আদ্যাক্ষর অনুসারে ‘ইন্ডিয়া’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠা ঐক্যবদ্ধ বিরোধী পক্ষের প্রতিনিধিরা যখন মুম্বাইয়ে তাঁদের তৃতীয় বৈঠকে মিলিত হচ্ছেন তখন মোদী সরকার আচানক ১৮ থেকে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সংসদের বিশেষ অধিবেশন হবে বলে ঘোষণা দিলেন। সংসদের বাদল অধিবেশন সদ্য শেষ হয়েছে, এরমধ্যেই যেভাবে এই বিশেষ অধিবেশনের কথা ঘোষণা করা হল, বিরোধীপক্ষের সাথে কোনোরকম আলোচনা ছাড়াই সম্পূর্ণ একতরফাভাবে এবং প্রতিষ্ঠিত সংসদীয় নিয়মনীতি উল্লঙ্ঘন করে, তা স্বাভাবিকভাবেই সরকারের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দেহ জাগিয়েছে। পাঁচ দিনের এই সদনে প্রাত্যহিক প্রশ্নোত্তর পর্ব ও প্রথাগত ‘জিরো আওয়ার’ বলে কিছু থাকবে না, এবং সেখানে কোনো এজেণ্ডা নিয়ে চর্চা হবে সেটাও মানুষকে জানানো হয়নি। প্রত্যেক দিনই মোদী সরকার আমাদের এই গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের নির্বাচিত সংসদকে একটু একটু করে খর্ব করে নবাবের দরবারে পর্যবসিত করছে।
আরেক হঠাৎ পদক্ষেপে, সংসদ, রাজ্য বিধানসভা, পঞ্চায়েত ও পুরসভা ভোট একসাথে করার বিষয়ে সুপারিশ করতে ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের নেতৃত্বে একটি উচ্চস্তরীয় কমিটি ঘোষণা করে দেয় মোদী সরকার। সংবিধানের নিরিখে সন্দেহজনক এবং রাজনৈতিকভাবে বিতর্কিত একটি বিষয়ে সুপারিশের জন্য এভাবে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতিকে চেয়ারে রেখে কমিটি বানানো দেখিয়ে দিচ্ছে যে মোদী সরকার সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে চরমভাবে লঙ্ঘন করে নিজের রাজনৈতিক এজেণ্ডা চাপিয়ে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। কমিটিতে বিরোধীপক্ষ থেকে মাত্র একজনকে রাখা হয়েছে, লোকসভার বিরোধি দলনেতা কংগ্রেসের অধীর রঞ্জন চৌধুরিকে, যিনি এই কমিটিতে থাকতে অস্বীকার করেছেন, কারণ এটা একটা সন্দেহজনক কমিটি যেখানে রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতার বদলে এক বিজেপি ঘনিষ্ঠ প্রবীণ সদস্যকে রাখা হয়েছে এবং এই কমিটিটা বানানোই হয়েছে ‘এক দেশ, এক ভোট’ এজেণ্ডাকে শীলমোহর দিতে।
‘এক দেশ, এক ভোট’ অনেক দিন ধরেই মোদী সরকারের লালিত পালিত আকাঙ্খা। আইন কমিশন থেকে শুরু করে নীতি আয়োগ পর্যন্ত বিভিন্ন সংস্থা ইতিমধ্যেই বিষয়টির নানা দিক খতিয়ে দেখেছে এবং এই প্রস্তাবকে অত্যন্ত সমস্যাজনক ও বিতর্কিত হিসেবেই সাব্যস্ত করেছে। কারণ এটা বাস্তবায়িত করতে সংবিধানে একগুচ্ছ সংশোধনী আনতে হবে এবং বিরোধী দলগুলিকে ও বিভিন্ন রাজ্যের সরকারগুলিকে ঐকমত্যে আনতে হবে। এখন যেভাবে এটা করা হচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে কোনোরকম ঐকমত্য ছাড়াই ওপর থেকে বিষয়টা চাপিয়ে দেওয়া হবে। যে কমিটি বানানো হল তা বিজেপি নেতা, সরকারপন্থী সদস্য ‘এক দেশ, এক ভোট’ আইডিয়ার পরিচিত প্রবক্তায় ভরা। ফলত