“অতিমারী ও ইউক্রেন যুদ্ধের পর এবার আমরা প্রবেশ করলাম বৈশ্বিক জলবায়ু মহাসংকটে।” ২৬ জুলাই নিউইয়র্কের একটি ভাষণে জলবায়ু পরিবর্তনের মহাসংকটময় অবস্থা দেখে রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরাস বলেছেন, “আমরা এখন বৈশ্বিক উষ্ণায়নের স্তর পার হয়ে ফুটন্ত বিশ্বের (গ্লোবাল বয়লিং) এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছি।” সমগ্র উত্তর গোলার্ধের মাত্রা ছাড়া উষ্ণায়নকে ‘নির্মম গ্রীষ্ম’ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেছেন “এটা গোটা গ্রহের জন্য বিরাট মাপের এক বিপর্যয়। আগামী যে দিনগুলো আসতে চলেছে তাতে এবার এত বছরের সব রেকর্ড ভেঙে যাবে। ভয়ঙ্কর এক বিপদের আমরা সম্মুখীন। পৃথিবীর আগামী পরিণতি দুঃখজনক। বিশ্ব উষ্ণায়নের যুগ শেষ হয়েছে। আমরা এখন প্রবেশ করেছি ফুটন্ত বিশ্বের যুগে।”
এর আগে মার্কিন মহাকাশ সংস্থা ‘নাসা’ বলেছিল, এই জুলাই মাসে গোটা ধরিত্রী যেভাবে অগ্নি গোলক হয়ে উঠেছে, তা আগে কখনও দেখা যায়নি। রাষ্ট্রপুঞ্জ এবং ইউরোপের বিভিন্ন আবহাওয়া সংস্থা এর আগেও জানিয়েছে যে বিগত কয়েক হাজার বছর ধরে আমাদের ধরিত্রী কখনই এতোটা নজীরবিহীন মাত্রায় উষ্ণ হয়ে ওঠেনি। জুলাই মাসে অগ্নিবর্ষী উত্তাপ ইউরোপের নানান প্রান্ত, এশিয়া ও উত্তর আমেরিকাকে ঝলসে দিয়েছে, দাবানল কানাডা ও দক্ষিণ ইউরোপের বেশ কিছু এলাকাকে করেছে ছাড়খার। প্রশান্ত মহাসাগরে উষ্ণ জলস্রোত এল নিনোর জন্য এবছর সমুদ্র পৃষ্ঠে তাপমাত্রা বেড়েছে হুহু করে। ক্যালিফর্নিয়ার ডেথ ভ্যালিতে তাপমাত্রা ছুঁয়েছে ৫৪ ডিগ্রি, চিনের চেংড়ু, ঝিজিয়াং, নানজিং ও ইয়াংঝি নদীর দ্বীপ অঞ্চলে তীব্র তাপপ্রবাহ চলছে।
বিগত ছয় দশক ধরে দুনিয়া জুড়ে বিরাট অর্থনৈতিক উল্লম্ফনের হাত ধরে যেমন বেড়েছে জনসংখ্যা, তেমনই সেই উল্লম্ফনের জন্য বিরাট মূল্য চোকাতে হচ্ছে জলবায়ুকে। এই পর্যায়ে মাথা পিছু বৈশ্বিক জিডিপি একদিকে বেড়েছে তিন গুণ, ঠিক তেমনি এর বিপরীতে কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ বৃদ্ধি পেয়েছে চারগুণ!
