প্রতিবেদন
কেন্দ্রের এজেন্সিরাজ
centre-agencies

তৃণমূলের অধুনা দ্বিতীয় নির্দেশক অভিষেক ব্যানার্জীকে ইডি ফের তলব করেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় তৃণমূলনেত্রী মন্তব্য করেছেন, এটা “রাজনৈতিক প্রতিহিংসা”। আগেও বারকয়েক ইডি কলকাতায় ও দিল্লীতে শ্রীযুক্ত অভিষেককে ডেকে পাঠায়। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের ব্যাপারে দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদ করে। তারই জের টেনে কলকাতা অফিসে আবার জেরার সম্মুখীন হতে তলব করেছে। তবে, এবার এমন দিনে ডেকে পাঠিয়েছে যাকে এক অর্থে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সমাপতন বললে অত্যুক্তি হবে না। কারণ ঐ একইদিনে দিল্লীতে পূর্ব নির্ধারিত “ইন্ডিয়া” জোটের সমন্বয় কমিটির প্রথম বৈঠকে অভিষেকের অংশগ্রহণ করার কথা। তাই, ইন্ডিয়া বৈঠক নাকি ইডি-র তলব — কোথায় যাওয়া হবে তা নিয়ে চূড়ান্ত মনস্থির করতে নিশ্চিত এক মানসিক সংঘাত পোহাতে হয়েছে। শেষে ইডি-র অফিসেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

ইডি-সিবিআই-এর এহেন আচরণ একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। অবশ্যই প্রতিহিংসাপূর্ণ, পক্ষপাতদুষ্ট। আদালতের নির্দেশে ও তত্ত্বাবধানে তদন্ত চলছে বটে। বহিরঙ্গে এটাই ঘটনা। কিন্তু অন্তর্নিহিত সত্য হল, ইডি-সিবিআই-কে চালাচ্ছে আসলে কেন্দ্রের অমিত শাহর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। আরও সত্যি বলতে, মোদী সরকারের ‘এজেন্সি রাজ’ চালানো হচ্ছে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে বুলডোজ করতে। বিরোধী শক্তিগুলো কোনোরকম জোটে সামিল হওয়ার বহু আগে থেকে ’২৪-এর লোকসভা নির্বাচনকে পাখীর চোখ করে ভয় দেখাতে পথের কাঁটা সরাতে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এজেন্সি হানা, খানা তল্লাসি, জিজ্ঞাসাবাদ ও হেফাজতে নেওয়া শুরু করে দেয়। এরাজ্যে কেন্দ্রীয় এজেন্সির কড়া নাড়ার ঘটনা-প্রবণতা কোনো বিচ্ছিন্ন পলিসি নয়। বিজেপির এ হল সর্বভারতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সংগঠিত করা অভিযান। পশ্চিমবঙ্গে অপারেশন চালানোর কিছুটা বাড়তি অনুকূল জমি পেয়ে গেছে। সেটা হল, রাজ্যের শাসকদলের বিরুদ্ধে শিক্ষাক্ষেত্র থেকে শুরু করে নানাক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা। বিপরীতে বিজেপিকে নিশানা করে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর ক্রমবর্দ্ধমান শরিকী অংশগ্রহণে “ইন্ডিয়া” জোটের শক্তিবৃদ্ধি হয়ে চলা দেখে গেরুয়া শিবির আতান্তরে পড়েছে। তাই দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করাতে, ভাঙন ধরাতে, সিবিআই, ইডি, নিয়া নামের এজেন্সিগুলোকে ব্যবহার করছে। এই পলিসি বিজেপি নিয়েছে কেবল বিরোধী দল শাসিত রাজ্যগুলোতেই। কোনো বিজেপি শাসিত রাজ্যে এজেন্সি হানা নেই। ঐসব রাজ্যে পরম নিশ্চিন্তে নিরাপদে শাসকের দুর্নীতি চলে। এই দ্বৈততা বস্তুত রাষ্ট্রের যুক্তরাষ্ট্রীয় চরিত্রকে ধ্বংস করে এক পার্টির ডবল ইঞ্জিন চালিত একনায়কতন্ত্র চালানোর পদ্ধতি-প্রকরণগত মহড়া শুরু করে দেওয়ারই লক্ষণ। তাই, এর পাল্টা বিরোধিতা করতে হবে সর্বভারতীয় দৃষ্টিকোণ ও প্রেক্ষিতকে অগ্রাধিকার দিয়ে। প্রকৃত গণতন্ত্রপ্রিয়তা, দেশপ্রেম ও যুক্তরাষ্ট্রীয়তার বোধ থেকে। আর, এই এজেন্সি হানা যখন যেখানে ধর্মীয় সংখ্যাগুরুবাদের নামে চলতে দেখা যাবে তখন সেখানে রুখে দাঁড়াতে হবে ধর্মনিরপেক্ষতার দৃষ্টিকোণ থেকে।