কমিটির মত কী হবে তা আগেভাগেই নির্ধারিত হয়ে আছে। ইলেক্টোরাল বণ্ডের প্রবর্তন করে সরকার ইতিমধ্যেই নির্বাচনী তহবিলে অর্থদানের বিষয়টিকে অস্বচ্ছ ও হিসাবহীন করে দিয়েছে। নির্বাচন কমিশনকে মনোনীত করার বিষয়ে যে নতুন আইনপ্রস্তাব আনা হয়েছে তা নির্বাচন কমিশনের সবরকম স্বায়ত্ত্বতা ও নিরপেক্ষতা কেড়ে নিয়ে তাকে কার্যনির্বাহী প্রশাসনের অধীনস্থ করে দেবে। এবং এবারে একসাথে সব ভোট চাপিয়ে দিয়ে মোদী সরকার নির্বাচনী প্রক্রিয়াকেই চরম বিদ্রুপে পর্যবসিত করবে।
‘এক দেশ, এক ভোট’এর সমর্থনে সরকারের মূল যুক্তি হল, এরফলে খরচ বাঁচবে আর নির্বাচনী আচরণবিধির বাধায় মাঝে মাঝেই উন্নয়নের থমকে যাওয়া গতিকে মসৃণ ও ত্বরান্বিত করবে। দুটোই অত্যন্ত ছেঁদো যুক্তি। ভোটখরচের সিংহভাগই করে রাজনৈতিক দলগুলি, এবং সম্পূর্ণ সন্দেহজনক উৎস থেকে পাওয়া বিপুল অর্থ খরচ করে বিজেপি দলটিই ভোটকে টাকার খেলায় পর্যবসিত করার মূল কালপ্রিট। নির্বাচনে আদর্শ আচরণবিধি (যা নতুন পলিসি বা প্রকল্প ঘোষণার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে) কেবল ভোটবদ্ধ রাজ্যগুলিকে প্রভাবিত করে, দেশজুড়ে উন্নয়নের গতি ‘থমকে’ যায় না। ভোটের সময় তথাকথিত যে ব্যাঘাত সাময়িকভাবে ঘটে তা নোটবন্দী বা প্রলম্বিত লকডাউনের মতো ভুল পদক্ষেপের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির তুলনায় কিছুই না।
এ’কথাও বলা হচ্ছে যে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত ভারতে লোকসভা ও বিধানসভার ভোট একসাথেই হত। কিন্তু আসল কথা হল, এরজন্য কোনো সাংবিধানগত সমর্থনের প্রয়োজন ছিল না, ঘটনাচক্রেই একসাথে ভোট চলে আসছিল। ১৯৬৭ সালের পর এই চলতি চক্র ভেঙে যেতে থাকে বেশ কিছু কারণে। মূল মূল কয়েকটি কারণ উল্লেখ করতে হলে বলা যায় — বেশ কিছু সরকার মেয়াদ উত্তীর্ণ করার আগেই পড়ে যাওয়ায় মধ্যবর্তী সময়েই নির্বাচন সংগঠিত করতে হয়, নতুন নতুন রাজ্য তৈরি হয়, আঞ্চলিক দলগুলির উত্থান ঘটে, জোটযুগ সামনে আসে (যা আগেকার একক পার্টি প্রাধান্যকে চ্যালেঞ্জ করে) এবং গণতন্ত্রের তৃতীয় স্তর হিসেবে স্থানীয় সংস্থাগুলির নির্বাচন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। এখন যদিও আরেকবার সময়কে কৃত্রিমভাবে পেছনের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা চলছে, কিন্তু তথাপি এই যুগপৎ ভোটের চক্রকে চালিয়ে যেতে জনগণকে নির্বাচিত সরকার পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে মধ্যবর্তীকালীন নির্বাচনের প্রবিধান লুপ্ত করতে হবে এবং রাজ্যগুলিতে রাষ্ট্রপতি বা রাজ্যপাল বা লেফটেনান্ট গভর্নরের শাসন জারি করতে হবে। ২০১৯’র ৫ আগস্ট থেকে জম্মু ও কাশ্মীরে এটাই চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। ‘এক দেশ, এক ভোট’ ফর্মুলা কি তাহলে জম্মু ও কাশ্মীরের কায়দায় সমগ্র ভারতে ক্ষমতার অতিকেন্দ্রীকতাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার অপচেষ্টা?
