পরিমার্জিত নয়া পেনশন প্রকল্পের পরিবর্তে পুরনো পেনশন প্রকল্পই অভিপ্রেত
new-pension-scheme

পর্যাপ্ত পরিমাণ পেনশনের জন্য আন্দোলন সারা বিশ্বেই যথেষ্ট গুরুত্ব নিয়ে সামনে আসছে, এবং তা আসছে নয়া-উদারবাদী নীতি চালু হওয়ার পরবর্তী পর্যায়ে এবং তার প্রয়োগের পরিণাম স্বরূপ; এই নয়া-উদারবাদী নীতি বৈশ্বিক পুঁজির কাছে হয়ে উঠেছে কেইনস পরবর্তী পর্যায়ে উদ্ভূত সংকট থেকে পরিত্রাণের এক সর্বরোগহর দাওয়াই। নয়া-উদারবাদী নীতি প্রবর্তনের সাথেই কল্যাণরাষ্ট্রের ধারণার অবসানের শুরু হয়ে যায়। পেনশন-সহ সামাজিক নিরাপত্তার বেসরকারিকরণ পেনশন সংকটকে তীব্রতর করে তুলেছে। সুনির্দিষ্ট সুবিধা হিসাবে পেনশন প্রকল্পের ধারণার বিলোপ ঘটে কনট্রিবিউটরি বা মালিক ও কর্মচারী উভয়ের দান ভিত্তিক পেনশন প্রকল্পের প্রবর্তনের সঙ্গে। পেনশন-সহ সমগ্ৰ সামাজিক নিরাপত্তার ভার এখন বর্তেছে কর্মচারীদের ঘাড়েই। কর্মচারীদের প্রবীণ বয়সে তাদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বকে ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলছে সরকার ও নিয়োগকর্তারা। পেনশনের ইস্যুটা প্রবীণ বয়সে দারিদ্রের ইস্যু বৈ অন্য কিছু নয়।

পেনশন একটা রাজনৈতিক ইস্যু

দেশে কর্মচারীদের আন্দোলনের চাপ অসহনীয় হয়ে ওঠায় এবং বিজেপি শাসিত কেন্দ্র সরকারের বিরুদ্ধে ভিন্ন এক ধারণা হাজির করাটা জরুরি হয়ে দেখা দেওয়ায় অবিজেপি শাসিত রাজ্য রাজস্থান, ছত্তিসগড়, ঝাড়খণ্ড, পাঞ্জাব ও হিমাচলপ্রদেশ পুরনো পেনশন প্রকল্প ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রের মোদী পরিচালিত বিজেপি সরকার পেনশন তহবিল নিয়ন্ত্রক ও বিকাশ কতৃপক্ষের (পিএফআরডিএ) মাধ্যমে এই পদক্ষেপে বাধা সৃষ্টি করছে এবং তা করছে ২০০৪ সাল থেকে জাতীয় পেনশন প্রকল্পের নামে ঐ সমস্ত কর্মচারীদের থেকে সংগৃহীত অর্থ ফেরত দিতে অস্বীকার করে।

পেনশনের ইস্যুটা আর প্রান্তিক ইস্যু নয় এবং ২০২৪’র সংসদীয় নির্বাচনের আগে এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ইস্যু হিসাবে তীব্রতর হয়ে উঠছে। উত্তরপ্রদেশ ও হিমাচলপ্রদেশের মতো কয়েকটা রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে এটা এক বড় ধরনের রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে উঠেছিল। সরকারি কর্মচারীদের আন্দোলনের দাবি পূরণের লক্ষ্যে বিজেপি এবং অন্য দু’একটি দল ছাড়া বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলকেই পুরনো পেনশন প্রকল্প ফিরিয়ে আনার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিতে হয়ছিল। এই প্রেক্ষাপটেই অর্থমন্ত্রী তাঁর শেষ বাজেট বক্তৃতায় অর্থ সচিবের নেতৃত্বে একটা কমিটি গঠনের কথা ঘোষণা করেন যারা নয়া পেনশন প্রকল্পের ইস্যুগুলোকে খতিয়ে দেখবে এবং নয়া পেনশন প্রকল্পের উন্নতি সাধনের বিষয়টির বিবেচনা করবে, তা যদিও পুরনো পেনশন প্রকল্পকে ফিরিয়ে আনার কর্মচারী আন্দোলনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। এমন একটা জল্পনা রয়েছে যে, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিসগড়, তেলেঙ্গানা রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের আগে মোদী নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার কিছু বেশি পরিমাণের পেনশন সহ উন্নত নয়া পেনশন প্রকল্পের ঘোষণা করতে পারে। সরকার যে পুরনো পেনশন প্রকল্পকে ফিরিয়ে আনবে না, বর্তমানের নয়া পেনশন প্রকল্পে কিছুটা উন্নতিসাধনই করতে পারে এই ব্যাপারে সে তার অভীষ্টকে পরিষ্কার করে দিয়েছে।

