশের প্রাথমিক তদন্ত লখন ভাইয়া হত্যায় প্রদীপ শর্মার জড়িত থাকাকে খারিজ করে দেয়। পরে ২০০৯ সালে ডেপুটি পুলিশ কমিশনার এম এম প্রসন্নর নেতৃত্বে তৈরি হয় বিশেষ তদন্তকারী দল বা সিট। সিট ২০১০’এর এপ্রিলে তাদের রিপোর্টে জানায় রিয়েল এস্টেট এজেন্ট জনার্দন ভাঙে ব্যবসায় তার প্রতিদ্বন্দী লখন ভাইয়াকে দুনিয়া থেকে সরাতে চাইছিল। এবং তার সঙ্গে যোগসাজশ করেই পুলিশ অফিসার প্রদীপ শর্মা ও অফিসার সূর্যবংশী লখন ভাইয়াকে হত্যা করে। সিট লখন ভাই হত্যায় জড়িত ২২ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়।
কিন্তু ২০১৩ সালের দায়রা আদালতের বিচারে ১৩ পুলিশকর্মী-সহ ২১ জন সাজা পেলেও প্রদীপ শর্মা রেহাই পেয়ে যান। এমনকি লখন ভাইয়ার মাথা ভেদ করা গুলি যে প্রদীপ শর্মার পিস্তল থেকেই বেরিয়েছিল, সে সম্পর্কে বিশেষজ্ঞের রিপোর্ট থাকলেও দায়রা আদালতের বিচারক তাকে যথার্থ সাক্ষ্যপ্রমাণ বলে মানতে চাননি।
বিচারপতি রেবতী মোহিতে দেড়ে এবং গৌরী গডসের বেঞ্চ তাদের রায়ে বলেছে — “এটা একেবারেই স্ফটিক স্বচ্ছ যে একটা ভুয়ো সংঘর্ষকে সত্যিকার সংঘর্ষের রূপ দেওয়া হয়েছিল।” রায়ে আরও বলা হয়, দায়রা আদালত প্রদীপ শর্মার বিরুদ্ধে থাকা “অকাট্য সাক্ষ্যপ্রমাণ” দেখতে ব্যর্থ হয়েছে। অনিল ভেদার হত্যা সম্পর্কেও রায়ে বলা হয়েছে — “এটা লজ্জার বিষয় যে অনিল ভেদার হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়নি। এই মামলার প্রধান সাক্ষী এক বীভৎস হত্যাকাণ্ডে প্রাণ হারিয়েছেন। তাঁর পরিবারের কাছে এটা ন্যায়বিচারের প্রহসন।”
এই হত্যাকাণ্ড ও তার বিচার প্রায় একই সময় ঘটা বহুচর্চিত আর একগুচ্ছ হত্যাকাণ্ডকে আমাদের মনে পড়ায়। ২০০৫’এর নভেম্বরে বাস থেকে নামিয়ে গুজরাটের গান্ধিনগরের কাছে হত্যা করা হয় সোহরাবুদ্দিন শেখ ও তার স্ত্রী কৌসর বাইকে। সিবিআই-এর রিপোর্ট অনুযায়ী হায়দ্রাবাদ থেকে সাংলি যাওয়ার সময় গুজরাট ও রাজস্থানের পুলিশ তাদের বাস থেকে নামায় ২২-২৩ নভেম্বর এবং সোহরাবুদ্দিনকে হত্যা করা হয় ২৬ নভেম্বর। এর কয়েকদিন পর তার স্ত্রী কৌসর বাইকে হত্যা করা হয় এবং অভিযোগ, হত্যার আগে পুলিশের এক সাব-ইন্সপেক্টর তাকে ধর্ষণও করে। ঐ একই বাসে থাকা সোহরাবুদ্দিনের সহযোগী তুলসিরাম প্রজাপতিকে রাজস্থানে নিয়ে গিয়ে রাখা হয় পুলিশি হেফাজতে। এবং প্রায় এক বছর পর তাকে হত্যা করা হয় ২০০৬’এর ২৮ ডিসেম্বর। এই সব হত্যাকেই “সংঘর্ষে হত্যা” বলে চালানো হয় এবং হত্যার “মূল মাথা ও প্রধান অভিযুক্ত” বলে সাব্যস্ত হন গুজরাটের তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অমিত শাহ, শাহ-ঘনিষ্ঠ পুলিশ অফিসাররাও অভিযুক্ত হয়।