দীর্ঘদিন ধরে জীবাশ্ম জ্বালানির কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণে রাশ টানতে নানা আন্তর্জাতিক চুক্তি ও প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও বিশেষ করে ধনী দেশগুলো এ ব্যাপারে কোনো সদর্থক পদক্ষেপ নিচ্ছে না। নতুন সমীক্ষা থেকে উঠে আসা তথ্য দেখাচ্ছে, বৈশ্বিক জলবায়ু এই সংকটের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দায়ী ৪০ শতাংশ, গোটা ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২৯ শতাংশ আর সমগ্র বিশ্বের উত্তর ভাগ ৯২ শতাংশ কার্বন নিঃসরণের জন্য দায়ী। আজ থেকে ১৪ বছর আগে জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমিত করতে যে পরিমাণ আর্থিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি আমেরিকা সহ উন্নত দেশগুলো করেছিল, সে পথে তারা পা মাড়ায়নি। এবার দিল্লিতে অনুষ্ঠিত জি-২০ বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত হয়েছে তা হল, ২০৩০-এর মধ্যে পুনর্নবীকরণ যোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকাঠামো এখনকার তুলনায় তিন গুণ বাড়ানো, গ্রিন হাইড্রোজেন ইনোভেশন সেন্টার ও গ্লোবাল বায়োফুয়েল অ্যালায়েন্স তৈরি করা যাতে আরও সবুজ জ্বালানির সন্ধান পাওয়া যায়।
অত্যন্ত ধনী ও শিল্পোন্নত দেশগুলোর লাগামছাড়া কার্বন নিঃসরণের ফল জলবায়ুর উপর বিপজ্জনক প্রভাব ফেলেছে। বিভিন্ন দেশে খরার প্রকোপ বৃদ্ধি, সমুদ্রপৃষ্ঠে জলস্তর বেড়ে যাওয়া, বন্যা, বিধ্বংসী ঝড়, সাইক্লোন, আর তার দরুণ ব্যাপক ক্ষয় ক্ষতি, প্রাণহানি — যেমন কিছুদিন আগে দেখা গেল লিবিয়ার মরু শহর ডারনায় বন্যার অভূতপূর্ব থাবা কুড়ি হাজারেরও বেশি জীবন কেড়ে নিল, শহরটা প্রায় মুছে গেল। এই ধরনের বিরাট মাপের প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও বিভীষিকা আজ পৃথিবীর বুকে নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা এগুলোকে “বায়ুমন্ডলীয় উপনিবেশবাদ বা অ্যাটমসফেরিক কলোনাইজেশন” আখ্যা দিয়েছেন। গবেষণালব্ধ সমীক্ষায় বলা হয়েছে, “দক্ষিণ বিশ্ব থেকে শ্রমশক্তি ও নানান সম্পদ লুন্ঠন করে উত্তর বিশ্ব নিজেদের আর্থিক বিকাশ ঘটাচ্ছে, আর এর সাথে শুধু শ্রম শক্তি ও সম্পদেরই নয়, দক্ষিণ বিশ্বের জলবায়ুকেও প্রবলভাবে দূষিত করে চলেছে, যার ক্ষতিপূরণটুকুও ধনী দেশগুলো দরিদ্র দেশ বা মহাদেশকে দেয়না।” গবেষক হিকেল, যিনি গোল্ডস্মিথ, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বলেছেন, “যদি বাংলাদেশ জলের তলায় চলে যায়, তবে কে তার জন্য দায়ী? প্রতি তিনটির মধ্যে একটা করে জীববৈচিত্র যদি অবিরাম গতিতে লুপ্ত হতে থাকে তবে কার দিকে আঙুল তোলা হবে? এই সীমাহীন ক্ষয়ক্ষতির জন্য কারা দেবে ক্ষতিপূরণ?” হিসাব কষে তিনি দেখিয়েছেন, ৪০ শতাংশ কার্বন নিঃসরণের ফলে যে ক্ষয় ক্ষতি হচ্ছে তার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাৎসরিক ৫০০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের সম্পদ ধ্বংস করছে, যা ক্ষতিপূরণ হিসাবে তাদের দেওয়া উচিত।
সম্পদ, শক্তি বা এনার্জি ব্যবহার, পণ্য ও পরিষেবা ভোগ করা — এই সমস্ত ক্ষেত্রগুলোতে গোটা বিশ্বজুড়েই উৎকট বৈষম্য নজরে আসে। এমনকি কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণও এর বাইরে নেই। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির সর্বশেষ প্রতিবেদন জানাচ্ছে, বৈশ্বিক সমাজে অতি ধনী সদস্যরা গরিবদের তুলনায় বহুগুণ বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণের জন্য দায়ী — নিচুতলার ১ শতাংশের তুলনায় তারা নিঃসরণ করে হাজার গুণ বেশি গ্রিন হাউস গ্যাস। গোটা বিশ্ব জুড়ে একদম উপরের দিকে ১০ শতাংশ নির্গমণকারী দেশগুলো ২০২১-এ সমগ্র কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমণের অর্ধেকেরও বেশি নির্গমন করেছে, এদিকে একদম নিচের সারিতে যে দেশগুলো রয়েছে তাদের পরিমাণ মাত্র ০.২ শতাংশ!