নয়া-উদারবাদী যুক্তি এবং অতি মুনাফা

গড় আয়ু ১৯৪৭ সালে যেখানে ছিল ৩২ বছর ২০২০ সালে সেই আয়ু বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০ বছরে, এই পটভূমিতে পেনশনের দাবি প্রবীণ বয়সে দারিদ্র্য থেকে রেহাই পাওয়ারই একটা প্রচেষ্টা। নয়া-উদারবাদী অর্থনৈতিক দর্শনে চালিত সারা বিশ্বের দেশগুলোই পেনশনের কারণে অর্থনীতির ওপর আর্থিক চাপকে কমাতে চাইছে একদিকে অবসর গ্ৰহণের বয়সকে বাড়িয়ে এবং অন্য দিকে পেনশনকে নিয়োগকর্তা ও কর্মচারীদের দান ভিত্তিক কন্ট্রিবিউটরি প্রকল্পে পরিণত করার মধ্যে দিয়ে। অঢেল মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে চালিত হয়ে বৈশ্বিক পুঁজি অনুসৃত এই দৃষ্টিভঙ্গি সামাজিক দিক থেকে দায়িত্ত্বজ্ঞানহীন ও অবৈজ্ঞানিক।

প্রবীণ মানুষদের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান

ভারতীয় জনগণ তুলনামূলকভাবে তরুণ এবং ২০৫০ নাগাদ প্রবীণদের সংখ্যার বৃদ্ধি ঘটবে বলে মনে করা হচ্ছে। আনুমানিক হিসাব বলছে, ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের জনগণের ৩০ শতাংশ এবং ভারতীয় জনগণের ২০ শতাংশ প্রবীণ হয়ে গিয়ে পেনশনের উপর নির্ভরশীল হবেন। আনুমানিক হিসাব এটাও বলছে যে প্রতি বছর ৫০ লক্ষেরও বেশি জনগণ ৬০ বছরের অধিক বয়স্ক জনগণের সংখ্যায় যোগ দিচ্ছেন।

জাতীয় নমুনা সমীক্ষা অফিসের (এনএসএসও) রিপোর্ট জানাচ্ছে, ১৯৬১ সালে ভারতীয় জনগণের ৫.৬ শতাংশ ছিল ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সের জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত, আর ২০২১ সালে ঐ অনুপাতটা এসে দাঁড়িয়েছে ১০.১ শতাংশে। ‘ভারতের এবং রাজ্যগুলির জনসংখ্যার পূর্বাভাস–২০১’ টেকনিক্যাল গোষ্ঠীর রিপোর্ট অনুসারে, ২০২১ সালে ভারতে প্রবীণ জনগণের সংখ্যা ছিল ১৩.৮ কোটি এবং ২০৩১ সাল নাগাদ ঐ জনসংখ্যার আরও বৃদ্ধি ঘটবে ৫.৬ কোটি।

পেনশন কোনো দাক্ষিণ্য নয়, বরং একটা অধিকার

সরকার বলছে যে প্রবীণ বয়সের জনগণ এমন একটা দুর্বহ ভার যা অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। কিন্তু তার নিজেরই প্রবীণ বয়সের কর্মচারীদের প্রতি তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সরকার নীরবই থাকে। তার কর্মচারীদের প্রবীণ বয়সের ইস্যুগুলোর দেখভালের দায়িত্ব সরকারেরই। এই জনগণই তো তাদের যৌবন কালে দেশ ও সরকারের সেবা করেছে। আর তাই তাদের প্রবীণ বয়সে এক ভালো মানের ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন প্রদানে সরকার দায়বদ্ধ। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো যে সরকারও মুনাফার মনোভাব নিয়ে চালিত হচ্ছে এবং প্রবীণ বয়সের কর্মচারীদের দেশ ও জনগণের করের উপর এক ভার বলে গণ্য করছে।