তদন্তে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, সোহরাবুদ্দিন ছিল তোলাবাজ, গুজরাট ও রাজস্থানের মার্বেল ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সে ও তার সহযোগীরা তোলা আদায় করত। রাজস্থানের মার্বেল ব্যবসায়ীরা সোহরাবুদ্দিনের জুলুমে অতিষ্ঠ হয়ে সোহরাবুদ্দিনকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে চাওয়ার পরপরই এই হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটে। তবে, সোহরাবুদ্দিনের উত্থানের পিছনে কিন্তু রাজনীতিবিদ ও পুলিশ প্রশাসনের মদত ছিল। সিবিআই-এর তদন্তকারী অফিসার সন্দীপ তামাগাডগে সিবিআই আদালতে তাঁর সাক্ষ্যে বলেন, সোহরাবুদ্দিন ও প্রজাপতি হত্যার পিছনে ছিল “রাজনীতিবিদ-দুর্বৃত্ত-পুলিশ” গাঁটছড়া। তিনি তাঁর সাক্ষ্যে আরও জানান, তোলাবাজ দুর্বৃত্তদের সঙ্গে বন্ধন থেকে যে রাজনীতিবিদরা লাভবান হয়েছিলেন, সোহরাবুদ্দিনদের আদায় করা তোলার ভাগ পেয়েছিলেন তাঁরা হলেন অমিত শাহ ও রাজস্থানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী গুলাব চাঁদ কাটারিয়া।
প্রজাপতি হত্যার সময় অমিত শাহর সঙ্গে পুলিশ অফিসারদের ঘনঘন কথাবার্তার রেকর্ড তামাগাডগে সংগ্রহ করেন এবং পুলিশ অফিসারদের সঙ্গে মন্ত্রীর ঐ ক্ষণে ক্ষণে বার্তালাপ “অস্বাভাবিক ও অদ্ভুত” বলে অভিহিত হয়। অস্ত্র আইনে এবং সাক্ষ্যপ্রমাণ ধ্বংস করার অভিযোগে অমিত শাহ ২০১০ সালে গ্রেপ্তার হয়ে কয়েক মাস কারাবাসও ভোগ করেন। তবে, বিশেষ সিবিআই আদালতে অমিত শাহর বিচার শেষমেষ মহারাষ্ট্রের ঐ রেবতী মোহিতে দেড়ে ও গৌরী গডসের মতো বিচারপতিদের হাতে পড়ল না। অমিত শাহর বিচার প্রথমে যাঁর হাতে ছিল সেই বিচারপতি জে টি উৎপতকে বদলি করা হয় ২০১৪’র ২৪ জুন, এবং বদলি করা হয় তদন্তে নিযুক্ত অফিসারদেরও। বিচারপতি উৎপত আদালতে অমিত শাহর উপস্থিতি নিয়ে জোর দিচ্ছিলেন বলে জানা যায়। এরপর অমিত শাহর বিচারের দায়িত্বে থাকা বিচারপতি বি এইচ লোয়ার রহস্যজনক পরিস্থিতিতে মৃত্যু ঘটে ঐ বছরের ডিসেম্বরে। বিচারপতি লোয়ার বোন এই অভিযোগও করেন যে, অমিত শাহর অনুকূলে রায় দেওয়ার জন্য বোম্বে হাইকোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মোহিত শাহ লোয়াকে ১০০ কোটি টাকার ঘুষের প্রস্তাবও করেন। বিচারের ভার এরপর পড়ে বিচারপতি মদন গোসাভির ওপর। তিনি ঐ আদালতে আসার ১৫ দিনের মধ্যেই কোনো বিচার না করেই বলে দেন, ঐ মামলায় এমন কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ নেই যার ভিত্তিতে অমিত শাহকে বিচার প্রক্রিয়ার মধ্যে আনা যায়। কিন্তু একমাত্র বিচারের মধ্যে দিয়েই যে ঐ সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব, বিচারপতি গোসাভি সে কথা বিস্মৃত হলেন! বিচারের মধ্যে না গিয়েই অমিত শাহ বেকসুর খালাস পেয়ে গেলেন!
উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ দুর্বৃত্ত মোকাবিলায় এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় দুর্বৃত্তদের সঙ্গে সংঘর্ষের যে নীতির প্রয়োগ করে চলেছেন স্থানাভাবে তা নিয়ে বিশদ আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। সে প্রসঙ্গে এখানে শুধু এটুকুই বলার যে, ঐ নীতি পুলিশের বিচার-বহির্ভূত হত্যা (একটা হিসাব অনুযায়ী ঐ ধরনের হত্যার সংখ্যা এখনও পর্যন্ত ১৪৬) এবং অপরাধ করেও শাস্তি থেকে পুলিশের অব্যাহতি পাওয়ার এক লাইসেন্স হয়ে উঠেছে। দেশ-বিদেশের মানবাধিকার রক্ষার সংগঠনগুলো এই অভিযোগ করে ঐ নীতিকে কাঠগড়ায় তোলেন যে তা নাগরিক স্বাধীনতা হরণের এক পন্থা ছাড়া অন্য কিছু নয়।
বোম্বে হাইকোর্টের যে রায়ের উল্লেখ করে এই লেখার শুরু, সেই রায়ে বিচারপতিরা এই কথাও বলেছেন যে, “আইনের অভিভাবকদের উর্দি পরিহিত দুর্বৃত্ত হতে দেওয়া যাবে না। আর তা যদি অনুমতি পায় তবে তা নৈরাজ্যে পরিণতি লাভ করবে।” বিধি অনুসারে পুলিশের কাজ আইনকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা এবং শৃঙ্খলা রক্ষা করা। কিন্তু ভারতের বাস্তব পরিস্থিতি হলো, আইন সবচেয়ে বেশি লঙ্ঘন করে পুলিশই। এবং অপরাধ জগতের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে তারা যেমন নিজেদের পকেট ভরায়, তেমনি আবার রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের পৃষ্ঠপোষক হিসাবেও কাজ করে। বর্তমান জমানা যখন একের পর এক দানবীয় আইন তৈরিতে নিয়োজিত হচ্ছে, নাগরিকদের স্বাধীনতা দমনে যখন রাষ্ট্রের উগ্ৰ মূর্তি অত্যন্ত প্রকট হচ্ছে, পুলিশ রাষ্ট্রীয় উৎপীড়নের মাধ্যম হয়ে উঠছে, তখন ভারতের পুলিশ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার সংকেত একেবারে উপেক্ষার নয়। বিচার বিভাগে রেবতী মোহিতে দেড়ে ও গৌরী গডসের মতো বিচারপতিদের উপস্থিতি আজ অত্যন্ত আকাঙ্ক্ষিত। কিন্তু বিচার বিভাগের ওপরও বর্তমান জমানা থাবা বসানোয় ঐ বিচারপতিদের মতো বিচারপতিরা সংখ্যালঘু হয়েই থাকবেন।
- জয়দীপ মিত্র
সুধী,
প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ পরিবেশকর্মী বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কার বিজেতা লাদাখ নিবাসী সোনাম ওয়াংচুক সহ আপামর লাদাখবাসী একটি আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। গত ছয়ই মার্চ থেকে লে শহরে খোলা আকাশের নিচে তারা অনশন সত্যাগ্রহ করছেন। ইতিমধ্যে লাদাখ জুড়ে হাজার হাজার মানুষ তাদের সমর্থনে পথে নেমেছেন।
কেন এই আন্দোলন? প্রাকৃতিক কারণে লাদাখ অঞ্চল একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল বাস্তুতান্ত্রিক ভূখণ্ড। অতি কম বৃষ্টিপাত, চাষযোগ্য উর্বর জমিও সীমিত। তবু সেই প্রাচীন কাল থেকে লাদাখবাসী আনন্দের সঙ্গে জীবন জীবিকা নির্বাহ করতে সক্ষম হয়েছেন। আত্মনির্ভরতা ও স্বয়ংসম্পূর্ণতা তাদের আনন্দের চাবিকাঠি।
২০১৯ সালে বর্তমান কেন্দ্র সরকার জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য ভেঙে লাদাখকে একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করেন। লাদাখবাসী সাদরে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এই আশায় এইবার তারা সায়ত্ত্ব শাসন পাবেন ও নিজস্ব বিধানসভা গড়ে জীব-জড়ের মঙ্গল সাধন করবেন। ২০১৯ সালের বিজেপি দলের নির্বাচনী ইশতেহারের প্রথম সারিতে তার উল্লেখ ছিল। সেখানে লাদাখকে ষষ্ঠ তপশিল তালিকা ভুক্ত করার আশ্বাস দেওয়া হয়। এরপর লাদাখবাসীর প্রতিনিধিদের সঙ্গে কেন্দ্র সরকারের নিয়মিত কথা চলে। কিন্ত শেষ পর্যন্ত ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মাননীয় অমিত শাহ জানান তারা এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না। তাই বাধ্য হয়ে এই আন্দোলনের ডাক।
ষষ্ঠ তালিকা ভুক্ত হওয়ার অর্থ কি? ভারতের সংবিধানের ২৪৪ ধারা অনুসারে ভারতের জনজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলের মানুষের জল, জঙ্গল, জমি ও সংস্কৃতি বজায় রাখার উদ্দেশ্যে এ এক বিশেষ সাংবিধানিক অধিকার। আর লাদাখের ৯৭% মানুষ জনজাতি তালিকা ভুক্ত। এই ধারা আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরাতে ইতিমধ্যে বলবৎ আছে। জেলা স্তরে স্বায়ত্তশাসন সুনিশ্চিত করতে এই ধারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আন্দোলনের দাবি কি?