এসব অবস্থান নেওয়ার মানে এটা নয় যে পশ্চিমবাংলায় নানা দুর্নীতির সাথে জড়িত সন্দেহে সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সহ বিভিন্ন মাপের সব টিএমসি নেতা-মাথাদের হয়ে ব্যাটিং করতে নামতে হবে! নৈব নৈব চ। কোনটা সাজানো মামলার জন্য আর কোনটা বাস্তবে পেছনে কোন নির্দিষ্ট কারণ রয়েছে সেই তফাত একটু সদিচ্ছা থাকলে বোঝা যায়, বুঝতে হবে।

টিএমসির যারা অভিযুক্ত, তারা ও তাদের দল তদন্তে ও আদালতে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করুন। এ দায় কেবল তাদের। এর পিছনে বঙ্গবাসীর দাঁড়ানোর কোনো দায় বর্তায় না। এই অবস্থানে অবিচল থাকার যথেষ্ট সঙ্গত কারণ রয়েছে। টিএমসি সরকারের বিরুদ্ধে দু'দশকের বেশি সময়ের রাজত্বে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হল দুর্নীতি, সর্বব্যাপী নানা দুর্নীতি। একেবারে গোড়ার দিক থেকে সারদা, নারদ ইত্যাদি চিটফান্ড কেলেংকারী দিয়ে যার সূত্রপাত, সময় গড়িয়ে চলার সাথে সাথে প্রায় সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি-কেলেংকারীর দূর্গন্ধ বের হয়ে আসছে। সময়ে সময়ে অসাবধানবশত বা অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে টিএমসির ভেতর থেকে তার কিছু কিছু তথ্য বেফাঁস হয়েছে। কাউকে বলি দিতে জেলবন্দী করেও পরে মুখ বন্ধ করাতে জেলখালাস করতে হয়েছে, দলের মুখপাত্র বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের জ্ঞানচক্ষুকে তো সব ভুলিয়ে রাখা যায় না। এরকম নজীর রয়েছে অজস্র। ঠগ বাছতে উজার হয়ে যাবে দল। এর সাথে রয়েছে সন্ত্রাসের বাতাবরণ। তবু এত কান্ড সত্ত্বেও ‘দুয়ারে সরকার’ ও একগুচ্ছের নানা সংস্কারের ডালির দৌলতে এক আপাত জনচিত্ত আকর্ষক ভাবমূর্তি রয়েছে বলে তৃণমূল জমানা চলতে পারছে। বাকিসব অর্থাৎ দলের সাংগঠনিক কাঠামোয় ওপর থেকে নিচতলা পর্যন্ত, আর মন্ত্রীসভায়, পৌরসভায় ও পঞ্চায়েতরাজে ক্ষমতার অদল-বদল করে ব্যালেন্স করে চলতে হচ্ছে।

কিন্তু বিজেপির তুলনা টিএমসি কেন, কোনও দলেরই সঙ্গে হয় না। এটা মেলেনা বিদ্বেষ-বিভাজনের মতাদর্শ ও রাজনীতির বিচারে যেমন, তেমনি দুর্নীতির প্রশ্নেও। বিজেপির গন্তব্য হিন্দুরাষ্ট্র। এটাই তার বৈশিষ্ট্যকে আর সব রাজনৈতিক দলের বিপরীত চরিত্রের প্রমাণ দেয়। কোনোরকম বিরোধিতাকে রেয়াত না করার ফ্যাসিবাদী প্রবণতা তাকে এমনকি হিন্দুত্ববাদী শিবসেনার মূল অংশকে নির্মূল করতেও এখন প্ররোচিত করছে।