আমাদের দেশের সুপ্রিম কোর্ট ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন (আইএলও) সুস্পষ্ট ভাবেই বলেছে যে কর্মচারীদের দেয় পেনশন কোম্পানি বা সরকার প্রদত্ত কোনো দাক্ষিণ্য নয়, এটা কর্মচারীদের অধিকার। নিজেদের শ্রমের বিনিয়োগ থেকেই এই সুবিধা কর্মচারীদের প্রাপ্য। তাদের সম্মতি ছাড়া এর থেকে তাদের বঞ্চিত করা বা অন্য অভিমুখে চালিত করা যাবে না। পেনশন হল কর্মচারীদের বেতনের সেই অংশ যেটা কাজে নিয়োজিত থাকার সময় তাদের দেওয়া হয়নি। এ সত্ত্বেও সরকার সুনির্দিষ্ট সুবিধার পেনশন প্রকল্পকে সরিয়ে তার স্থানে কনট্রিবিউটরি বা মালিক ও কর্মচারীর দান ভিত্তিক পেনশন প্রকল্পের পরিকল্পনা ছকে যা ২০০৪ সাল থেকে কর্মচারীদের এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মগুলির জন্য অসুরক্ষিত ভবিষ্যতের সৃষ্টি করে চলেছে। সরকার কর্মচারীদের অধিকার অস্বীকার করে চলেছে এবং জবরদস্তি তাদের ভবিষ্যতকেও ছিনিয়ে নিচ্ছে।

পুরনো পেনশন প্রকল্প বনাম নয়া পেনশন প্রকল্প : সুবিধা বনাম মালিক ও কর্মচারীর অর্থ দান

নয়া পেনশন প্রকল্প সেই সমস্ত কর্মচারীদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য যারা ২০০৪ সাল থেকে সরকারি এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের কাজে যোগ দিয়েছে। পুরনো পেনশন প্রকল্পে পেনশন হিসাবে শেষ লাভ করা বেতনের ৫০ শতাংশ পাওয়াটা কর্মচারীদের কাছে সুনিশ্চিত ছিল। যে কাজ তাঁরা ৬০ বছর পর্যন্ত করেছেন তার জন্য প্রদত্ত শ্রম হলো তাঁদের বিনিয়োগ এবং পেনশন তহবিলের জন্য আলাদা করে কোনো অর্থ তাঁদের দিতে হতো না। পেনশনকে প্রাপ্য একটা সুবিধা হিসাবে গণ্য করা হতো এবং কর্ম জীবনে কৃত কাজের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ পেনশন কর্মচারীদের দেওয়া হতো। ধরা যাক, কোনো কর্মচারী অবসর গ্ৰহণের আগে শেষ মাসিক বেতন পেলেন ৩০,০০০ টাকা, সে ক্ষেত্রে প্রতি মাসে তাঁর লব্ধ পেনশন হতো ১৫,০০০ টাকা, এবং তার সঙ্গে লভ্য হতো মূল্যস্ফীতি জনিত মহার্ঘ ভাতা এবং সব মিলিয়ে প্রাপ্য পেনশন ধরা যাক হতো ২০,০০০ টাকা। এই পরিমাণ অর্থ প্রবীণ নাগরিককে বৃদ্ধ বয়সে দারিদ্রের হাত থেকে বাঁচাত।

কিন্তু নয়া পেনশন প্রকল্প হল কন্ট্রিবিউটরি প্রকল্প যাতে ২০০৪ সাল থেকে কাজ করা কর্মচারীদের তাঁদের বেতনের দিতে হয় ১০ শতাংশ, আর সরকার দেয় ১৪ শতাংশ। এর বিনিময়ে কর্মচারীরা বছরে ১০ শতাংশেরও কম সুদ পান। এর পিছনে বিভিন্ন কারণও কাজ করে, যথা, জমা করা টাকার পরিমাণ, অর্থ বাজারের খামখেয়ালিপনা, কত বছর কাজ করা হয়েছে, ইত্যাদি।

