বিবৃতি
গাজায় গণহত্যা থেকে লাভ তুলতে উন্মুখ আদানি
massacre-in-gaza

(মানবাধিকার ফোরামের বিবৃতি)

আদানি সম্প্রতি ইজরায়েলের সঙ্গে একটি চুক্তি সম্পাদিত করেছে এবং ঐ চুক্তির ভিত্তিতে সে ইজরায়েলের কাছে অত্যাধুনিক ড্রোন পাঠাচ্ছে যে ড্রোনগুলোকে গাজায় প্যালেস্তিনীয়দের চলমান গণহত্যায় কাজে লাগানোর সুস্পষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। মানবাধিকার ফোরাম এই সিদ্ধান্তকে তীব্র ধিক্কার জানাচ্ছে। আমরা ভারত সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি, ইজরায়েলের সঙ্গে সম্পাদিত ঐ সমস্ত চুক্তিকে অবিলম্বে বাতিল করা হোক। আমরা প্রতিদিনই স্বেচ্ছাকৃতভাবে প্যালেস্তিনীয়দের গণহত্যা সংঘটিত হতে দেখছি, যে নিহতদের মধ্যে অনেক নারী ও শিশুও থাকছে। নৈতিকভাবে অধঃপতিত ইজরায়েল ৩০০০০-এরও বেশি প্যালেস্তিনীয়র প্রাণসংহার করেছে, যাদের ব্যাপক সংখ্যকই অসামরিক নাগরিক। এই বিবৃতি যখন লেখা হচ্ছে সেই সময় প্যালেস্তিনীয় শিশুরা অনাহারগ্ৰস্ত অবস্থায় রয়েছে, এবং গাজায় দুর্ভিক্ষ ঘনীভূত হচ্ছে।

হায়দ্রাবাদে অবস্থিত আদানি-এলবিট অ্যডভান্সড সিস্টেমস ইন্ডিয়া লিমিটেড হলো আদানি ডিফেন্স ও অ্যরোস্পেস এবং ইজরায়েলের এলবিট সিস্টেমসের এক যৌথ সংস্থা যারা অত্যাধুনিক ড্রোন নির্মাণ করে। এই ড্রোনগুলোর একেবারে সাম্প্রতিক সংস্করণটি হল হার্মেস ৯০০। ইজরায়েলের বাইরে এটিই হলো হার্মেস নির্মাণের একমাত্র সংস্থা। সম্প্রতি তেলেঙ্গানা সরকার এবং আদানি গোষ্ঠীর মধ্যে একটি মৌ স্বাক্ষরিত হয়েছে যার ভিত্তিতে ১০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের মধ্যে দিয়ে ‘একটি সর্বাঙ্গীণ ইকোসিস্টেম স্থাপন করা হবে যা হায়দ্রাবাদের আদানি অ্যারোস্পেস পার্কে ড্রোন প্রতিরোধী ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার গবেষণা, বিকাশ, নকশা, নির্মাণ ও একীকরণকে চালিয়ে নিয়ে যাবে।’

অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণের জন্য ইজরায়েল ওয়েপন ইন্ডাস্ট্রিজ (আই ডব্লিউ আই) ও আদানি এন্টারপ্রাইজেস-এর মধ্যে পার্টনারশিপ সংস্থা হলো পি এল আর সিস্টেমস প্রাঃ লিঃ। কোম্পানির ওয়েবসাইটে দাবি করা হয়েছে এটা হল ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র এক উজ্জ্বল নিদর্শন। এই লোলুপ শিল্পপতি ইতিহাসে ইজরায়েল-ভারত-এর মধ্যে বৃহত্তম চুক্তিগুলোর একটা সম্পাদন করে ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে যখন তারা ইজরায়েলের হাইফা বন্দরের একটা অংশের অধিকার পায়। গাজায় ইজরায়েলের হাতে প্যালেস্তিনীয়দের হত্যা যখন অব্যাহত রয়েছে আদানি এলবিট সংস্থা তখন ইজরায়েলের সামরিক বাহিনীকে ২০টা হার্মেস ৯০০ ড্রোন দিয়েছে। প্যালেস্তিনীয়দের পৈশাচিক গণহত্যা অব্যাহত থাকায় বেশ কিছু দেশই যখন ইজরায়েলের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছে, আদানি তখন ঐ গণহত্যা থেকে মুনাফা কামাচ্ছে, রক্তে রঞ্জিত টাকায় পকেট ভরাচ্ছে।

প্যালেস্তাইন হয়ে রয়েছে যুদ্ধে ব্যবহৃত প্রযুক্তির একটা পরীক্ষাগার, আর ইজরায়েল গণহত্যার এই ‘সাফল্যকে’ সারা দুনিয়ার বাজারগুলোতে পাচার করছে। ব্যাপক হারে ধ্বংসসাধন এবং বেশি সংখ্যায় হত্যা সংঘটনের জন্য ইজরায়েলি ড্রোন ও নজরদারি প্রযুক্তি আক্রমণ হানে জন-অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে, স্কুল, হাসপাতাল এবং এমনকি এক-একটা বসত বাড়িতেও।