এ’কথা সকলেই জানেন যে মোদী সরকার সারাক্ষণই ভোটের মোডে থাকে, ভোটের রাজ্যগুলিতে নির্বাচনী সমাবেশে ভাষণ দেওয়টাই সর্বদা নরেন্দ্র মোদীর প্রধানতম অগ্রাধিকার থাকে। মোদী মণিপুর পরিদর্শনে যাওয়ার সময় পান না, কিন্তু কর্ণাটক থেকে মধ্যপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ থেকে রাজস্থান লাফিয়ে বেড়ান ভোটসভা আর বুথ কর্মীসভায় ভাষণ দিতে, রোডশোতে হাত নাড়াতে। এখন হঠাৎ বিধাননসভা ও লোকসভা ভোটকে একসাথে জুড়ে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে কেন? স্পষ্টতই একটার পর একটা রাজ্য নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে ক্ষমতা হারিয়ে ফেলার ভয়ের সাথে এর একটা জোরালো সম্পর্ক আছে। পরিসংখ্যান আপাতভাবে এটাই দেখায় যে আলাদা আলাদা ভোট হওয়ার চেয়ে বিধানসভা ও লোকসভায় একসাথে ভোট হলে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলের জেতার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। এটাও স্পষ্ট যে ‘মোদী ফ্যাক্টর’ বিধানসভার চেয়ে লোকসভাতেই একটু বেশি কাজ করে। তাই ব্যবস্থাপনাটা বদলে দিয়ে ফায়দা তুলতে মরিয়া।
এই প্রকল্পের পেছনে অবশ্যই সংঘ-বিজেপির ক্ষমতা অতিকেন্দ্রীরণের এবং ভারতের বিবিধতার সংস্কৃতিকে, বহুত্ববাদী রাজনীতিকে ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ক্রমাগত দুর্বল করে দেওয়ার অভিসন্ধি কাজ করছে। প্রত্যেক নির্বাচনের নিজস্ব প্রেক্ষিত আছে। পঞ্চায়েত ও বিধানসভা নির্বাচনে তাৎক্ষণিক স্থানীয় পরিস্থিতি প্রতিফলিত হতে বাধ্য এবং সংঘ-সৃষ্ট তথাকথিত ‘জাতীয় বাস্তবতা’ তা ভাসিয়ে নিতে পারে না, যদি না তার ভাঙ্গা কাঁসরের কর্কস আওয়াজ সবকিছুকে ঢেকে দেয়। সব ভোটকে এক বন্ধনীতে এনে ফেলে মোদী সরকার নির্বাচনগুলির নিজ নিজ প্রেক্ষিত কেড়ে নিতে চায় এবং জনগণের রাজনৈতিক পছন্দকে সংকুচিত করে ফেলতে চায়। মোদীর হিন্দী-হিন্দু-হিন্দুস্তান জমানার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রীয় ভারত এক প্রাণবন্ত বিরোধীপক্ষ ও দৃঢ়সংকল্প প্রতিরোধ খাড়া করতে পারে, হিন্দী বলয়ের বাইরের রাজ্যে রাজ্যে ক্রমবর্ধমান সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আলোড়নের মধ্যে দিয়ে যা খুবই স্পষ্ট হয়ে উঠছে (এবং হিন্দী বলয়ের অভ্যন্তরেও তা বেড়ে চলেছে)। ‘এক দেশ, এক ভোট’ এই আলোড়নগুলিকে খর্ব করার এবং গণতান্ত্রিক ভারতকে ফ্যাসিবাদী শাসনের রাজকীয় ছকে আনার ফর্মুলা। ক্ষমতাপ্রাপ্ত স্বাধীন নাগরিককে অনুগত প্রজার স্তরে নামিয়ে আনতে, ভারতকে ফ্যাসিবাদের নাগপাশে বেঁধে দাস বানাতে, আইন, শাসন ও সাংবিধানিক কাঠামোর ক্ষেত্রে যে বহুবিধ প্রচেষ্টা ওরা চালাচ্ছে তারই অঙ্গ এই ছক। যেকোনো উপায়ে এই ছককে আটকাতে হবে ভারতকে।
- এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