নয়া পেনশন প্রকল্প তহবিলের তত্ত্বাবধান করে দেশি এবং বিদেশী তহবিল পরিচালকরা। এই টাকা খাটানো হয় ফাটকাবাজির অর্থ বাজারে। ইউটিআই’এর ২৭ শতাংশ শেয়ার রয়েছে এমন এক বিদেশী আর্থিক কোম্পানির হাতে এবং বিভিন্ন বিষয়ে মতপার্থক্যগুলো সামনে আসছে। শেয়ার বাজারে খাটানো পেনশন তহবিল থেকে পাওয়া লাভ ওঠানামা করে এবং তাতে কখনো কখনো এমনকি লোকসানও হয় এবং কর্মচারীদের শেষমেষ দেওয়া পেনশনে তা জোরালো ছাপ ফেলতে পারে। তহবিল পরিচালক কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে পড়লে তার ধাক্কাটা কর্মচারীদেরই সইতে হয়। এরজন্য সরকার কর্মচারীদের কোনো গ্যারান্টি দেয় না, কোম্পানিগুলো যদিও তা পেয়ে থাকে।

নয়া পেনশন প্রকল্পকে এমনভাবে ছকা হয়েছে যাতে প্রদেয় পেনশন নির্দিষ্ট কর্মচারীর কর্মজীবনে সঞ্চিত ও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত অর্থের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয় এবং অবসর গ্ৰহণের পর তাদের প্রয়োজন ও সমস্যার দেখভালের দায়িত্ব নেওয়া হয় না। নয়া পেনশন প্রকল্পের বেশ কিছু ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি কর্মচারীরা ১০০০ থেকে ২০০০ টাকার বেশি পেনশন পাচ্ছেন না। ২০২২’র ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নয়া পেনশন প্রকল্পের অধীনে নথিবদ্ধ কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী এবং রাজ্য সরকারি কর্মচারীর সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ২২.৭৪ লক্ষ এবং ৫৫.৪৪ লক্ষ।

সরকারি কর্মচারীরা, বিশেষভাবে তরুণ প্রজন্মের কর্মচারীরা ভবিষ্যৎ অবসর জীবনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্ৰস্ত হবেন। এবং তা মূলত নয়া পেনশন প্রকল্পের অধীনে প্রাপ্য যৎসামান্য পেনশনের জন্য। পুরনো পেনশন প্রকল্পকে ফিরিয়ে আনার দাবি তাঁদের প্রবীণ, ‘অনুৎপাদনশীল’ জীবনে দারিদ্র্য প্রশমনের দাবি ভিন্ন অন্য কিছু নয়। এই দাবি শেষ পাওয়া বেতনের ৫০ শতাংশ পেনশন ও তার সাথে মহার্ঘ ভাতা লাভের দাবি যাতে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষতি পুষিয়ে যায়। যে কর্মচারীরা ২০০৩’র পর কাজে যোগ দিয়েছেন তাঁরাই হলেন পুরনো পেনশন প্রকল্পকে ফিরিয়ে আনার আন্দোলনের বর্তমান পর্যায়ের মেরুদণ্ড। সরকার তরুণ কর্মীদের দাবিতে গুরুত্ব না দিলে তার ফল তাদের ভোগ করতে হবে।

কর্মচারীদের পেনশন প্রকল্প (ইপিএস)

প্রভিডেন্ট ফান্ডের অধীনে আরেকটা পেনশন প্রকল্প রয়েছে যার আওতায় রয়েছে মূলত বেসরকারি ক্ষেত্রের কর্মচারীরা এবং যারা ১৫,০০০ টাকা পর্যন্ত বেতন পায়। তারা পেনশন তহবিলে বেতনের ১২ শতাংশ দেয় এবং মালিকও ঐ একই পরিমাণ অর্থ তাদের অ্যাকাউন্টে জমা করে। শ্রমিক এবং পরিচালক কর্তৃপক্ষ মিলে যে ২৪ শতাংশ অর্থ জমা করে তার ৮.৩৩ শতাংশ যায় পেনশন তহবিলে এবং বাকিটা অবসর গ্ৰহণের পর কর্মচারীকে সুদসহ ফিরিয়ে দেওয়া হয়। চূড়ান্ত বিশ্লেষণে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে ব্যাপক সংখ্যাধিক কর্মচারীই ১০০০ টাকার ন্যূনতম পেনশনই পাচ্ছেন এবং প্রবীণ বয়সে দারিদ্র্য মোকাবিলায় পরিস্থিতির সঙ্গে যুঝতে থাকেন। এক ভদ্রস্থ ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপনের জন্য পেনশন বৃদ্ধির কোনো পরিকল্পনাই সরকারের নেই।