ভারতকে সবচেয়ে বেশি অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহকারী দেশগুলোর অন্যতম হল ইজরায়েল, আর কৃষকদের সাম্প্রতিক সময়ের প্রতিবাদকে বানচাল করতে ভারত ইজরায়েলের কাছ থেকেই ‘ড্রোন কসরত’ ধার নিয়েছে। এলবিট সিস্টেম হলো ইজরায়েলের বৃহত্তম অস্ত্র নির্মাণ কোম্পানি এবং তারা ইজরায়েলি ড্রোনের প্রায় ৮১ শতাংশ সরবরাহ করে থাকে। হার্মেস ৯০০ হল মানবহীন বায়ু শকট যার বহন ক্ষমতা ৩০০ কেজির মতো এবং একনাগারে কাজ করতে পারে ৩০ ঘণ্টা। এলবিট সিস্টেম এর নাম দিয়েছে আইএসটিএআর, এই আদ্যক্ষরগুলো দিয়ে বোঝানো হচ্ছে ইনটেলিজেন্স অর্থাৎ মেধা, সারভাইভাল্যান্স অর্থাৎ নজরদারীর ক্ষমতা, টার্গেটেড অ্যাকুইজিশন অর্থাৎ নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো এবং রিকনিসন্স বা শত্রুর অবস্থান নিরীক্ষণ। এই ড্রোনগুলো উচ্চ-বিশ্লষণ ক্ষমতায় বস্তুকে নির্দিষ্ট করতে পারে, লেসার ডেসিগনেটরের সাহায্যে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে বোমা বর্ষণ করতে পারে (এমনকি ঘন বসতিপূর্ণ এলাকাতেও) এবং বিস্তৃতভাবে নজরদারি চালাতে পারে। হার্মেস ৯০০র মতো মানবহীন বায়ু শকটগুলোকে পরিচালিত করা হয় ভূমি নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র থেকে যেগুলোর অবস্থান হয় লক্ষ্যবস্তু থেকে বহু মাইল দূরে, ফলে হত্যাকাণ্ড থেকে দূরত্ব এবং সংযোগহীনতা তৈরি হয়। মানবহীন বায়ু শকটগুলোর কাজ এমন হয় মনস্তত্ত্ববিদরা যেটাকে বলেন ‘ক্রীড়া ক্ষেত্রের মানসিকতা’, কেননা, তা বলতে গেলে ভিডিও গেম-এর মতনই। সেনা এবং তাদের কাজের পরিণামের মধ্যে এই নিদারুণ বিচ্ছিন্নতা প্যালেস্তিনীয় জনগণের গণহত্যায় ভারতের সচেতন ও স্বেচ্ছাকৃত অজ্ঞতা ও যোগসাজশকেই প্রতিধ্বনিত করে।

দক্ষিণ আফ্রিকা ২০২৩-এর ২৯ ডিসেম্বর ইজরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে ১৯৪৮-এর গণহত্যা সম্পর্কিত কনভেনশন লঙ্ঘনের যে অভিযোগ দায়ের করেছিল, আদালত সে সম্পর্কে ২০২৪-এর ২৬ জানুয়ারি কিছু তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপের কথা বলে। আদালত দক্ষিণ আফ্রিকার আনা অভিযোগকে গণহত্যার যুক্তিগ্রাহ্য দাবি বলে অনুমোদন করে। আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালত তাদের রায়ে ইজরায়েলকে প্যালেস্তিনীয়দের হত্যা করা অথবা দৈহিক বা মানসিক আঘাত প্রদান থেকে নিবৃত্ত হতে বলে। তারা ইজরায়েলের প্রতি এই নির্দেশও দেয় যে, ইজরায়েলেকে “অবিলম্বে এবং ফলদায়ী  ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে জরুরি প্রয়োজনীয় মৌলিক পরিষেবা ও মানবতাবাদী সহায়তা পৌঁছানো সম্ভব হয়।” এই ঐতিহাসিক নির্দেশ ভারত-সহ আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতের অন্যান্য দেশ ও গণহত্যা সম্পর্কিত কনভেনশনের স্বাক্ষরকারীদের ওপর একটা নৈতিক ও আইনি দায়বদ্ধতা অর্পণ করেছে যা হলো ইজরায়েলের সামরিক বাহিনীর কার্যকলাপে অর্থ জোগানো থেকে নিবৃত্ত হতে হবে অথবা কোনোভাবেই তাতে সহায়তা করা যাবে না। আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতের রায়কে ইজরায়েল এখনও পর্যন্ত উপেক্ষা করেই এসেছে এবং গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে যার পরিণাম হচ্ছে সর্বনাশা।

বেআইনি ঘোষিত প্যালেস্তিনীয় শ্রমিকদের অপসারিত করতে ইজরায়েলে ভারতের পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়োগে ভারত যে গুরুত্ব দিচ্ছে আমরা তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছি। ইজরায়েলি হানাদারিতে সহযোগিতা ছাড়াও দেখা যাচ্ছে যে, আমাদের আধা-বেকার ও দরিদ্র সম্পূর্ণ বেকারদের নিরাপদ, সুরক্ষিত ও ভদ্রগোছের আয়ের কাজ প্রদানের দায়িত্বকে ভারত সরকার পরিত্যাগ করছে।

খণ্ড-31
সংখ্যা-9