১) ভোট প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে লাদাখ বিধানসভা গঠন করা এবং লাদাখবাসীর হাতে ভূখণ্ডের মানুষসহ সহনশীল বাস্তুতন্ত্র রক্ষা করা পূর্ণ রাজ্য সরকার গঠন।
২) ষষ্ঠ তফশিলি তালিকাভুক্ত করে প্রান্তিক মানুষের জেলা স্তরে ক্ষমতায়ন।
আমরা কেন কেন লাদাখবাসীর সংহতিতে? জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সর্বত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে। বোঝা দরকার পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্র একটি বৃহৎ জালের মতন। তার কোনো একটি জায়গায় যদি ছিদ্র হয় তাহলে সেই জালের কার্যকারিতা হ্রাস পায়, তথা তা ক্রমে বিনষ্ট হয়। হিমালয়ের হিমবাহ ভারত ভারতবাসীর প্রাণ প্রবাহ জলের আঁধার। এই হিমালয়কে বাঁচিয়ে রাখা অত্যন্ত জরুরি। তাই বিজ্ঞানী ও হিমবাহ সংলগ্ন অঞ্চলে মানুষেরা বারবার দাবি তুলেছেন হিমবাহ সংরক্ষণে যথার্থ ব্যবস্থা গড়ে উঠুক। সমতল ভূমির মতন চওড়া রাস্তা, সেই রাস্তায় অসংখ্য গাড়ির যাতায়াত, উচু উঁচু ইমারত, যথেচ্ছ খনিজ উত্তোলন হিমবাহগুলির ক্ষতি ডেকে আনছে। হিমালয়ের সহজ সাধারণ সহনশীল জীবন-যাপন হিমবাহ রক্ষার সহযোগী। আমাদের বোঝা দরকার সমতলের মতন একই ধাঁচে হিমালয়ের উন্নয়ন আমাদের অর্থাৎ সমতলেরও জীবন-জীবিকার পরিপন্থী। ইতিমধ্যেই বৃষ্টিপাত ও আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনায় দেশজুড়ে কখনও অতি বৃষ্টি-বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়সহ আরো নানাবিধ প্রাকৃতিক ক্ষতিকারক ঘটনা ঘটে চলেছে। একমাত্র স্থানীয় সুষ্ঠু যথার্থ ব্যবস্থাপনা মধ্য দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা সম্ভব, আর তাই চাইছেন লাদাখবাসী। তাই নদী-পরিবেশ আন্দোলনে যুক্ত বিভিন্ন গণসংগঠন লাদাখবাসীর সংহতিতে ২৪ মার্চ ১২ ঘণ্টার প্রতীকী অনশন ও ধর্মতলার মোড়ে চারটে থেকে ছটা মানববন্ধনের ডাক দিয়েছিলেন।
লাদাখের অনশন সত্যাগ্রহ বাস্তুতন্ত্র রক্ষার লড়াই, স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম
অনশন সত্যাগ্রহ’র ২১তম দিন ২৬ মার্চ সকালে সোনাম ওয়াংচুক সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে বলেন, “আমার #জলবায়ু অনশন’এর ২১তম দিন। রাতে আমার সাথে ৩৫০ জন মানুষ শুয়ে ছিলেন মাইনাস দশ ডিগ্রি তাপমাত্রায়, দিনের বেলা ছিলেন ৫০০০ মানুষ। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে এখনও একটাও শব্দ উচ্চারিত হয়নি। সততা, দূরদৃষ্টি ও প্রজ্ঞা সম্পন্ন রাষ্ট্রনেতৃত্ব প্রয়োজন এদেশের, অদূরদর্শী চরিত্রহীন নেতা নয়...”।
বর্তমান শিল্পায়নের ফলে লাদাখের সংবেদী বাস্তুতন্ত্রে যে মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে তা তুলে ধরে তাঁর ২১ দিনের এই অনশন কর্মসূচি দেশ জুড়ে মানুষের সমর্থন পেয়েছে। কিন্তু মোদী-শাহ শাসন যে বাস্তুতন্ত্র বা জনজীবনের প্রশ্নকে তোয়াক্কা করেন না তা হিমালয়ের যোশীমঠ শহরের ধ্বস বা উত্তরকাশীর টানেল বিপর্যয় থেকে দেশবাসীর কাছে অনেকটাই স্পষ্ট।