অটল পেনশন যোজনা (এপি ওয়াই)

মাসে ১০০০ থেকে ৫০০০ টাকা পেনশনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে অটল পেনশন যোজনা চালু হয়েছিল। অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের এই পেনশন প্রকল্পের আওতায় আনার জন্য পেনশনের প্রতিশ্রুতি ছিল তহবিলে শ্রমিকের দান করা অর্থের বিবেচনায় ১০০০ টাকার কয়েক গুণ। এই প্রকল্পে যোগদান করতে পারে ১৮ থেকে ৩৯ বছর বয়স্ক পর্যন্ত শ্রমিকরা এবং তাদের অন্তত ২০ বছর পেনশনের অর্থ মাসে দিয়ে যেতে হয়। শ্রমিকের বয়স ৪০ বা তার বেশি হলে তারা এই প্রকল্পে যোগদান করতে পারে না। কোনো শ্রমিক ৫০০০ টাকা পেনশনকে বেছে নিলে তাকে মাসে ২১০ টাকা (১৮ বছর বয়স্ককে দিয়ে যেতে হবে ৪২ বছর) এবং ১৩১৮ টাকা (৩৯ বছর বয়স্ককে দিয়ে যেতে হবে ২১ বছর) পেনশন প্রকল্পে দান করতে হবে।

এনপিএস-লাইট হল অসংগঠিত শ্রমিকদের পেনশনের আওতায় আনার আর একটা প্রকল্প।

এই প্রকল্পগুলিতে পেনশনকে বেছে নেওয়া শ্রমিকদের সংখ্যা ২০১৮’র জুলাইয়ে দাঁড়িয়েছিল ১.৫৭ কোটিতে। এ সত্ত্বেও তারা ছিল দেশের অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের মোট সংখ্যা ৩৯.১৪ কোটির (২০১১’র জনগণনা অনুসারে) মাত্র ৪ শতাংশ।

কাজে যুক্ত থেকেও দারিদ্র্য

দেশে শ্রমশক্তির বৃদ্ধি ক্রমান্বয়ে হয়ে চলেছে অবিধিবদ্ধ ক্ষেত্রে এবং তার পরিমাণ ৯৩ শতাংশ; এঁরা কিন্তু এমন নিরাপদ বা উৎকৃষ্ট কাজ ও মজুরি পান না যা দিয়ে তাঁরা ভবিষ্যতে পেনশন লাভের জন্য অর্থ দান করতে পারেন, এবং এটা যথেষ্ট উদ্বেগের বিষয়। এই বিষয়টার বিহিত একমাত্র হতে পারে অপর্যাপ্ত মজুরি এবং ক্রমবর্ধমান বেকারির নিষ্পত্তি এবং এইভাবে দেশের শ্রমজীবী জনগণের দারিদ্রের কিনারা করে। ছদ্ম বেকারি অসংগঠিত শ্রমশক্তির কাছে একটা বড় ধরনের সমস্যা। সামাজিক, সুবিধাধর্মী বা দান ভিত্তিক পেনশন সমস্যার সমাধান হতে পারে না যদি না সরকার উপরিউল্লিখিত বুনিয়াদি সমস্যার সমাধান করে। কর্ম জীবনে দারিদ্র প্রশমনের নীতিই প্রবীণ, পেনশন লাভের বয়সে দারিদ্র সমাধানের উপায় হতে পারে। দেশীয় এবং বৈশ্বিক পুঁজি উভয়েই মৌলিক সমস্যার সমাধানে ব্যর্থ হওয়ায় দেশ ও দেশের জনগণের সমৃদ্ধি হতে পারেনি।

