(‘এমটি ক্লাসরুমস্ অ্যান্ড র্যাপিডলি ক্লোসিং স্কুলস্ স্পেল ডুম ফর বেঙ্গলস্ চিল্ড্রেন’ — এই শিরোনামে ‘দ্য ওয়্যার’এ প্রকাশিত এক চমৎকার অন্তর্তদন্ত রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থার প্রকৃত অবস্থাকে তুলে ধরেছে। বর্তমানে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থায় নেমে আসা অরাজক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রবন্ধটির নির্বাচিত অংশ প্রকাশ করা হল। শিরোনাম আমাদের — সম্পাদকমন্ডলী, দেশব্রতী।)
ক্রমে ক্রমে গভীর অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে রাজ্যের সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা।
একটা ছোট্ট উদাহরণ দিয়ে শুরু করা যাক। কসবার মডার্ণ ইন্সটিটিউশন ফর গার্লসের গোড়াপত্তন হয় ১৯৬৭-এ। কয়েকবছর আগে পর্যন্ত এই স্কুলটি রীতিমতো সরগরম থাকতো পড়ুয়াদের উপস্থিতিতে। কিন্তু আজ? সরকার পোষিত এই স্কুলে সাতজন শিক্ষক প্রতিদিন আসছেন নিজেদের উপস্থিতি রেকর্ড করাতে কিন্তু সেখানে নেই একজনও পড়ুয়া!
এটা কোনো বিচ্ছিন্ন উদাহরণ নয়। এরকম প্রায় ২৫৩টি সরকার পোষিত স্কুল রয়েছে, যারা একই সমস্যায় আক্রান্ত। ব্ল্যাক বোর্ড রয়েছে, কিন্তু স্কুলগুলোর ডেস্ক ফাঁকা। সেখানে নেই একজনও পড়ুয়া।
রাজ্য সরকার ঘোষণা করে দিয়েছে, যে স্কুলগুলোতে ৩০’র কম পড়ুয়ায় এসে ঠেকেছে, এমন ৮,২০৭টি প্রাইমারী ও সেকেন্ডারি স্কুল চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া হবে, যা সমগ্র সরকারি স্কুলের প্রায় ১০ শতাংশ! কারণ হিসাবে বলা হয়েছে আর্থিক সংকট আর শিক্ষাক্ষেত্রে আর্থিক উৎসগুলোকে আরো নিশ্চিত ও মজবুত করার পরিকল্পনা নাকি সরকারের রয়েছে।
আলিপুরদুয়ারের পাহাড়ি অঞ্চল কালচিনিতে ২১টি চা বাগিচা রয়েছে। সেখানে ৩৭টি সরকার পোষিত স্কুল বন্ধ হওয়ার মুখে। এই স্কুলগুলোতে চা বাগিচায় কর্মরত আদিবাসী পরিবার থেকে আগত বিরাট সংখ্যক ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করে। অনেক পরিবার এখন বেসরকারি ইংরাজি মাধ্যম স্কুলে তাঁদের ছেলে মেয়েদের ভর্তি করাতে বাধ্য হচ্ছেন। নাগালের মধ্যে স্কুল থাকার যে আইন রয়েছে, তা পুরোপুরি লঙ্ঘিত হচ্ছে। শিশু কিশোরদের ওই সমস্ত বনাঞ্চল ঘেরা অঞ্চলে বিরাট ঝুঁকি নিয়ে একা একা স্কুলে যাতায়াত করতে হবে কারণ তাদের মা বাবারা চা বাগিচায় কর্মরত।
গতবছর, সোদপুর সুশীল কৃষ্ণ শিক্ষায়তনে সুমন দাস চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিল। তার শ্রেণিকক্ষে পড়ুয়ার সংখ্যা ক্রমে কমতে থাকায় তার অভিভাবকেরা তাকে ৫ কিলোমিটার দূরের একটা স্কুলে ভর্তি করাতে বাধ্য হন। ওই স্কুলে এখন রয়েছে মাত্র পাঁচজন ছাত্র, কিন্তু সর্বক্ষণের শিক্ষকের সংখ্যা ১৩! সুমনের আগের স্কুলটি ছিল হাঁটা পথ। কিন্তু এখন বেশ দূরে অবস্থিত নতুন স্কুলে যাতায়াতের জন্য তাকে অটো নিতে হয়, যারজন্য বাড়তি খরচ পরিবারকে বইতে হচ্ছে।