২০১৯ সালে সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলুপ্তির মাধ্যমে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের অধিকার কেড়ে নিয়ে তিন টুকরো করা হয় এবং তখন আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল লাদাখ এক পূর্ণাঙ্গ রাজ্যে উন্নীত হবে। কিন্তু এই আশ্বাস ছিল মোদী-শাহর আরেক জুমলা হয়ে দেখা দিয়েছে। লাদাখবাসীর অধিকাংশই পাহাড়ের আদিবাসী, এবং সংবিধানের ষষ্ঠ তপশীল অনুযায়ী স্বায়ত্ত্বশাসন পাওয়ার কথা তাঁদের। ষষ্ঠ তপশীলভূক্ত হলে নিজেদের বিকাশের পথ ঠিক করার অনেক অধিকার পাবেন তাঁরা। বর্তমান সময়ের পরিবেশধ্বংসী উন্নয়নের বিরুদ্ধে খাড়া হবে শক্তিশালী প্রতিরোধ।
পূর্ব ঘোষিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ি ২১ দিন অনশন সত্যাগ্রহ চালিয়ে আন্দোলনের প্রথম অধ্যায় সমাপ্ত করলেন সোনাম ওয়াংচুকের নেতৃত্বে লাদাখবাসীরা। পরদিন, অর্থাৎ ২৭ মার্চ থেকেই শুরু হচ্ছে আন্দোলনের দ্বিতীয় অধ্যায়। এবার অনশনে থাকবেন লাদাখের মহিলারা। তাঁরা টানা ১০ দিন অনশন করবেন। তারপর যুবরা। এবং তারপর বৌদ্ধ ভিক্ষুরা গণ অনশনে বসবেন। ধারাবাহিক চলবে এই সংগ্রাম। এই সংগ্রাম কঠিন, আর লাদাখবাসীর সংগ্রামী মনোবল হিমালয়ের মতোই বিশাল, অটুট।
বিগত ছয় মাস ধরে প্যালেস্টাইনের গাজাপট্টিতে ইজরায়েলী বাহিনী ব্যাপক গণহত্যা ও সর্বাত্মক ধ্বংসলীলা চালানোর পর অবশেষে গত ২৫ মার্চ জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে সিদ্ধান্ত গৃহীত হল এখনই যুদ্ধবিরতি দাবি করে। ফেব্রুয়ারি মাসে আন্তর্জাতিক আদালতে ইজরায়েলের বিচার চলেছে গণহত্যার দায়ে। বিশ্বের অধিকাংশ দেশ ইজরায়েলকে যুদ্ধাপরাধী বলে সাব্যস্ত করে স্বাক্ষ্য দিয়েছে। ২৬ ফেব্রুয়ারি তার রায়ে গণহত্যা বন্ধ করে মানবিক ত্রাণের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক আদালত। কিন্তু এর আগে চার বার প্রস্তাব এনেও জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত পাস করা যায়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বারবার ভেটো দিয়ে সিদ্ধান্ত আটকে দিয়েছে। অবশেষে সোমবার এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হল নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্য দেশের মধ্যে ১৪টি দেশের ভোটে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভেটো প্রয়োগ করার অবস্থান থেকে পিছিয়ে এসে ভোটদানে বিরত থাকার অবস্থান নেয় এবার। গৃহীত সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, রমজান মাসের জন্য এখনই যুদ্ধবিরতি শুরু করতে হবে এবং তা থেকে স্থায়ি যুদ্ধবন্ধের পথে এগোতে হবে। যুদ্ধবন্দীদের মুক্তির দাবিও করা হয়েছে, কিন্তু বন্দিমুক্তিকে যুদ্ধবিরতির শর্ত হিসেবে আরোপ করা হয়নি।