শত শত লক্ষ কোটি টাকার কর্পোরেট লুঠ চলতে দিতে আর নিজেরা দুর্নীতির চূড়ামনি হতে বিজেপির জুড়ি মেলা ভার। ললিত মোদী, নিরব মোদী, বিজয় মাল্য ইত্যাদি ব্যাঙ্ক লুটেরাদের নিয়ে মোদী সরকার সদম্ভে কিছুতেই কোনও আলোচনা তুলতে দিতে চায় না। তাছাড়া একটা কটাক্ষ বেশ চালু হয়ে গেছে, তা হল, দুজন কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন গুজরাটি (মোদী ও শাহ্) দেশের সবকিছু সম্পদ বেচে দিচ্ছে, আর কর্পোরেট ক্ষমতাসীন দুজন গুজরাটি (আদানি ও আম্বানি) সবকিছু কিনে নিচ্ছে। মধ্যপ্রদেশের মেডিক্যাল কলেজ সংক্রান্ত ‘ভ্যাপম’ কেলেংকারির ঘটনাক্রম ভয়ংকর। ভর্তির সংস্থান বিক্রি থেকে কোটি কোটি টাকা কামিয়ে নেওয়া তো হয়েছেই, আরও হাড়হিম ধরানো ঘটনা হল, ঐ দুর্নীতির মামলার একের পর এক সাক্ষীকে রহস্যজনকভাবে ‘নিখোঁজ’ করে দেওয়া হয়। এরপর তদন্তের প্রহসন ছাড়া আর কি অবশিষ্ট থাকতে পারে! মোদীর পিএম কেয়ারস্ ফান্ড ও বিজেপির ইলেক্টোরাল বন্ডের কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কোথা থেকে কোথায় আসছে যাচ্ছে, বিজেপি তার হিসাব দেওয়ার পরোয়াই করে না। পাঁচশ কোটি টাকার দুর্নীতিবাজ বলে অভিযুক্ত অজিত পাওয়ার বাগে আসার পর বিজেপি মুখে কুলুপ এঁটেছে। হালের সড়ক নির্মাণের ‘ভারতমালা’ প্রকল্প খরচের হিসাব পেশে ধরা পড়েছে বড় মাত্রায় গরমিল! ক্যাগ-এর হিসাব পরীক্ষার রিপোর্টে সড়ক দুর্নীতির সত্যাসত্যের একেবারে পর্দা ফাঁস হয়ে গেছে। মোদী সরকার নিযুক্ত ‘ক্যাগ’-এর রিপোর্টে চিহ্নিত হয়েছে বিশাল গলদ। ধরা পড়েছে প্রকল্পের বরাত দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রচন্ড অনিয়ম, আর বরাদ্দ অর্থ ও ব্যয়িত অর্থের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ। এর সাথে দুর্নীতির আরও সাতকাহন রয়েছে। ‘আয়ুস্মান ভারত-প্রধানমন্ত্রী জন আরোগ্য প্রকল্পে মৃতদের নামেও স্বাস্থ্য বিমায় অর্থ বরাদ্দ’, ‘কেন্দ্রীয় সরকারের স্বদেশ দর্শন প্রকল্পের অধীন উত্তরপ্রদেশ অযোধ্যা উন্নয়ন প্রকল্পে’ ঠিকাদারদের প্রায় ২০ কেটি টাকার সুবিধা পাইয়ে দেওয়া, ‘কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন প্রকল্পের অধীন পেনশন প্রকল্পে’র বরাদ্দ অর্থ থেকে ২ কোটি ৮৩ লক্ষ টাকা অন্য প্রকল্পের প্রচার বাবদ ব্যয়, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ‘হ্যাল’-এ বিস্ময়কর লাগে ১৫৯ কোটি টাকার লোকসান, জাতীয় সড়কে টোল আদায়ের নিয়ম ভেঙ্গে যাত্রীদের থেকে ১৫৪ কোটি টাকা টোল আদায়। অসমে বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে উঠেছে জমি কেলেংকারীর অভিযোগ।

দুর্নীতির প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গেও বিজেপি চালাচ্ছে দুমুখোপনা। অভিযোগ আছে রাজ্য বিধানসভায় খোদ বিরোধী দলনেতার সারদা ও নারদ কেলেংকারীতে জড়িত থাকার বিরুদ্ধে। তিনি নিত্যদিন শাসক টিএমসির নেতা-মন্ত্রী-চ্যালা-সান্ত্রীদের তুলোধোনা করেন দুর্নীতির ইস্যুতে। কিন্তু তাঁকে ইডি-সিবিআাই নোটিশ ধরানোর হিম্মৎ হয় না বিজেপির! এই দ্বিচারিতা লুকানের উপায় নেই।

মোদী সরকারের এইসব আর্থিক অনাচারের অপরাধ নিয়ে কখনও তো ইডি-সিবিআই নিয়োগ করার কথা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ওঠে না। এই কারণেই দুর্নীতি ধরা ও সেই অপরাধে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়ার নামে যে ‘এজেন্সিরাজ’ চলছে তা একপেশে, পক্ষপাতদুষ্ট, প্রতিহিংসাপরায়ণ।

– অনিমেষ চক্রবর্তী

খণ্ড-30
সংখ্যা-32