সামাজিক পেনশন

মোদী নেতৃত্বে চালিত বিজেপি সরকারের দাবি হলো তারা অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের পেনশনের আওতায় নিয়ে এসেছে। কিন্তু এই সমস্ত প্রকল্পে যে পরিমাণ পেনশন দেওয়া হচ্ছে তা কয়েক হাজারের বেশি নয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মাত্র এক হাজার। দেশের যে কোনো মানুষের একটু ভালো জীবন যাপনের পক্ষে যে পরিমাণটা একেবারেই নগন্য।

অপরদিকে সামাজিক নিরাপত্তা প্রদানের দায়িত্ব এখন আর নিয়োকর্তাদের বা সরকারের ওপর নেই, সামাজিক নিরাপত্তা কোড’এর প্রবর্তনের সঙ্গে তা এখন বর্তেছে প্রতিটি শ্রমিকের ওপরই যা এখন রূপায়ণের অপেক্ষায়।

পেনশনের সমস্যা দেশের দারিদ্র, বেকারি এবং মজুরির স্তরের সঙ্গে জটিল সম্পর্কে যুক্ত যা নির্দিষ্ট শ্রমিকের জীবনে তার নিজস্ব ধারায় প্রভাব ফেলে। যে সামাজিক পেনশন প্রতিটি শ্রমিককে একটা ন্যূনতম মাত্রার পেনশন দেয় তার কোনো বিকল্প হতে পারে না। বেশ কিছু অনুসন্ধান ও গবেষণায় দেশ, অর্থনীতি এবং পেনশন প্রাপকদের জীবনের উন্নতিতে সামাজিক পেনশন ব্যবস্থার প্রগতিবাদী ভূমিকার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, যদি অবশ্য সরকার পরিকল্পনা করে তার যথাযথ রূপায়ণ ঘটায়। অতএব প্রবীণ বয়সে কর্মীরা যখন কাজ করবে না সেই সময় তাদের কল্যণের ব্যয় বহনের পরিকল্পনা সরকারকে করতে হবে। কর্মীদের কাঁধে বোঝাটা চাপালে তা দেশের অর্থনীতির অর্থনৈতিক কল্যাণের ওপরই চাপ সৃষ্টি করবে, যদি না সরকার মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপনের জন্য পর্যাপ্ত পেনশনের ব্যবস্থা করে।

বৈশ্বিক পেনশন সূচক

এই বিষয়ে ভারতের রেকর্ড একেবারেই নিকৃষ্ট। মার্সার এবং সিএফএ ইনস্টিটিউট ২০২২’র অক্টোবরে ৪৪টি দেশকে অন্তর্ভুক্ত করে তাদের ১৪তম বার্ষিক মার্সার সিএফএ বিশ্ব পেনশন সূচক প্রকাশ করে। এই রিপোর্টের শীর্ষে ছিল আইসল্যান্ড, এবং সবচেয়ে নীচে ছিল থাইল্যান্ড। এই ৪৪টা দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ছিল নীচের দিকে, ৪১তম। একেবারে ওপরের পাঁচটা দেশ ছিল আইসল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক, ইজরায়েল ও ফিনল্যান্ড, আর নীচের পাঁচটা দেশ ছিল তুরস্ক, ভারত, আর্জেন্টিনা, ফিলিপাইন্স ও থাইল্যান্ড।

ডব্লিউটিডব্লিউ এবং থিংকিং এহেড ইনস্টিটিউট’এর তৈরি করা ‘বিশ্ব পেনশন সম্পদ সমীক্ষা ২০২৩’এ বলা হয়েছে, বিশ্বে পেনশন সম্পদের সাতটা বৃহত্তম বাজার হলো অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান, নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড, গ্রেট ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বের ৯২ শতাংশ পেনশন সম্পদ রয়েছে এই সাতটা দেশে। এই সাতটা দেশেই পেনশনের বৃহত্তম বাজারগুলো কেন্দ্রীভূত এবং বৈশ্বিক পুঁজি বাকি পেনশন বাজারগুলোতে নিজেদের সম্প্রসারিত করা ঢোকার পরিকল্পনা করছে। আর সেই লক্ষ্যেই ভারত-সহ সারা বিশ্বেই পেনশন সংস্কারে জোর পড়ছে পেনশন পুঁজিকে কেন্দ্রীভূত করা এবং সেই ধারায় বাজারগুলোকে সম্প্রসারিত করা। এই লক্ষ্যে অগ্রাধিকারে রয়েছে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলো। মোদী সরকার যে অসংগঠিত ক্ষেত্রের সুবিশাল শ্রমশক্তিকে পেনশন এবং অন্যান্য সামাজিক নিরাপত্তার জালে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে তার লক্ষ্য হলো দেশের অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমশক্তির মাথার ঘাম পায়ে ফেলে জমানো ক্ষুদ্র সঞ্চয়গুলোকে একত্রিত করে পুঞ্জীভূত পুঁজি দিয়ে এক আর্থিক পরিকাঠামো নির্মাণ করা, আর এটাকেই ঘুরিয়ে অভিহিত করা হচ্ছে সবার জন্য পেনশন ব্যবস্থা বলে। সামাজিক নিরাপত্তা কোড আসলে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমশক্তিকে কাজে লাগিয়ে পুঁজি পুঞ্জীভূত করে ধনী ও ক্ষমতাবানদের সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার হাতিয়ার ভিন্ন অন্য কিছু নয়।