জাতিসঙ্ঘের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর সংস্থায় যুদ্ধবিরতির এই সিদ্ধান্তগ্রহণে বিশ্বজুড়ে সাধারণ মানুষের ধারাবাহিক আন্দোলন সবচেয়ে জোরালো ভূমিকা রেখেছে। ইজরায়েলের যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে তো বটেই, যে দেশগুলি ইজরায়েলের এই নৃশংস মানবতা-বিরোধী অপরাধে সঙ্গ দিয়েছে সেই সেই দেশের সরকারগুলির বিরুদ্ধে সেখানকার মানুষেরা ব্যাপক সংখ্যায় লাগাতার রাস্তায় নেমে এসেছে ধিক্কার জানিয়ে। প্যালেস্টাইনের সংহতিতে কথা বলা, প্যালেস্টাইনের মানুষের জীবন ও সংগ্রামের কথা তুলে ধরা একদিনের জন্যও থামিয়ে দেয়নি বিশ্বজুড়ে সংগ্রামী জনতা।
ইজরায়েলী বাহিনী গত ছয় মাসে গাজাপট্টির নাগরিক আবাসন, সরকারি প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ, মসজিদ ও গীর্জা, এমনকি বড় বড় হাসপাতালকে নিশানা বানিয়ে লক্ষাধিক প্যালেস্তিনিকে হত্যা করেছে বা চিরতরে পঙ্গু করেছে, ২০ লক্ষের ওপর মানুষকে গৃহহীন উদ্বাস্তু বানিয়েছে, দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি তৈরি করেছে, বেছে বেছে সাংবাদিকদের হত্যা করেছে, এমনকি জাতিসঙ্ঘের পাঠানো মানবিক ত্রাণকর্মীদের ওপরও বোম মেরেছে। প্যালেস্টাইনের জমি জবরদখল করে বানানো ইজরায়েলী বসতিতে ৭ অক্টোবর ২০২৩ প্যালেস্টাইনের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল হামাসের নেতৃত্বে হওয়া সশস্ত্র হামলাকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে, হামাসকে খতম করার বাহানায় ইজরায়েলী বাহিনী গত ছয় মাস ধরে এই নৃশংস ধ্বংসলীলা চালিয়ে আসছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের সেক্রেটরি জেনেরাল ইজরায়েলের এই একপাক্ষিক যুদ্ধকে ‘জেনোসাইড’ বা একটি জনগোষ্ঠিকে খতম করে দেওয়ার অভিযান বলে বর্ণনা করেন। হামাসের হামলাকে নিন্দা জানিয়েও তিনি বলেছিলেন যে এই হামলার এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আছে, “শূন্যের ওপর ঘটেনি”।
ইজরায়েল কি নিরাপত্তা পরিষদের দাবি মেনে যুদ্ধ বন্ধ করবে? প্যালেস্টাইনে ইজরায়েলের জবরদখল ও হামলার বিপক্ষে অন্তত পঞ্চাশবার জাতিসঙ্ঘে সিদ্ধান্ত পাস হয়েছে, কিন্তু কোনোদিনই ইজরায়েল সেসব মানেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার সবসময় ইজরায়েলের অপরাধকে মদত জুগিয়েছে। যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত এবারের সিদ্ধান্তগ্রহণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেন ভেটো দিয়ে আটকায়নি সে বিষয়ে ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু মার্কিন প্রশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের দপ্তর থেকে এবারও বলা হচ্ছে যে এই সিদ্ধান্ত মানার কোনও বাধ্যবাধকতা ইজরায়েলের নেই এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার নীতিতে কোনও পরিবর্তন আনছে না, ইজরায়েলকে মিসাইল ড্রোন বোমা সহ সমস্ত রকম অস্ত্র সহযোগিতা চালিয়ে যাবে ইউএসএ। ইউএসএ’র জনতা নিশ্চয় বাইডেন সরকারের এই যুদ্ধাপরাধের জবাব চাইবে।