এরাজ্যে ৮৪ শতাংশ ছাত্রছাত্রী সরকারি বা সরকার পোষিত স্কুলের পড়ুয়া। রাজ্য সরকার স্কুলে পাঠানোর জন্য পরিবারগুলোকে উৎসাহিত করতে কন্যাশ্রী সহ আরও কিছু প্রকল্প চালু করে। এরমধ্যে কন্যাশ্রী প্রকল্পটি বিশেষ করে ছাত্রীদের স্কুলে পাঠানোর লক্ষ্যেই পরিচালিত, যা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও, মাধ্যমিক পর্যন্ত টিকে থাকা ছাত্রীর সংখ্যা ক্রমেই তলানিতে এসে ঠেকছে। ২০২৩-এ মাত্র ৬.৯৯ লক্ষ পড়ুয়া মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসে, ২০২২-এ ছিল ১০.৯৮ লক্ষ অর্থাৎ ৩৬ শতাংশ কম, আর ২০২১-এ এই সংখ্যাটি ছিল ১১.১৮ লক্ষ। দেখাই যাচ্ছে, যত দিন যাচ্ছে, ততই মাধ্যমিকে বসার সংখ্যাটা হ্রাসপ্রাপ্ত হচ্ছে।
রাজ্য সরকারের প্রস্তুত করা ২০২২’র একটা রিপোর্ট দেখাচ্ছে, সরকারি স্কুলগুলোতে ভর্তির সংখ্যা বিপুল হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। অতিমারীর সময়ে সবচেয়ে লম্বা সময় পর্যন্ত স্কুল বন্ধ থাকা সত্ত্বেও সরকারি স্কুলগুলোতে (৬ থেকে ১৪ বছরের পড়ুয়াদের ক্ষেত্রে) ভর্তির সংখ্যা যা ২০১৮ সালে ছিল ৮৮.১ শতাংশ, তা ২০২১এ বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৯২.২ শতাংশ!
রাজ্যজুড়ে প্রাইমারী, আপার প্রাইমারী, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্কুলগুলোতে সর্বমোট ১,১০,০০০ শূন্যপদ রয়েছে, যারমধ্যে ৬৯ শতাংশই গ্রামীণ এলাকায় অবস্থিত। গত ১১ বছরে রাজ্য থেকে ৭,০০০ স্কুল উবে গেল — ২০১২-তে ৭৪,৭১৭ প্রাইমারী স্কুল কমতে কমতে ২০২২-এ ৬৭,৬৯৯-এ এসে দাঁড়ায়। একটা টাটকা উদাহরণ দেওয়া যাক।
দমদমে অমৃত লাল ওঝা বিদ্যামন্দিরের জমি রিয়েল স্টেট প্রজেক্টের জন্য নিয়ে নেওয়ায় স্কুলটাই অবলুপ্তই হয়ে গেল!
কয়েক বছর আগে রাজ্য সরকার শিক্ষক বদলির এক স্কিম চালু করে। এরফলে অসম হারে শিক্ষক ছাত্র অনুপাত তৈরি হল। দক্ষিণ ২৪ পরগণার কুলতলি মডেল স্কুলে মাত্র ২২ জন ছাত্রর জন্য আটজন সর্বক্ষণের শিক্ষক রয়েছে। বিপরীতে, একই জেলার কল্যাণপুর হাই স্কুলে ২,০০০ ছাত্রের জন্য রয়েছে মাত্র ২৪ জন শিক্ষক।
রাজ্য স্কুলে শিক্ষক নিয়োগের যে অভূতপূর্ব দুর্নীতি চরম ক্লেদাক্ত, দেউলিয়ে চিত্রকে ফুটিয়ে তুলল, তার প্রভাব অপরিসীম। এখন অভিভাবকদের মনোভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে, “দুর্নীতির রাস্তা ধরে যারা আজ শিক্ষক হয়ে ঢুকেছেন, তাঁদের হাতে নিজের সন্তান সন্ততিদের ভবিষৎ আমরা তুলে দেব না।” নজীরবিহীন এই বিশ্বাসভঙ্গ, আস্থাহীনতা আজ গোটা রাজ্যজুড়ে গ্রাস করেছে। আর, এই আবহে, বাধ্যতামূলক ভাবে অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানদের ভর্তি করাচ্ছেন বেসরকারি স্কুলগুলোতে, গুচ্ছ গুচ্ছ টাকার বিনিময়ে।