সংগ্রামের হিল্লোলিত তরঙ্গমালা

পেনশন সংস্কার আজ শ্রমিক শ্রেণীর সামনে মোকাবিলার এক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে উঠেছে। অতি সম্প্রতি অবসর গ্ৰহণের বয়স বৃদ্ধি এবং পেয়ে আসা সুবিধাকে হ্রাস করার বিরুদ্ধে ফ্রান্সে ফেটে পড়ল লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের সহিংস প্রতিবাদ। পেনশনের ইস্যুতে গোটা ইউরোপই আজ অশান্ত।

ভারতেও আমরা নয়া পেনশন প্রকল্পের বিরুদ্ধে এবং পুরনো পেনশন প্রকল্পকে ফিরিয়ে আনার দাবিতে বিভিন্ন মঞ্চ পরিচালিত একগুচ্ছ আন্দোলন দেখতে পাচ্ছি। পুরনো পেনশনকে ফিরিয়ে আনার জাতীয় আন্দোলন (এনএমওপিএস) দিল্লীতে ১ অক্টোবর ২০২৩ এক বিশাল প্রতিবাদ সংগঠিত করার কথা ঘোষণা করেছে এবং তারা বিহারের চম্পারণ থেকে তাদের যাত্রা শুরু করেছে। এই এনএমওপিএস’এর মধ্যে রয়েছে রেলে নয়া পেনশন প্রকল্পের বিরুদ্ধে ফ্রন্ট (এফএএনপিএসআর), যারা কয়েক বছর ধরেই পেনশন আন্দোলনের এক পুরোধা হয়ে রয়েছে। রেলকর্মীদের এক বিকল্প মঞ্চ ভারতীয় রেলকর্মী ফেডারেশনও (আইআরইএফ) এমএনওপিএস’কে সমর্থন জানিয়েছে। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ইউনিয়নগুলোর মঞ্চ কিছুটা দেরিতে আন্দোলনে যুক্ত হলেও তারা পুরনো পেনশন প্রকল্প পুনরুদ্ধারের যৌথ মঞ্চর (জেএফআরওপিএস) পতাকাতলে তাদের দাবিকে তুলে ধরতে ১০ আগস্ট ২০২৩ দিল্লীতে এক বিশাল জনসমাবেশ সংগঠিত করে।

ইপিএস’এর অধীনস্থ পেনশন প্রাপকদের সংগঠনগুলোও একদিনের ধর্মঘট সংগঠনের জন্য কোমর বাঁধছে, যে ধর্মঘট হবে দেশের কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলোর সঙ্গে সহযোগিতায় এবং ইউনিয়নগুলো যে একদিনের সারা ভারত ধর্মঘটের ডাক দেবে তার সাথে সমাপতন ঘটিয়ে। ২০২৩’র ডিসেম্বরে রেল ও রাস্তা অবরোধ সংগঠিত করার প্রস্তাবও উঠেছে। দেশে পেনশন আন্দোলন ধীরে কিন্তু ক্রমান্বয়ে বেড়ে উঠছে।

– ভি শঙ্কর, লিবারেশন, সেপ্টেম্বর ২০২৩ সংখ্যা থেকে

খণ্ড-30
সংখ্যা-30