মোদী সরকারের অধীনে ভারত উপনিবেশ-বিরোধী লড়াইয়ের উত্তরাধিকারকে সম্পূর্ণ পদদলিত করে, প্যালেস্টাইনের পাশে দাঁড়ানোর এতদিনকার নীতি উল্টে দিয়ে, ইজরায়েল-ইউএসএ’র দোসর হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে যায়। বেকারত্ব ও মূল্যবৃদ্ধিতে জর্জরিত যুবকদের ইজরায়েল পাঠায় মজুরের কাজ করতে, যাদের মধ্যে কারো কারো নিহত হওয়ার খবরও ইতিমধ্যে সামনে এসেছে। এদেশে বিজেপি-আরএসএসের হিন্দুত্ববাদ আসলে ইজরায়েলের নৃশংস ইহুদিবাদকেই মডেল করেছে। এই মডেলে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম সম্প্রদায়কে কোনঠাসা করার জন্য নিপীড়ন চলে, দেশের মানুষের ওপর গোপনে নজরদারি চলে, নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য ইচ্ছেমত ব্যবহার করা হয়, বিচার ব্যবস্থাকে কুক্ষিগত করতে চাওয়া হয়, বিরোধীদের স্তব্ধ করে দেওয়ার অপচেষ্টা চলে, কৃষকদের ন্যায্য দাবির আন্দোলনকে ড্রোন উড়িয়ে দমন করতে দেখা যায়। সাধারণ মানুষের জীবন সবদিক থেকে বিপর্যস্ত মোদী জমানায়। লোকসভা ভোটে ভারতের শান্তিকামী মানুষ নিশ্চয় এর যোগ্য জবাব দেবে। প্যালেস্টাইনের মানুষের সংগ্রামের পাশে ভারতের মানুষ থাকবে।
- মলয় তেওয়ারি
ইউরোপের শ্রমিকশ্রেণি আবার মুখর হলেন ইজরায়েলের হিংস্র মানবতাবিরোধী যুদ্ধের বিরুদ্ধে। ইজরায়েলের যুদ্ধবিমানের জন্য ব্রিটেনের যে সমস্ত কারখানাগুলো সরঞ্জাম তৈরি করতো, শ্রমিকরা সেই কারখানাগুলো বন্ধ করে দিয়েছে।
কানাডা সরকারও ঘোষণা করেছে যে তারা ইজরায়েলকে আর অস্ত্র সরবরাহ করবে না। ওই দেশের সংসদ এই মর্মে এক প্রস্তাব গ্রহণ করেছে, যা ইজরায়েলকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। অনেকেই দাবি তুলেছেন অবিলম্বে স্থায়ী যুদ্ধ বিরতির দাবির পক্ষে ব্রিটেনও দাঁড়াক।
ইতিমধ্যে শ’য়ে শ’য়ে শ্রমিক অবরোধ তৈরি করেছে, যাদের মধ্যে রয়েছেন শিক্ষক, পরিষেবা ক্ষেত্রের সাথে যুক্ত কর্মীবাহিনী, বুদ্ধিজীবী এবং শিল্পীরা। ব্রিটেনের এডিনবারায় ও চেল্টেনহামে জিই এভিয়েশন সিস্টেম’এর কারখানাগুলো বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্যবস্তু, কারণ এখানেই তৈরি হয় ইজরায়েল বায়ুসেনার মারণ এফ-৩৫ ফাইটার জেট বিমানের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ যা গাজায় বিধ্বংসী হামলা ব্যবহৃত হচ্ছে।
এই সমস্ত যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভকে বরদাস্ত করা হবে না জানিয়ে ব্রিটেন সরকার হুমকি দিলেও তা অমান্য করেই এই বিক্ষোভ ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ছে।
‘মুক্ত প্যালেস্টাইনের পাশে শ্রমিকশ্রেণি’ এই ব্যানারে শ্রমিকরা কেন্ট’এ অবস্থিত ইন্সট্রো প্রেসিশন লি:’এর কারখানার সামনে তুমুল বিক্ষোভ শুরু করেছেন, যেখানে ইজরায়েলের বায়ুসেনার জন্য ড্রোন সহ অন্যান্য যুদ্ধবিমানের সরঞ্জাম তৈরি করে। তাঁরা দাবি তুলেছেন, অবিলম্বে ব্রিটেন যেন ইজরায়েলকে যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করে।
===0===