সমস্ত মহাদেশ জুড়েই রয়েছে এই ১০ শতাংশ নির্গমণকারী দেশগুলো। এর মধ্যে ৮৫ শতাংশ উন্নত অর্থনৈতিক দেশগুলো রয়েছে, যাদের মধ্যে আছে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, জাপান, কোরিয়া, নিউজিল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং চিন। এর পরে রয়েছে মধ্য প্রাচ্য, রাশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা। এই দেশগুলোতে আয় বৈষম্যের ক্ষেত্রে বড় ধরনের তফাত আছে জীবন যাপন ও সামাজিক ধারার সমস্ত দিক থেকে। নিচের ১০ শতাংশ নিঃসরণকারী দেশগুলো রয়েছে এশিয়া ও আফ্রিকার মধ্যে যেখানে তারা তুলনামূলকভাবে অনেক কম পণ্য পরিষেবার এবং বহু ক্ষেত্রে পরিচ্ছন্ন স্বাস্থ্যসম্মত রান্না করার বিদ্যুৎ ব্যবহারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত।
সমাজের সবচেয়ে উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিত্তশালীরা প্রতি বছর মাথা পিছু ৫৫ টন কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ করে। অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোর তুলনায় ভূতল পরিবহন বেশ উচ্চমাত্রায় কার্বন নিগর্মণ করে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে সবচেয়ে বিত্তশালী অংশটি বছরে মাথা পিছু নির্গমণ করে ২৪ টন কার্বন ডাই অক্সাইড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থেকে কম।
বিশ্ব জুড়ে এবার ১৫ ও ১৭ সেপ্টেম্বর পালিত হল জলবায়ু ধর্মঘট। এ নিয়ে এই ধর্মঘট ৫ম বার্ষিকীতে পা দিল। সুইডেনের গ্রেটা থানবার্গ আজ থেকে পাঁচ বছর আগে এই আন্দোলন শুরু করেন। জলবায়ু অ্যাক্টিভিস্ট গ্রেটা ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার গ্রুপ গঠন করে এই আন্দোলন শুরু করেন যা আজ গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। এই আন্দোলনে বিশ্বজুড়েই তরুণ প্রজন্মের বিপুল অংশগ্রহণ সবচেয়ে নজর কেড়েছে। জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারে লাগাম টানা, জীবাশ্ম জ্বালানির উপর চড়া কার্বন কর আরোপ করা, প্রভৃতি দাবিতে দেশে দেশে প্রতিবাদীরা সোচ্চার হয়েছেন।
ভয়াবহ বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে আজ সমগ্র মানবজাতি। আমাদের ধরিত্রী আজ হয়ে উঠেছে অগ্নিগোলক। নতুন প্রজন্ম অস্তিত্বের সংকটে। যে গুরুত্ব ও গভীরতার সাথে এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার দরকার ছিল, সে ব্যাপারে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশগুলি এখনও যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছে না। জলবায়ু রক্ষা, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার আন্দোলন শুধুমাত্র পরিবেশ কর্মীদের উপর ছাড়লে চলবে না — এর বিরুদ্ধে দরকার বিরাট মাপের রাজনৈতিক আন্দোলন। আর, নবীন প্রজন্মকেই এই আন্দোলনে নিতে হবে কান্ডারির ভূমিকা।
অতনু চক্রবর্তী
গত ১৫ সেপ্টেম্বর বিশ্বজুড়ে জলবায়ু ধর্মঘটকে সফল করতে বজবজে সকাল ও বিকালে বিভিন্ন স্থানে কর্মসূচি পালন হল। বজবজের পিকে হাইস্কুল, গার্লস হাই স্কুল, বজবজ উর্দু স্কুলের ছাত্রী-ছাত্র সহ বজবজ মহেশতলা নেচার স্টাডি সেন্টার, পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ, বজবজ চলার পথে গণসাংস্কৃতিক সংস্থা এই কর্মসূচি পালন করে।