সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয় : কুৎসিত বৈভব ও পাশবিকতার নিদর্শন
arrogance-and-cruelty

দিল্লীর বুকে অনুষ্ঠিত জি-২০’র শীর্ষ বৈঠকের আয়োজনে একদিকে কুৎসিত বৈভব, উৎকট প্রাচুর্যর পাশাপাশি ছিল রাষ্ট্রের চরম বর্বরতা ও গরিব মানুষদের প্রতি হিংস্রতার প্রদর্শনী। দরিদ্র আশ্রয়হীন অযুত দিল্লীবাসীর মুখচ্ছবি জি-২০’র রাষ্ট্রনেতাদের চোখের সামনে যাতে ফুটে না ওঠে, তারজন্য চরম নির্মমতার সাথে, নির্বিচারে চলল বুলডোজার, যা এখন মোদীর শাসনতন্ত্রের ঘৃণ্য প্রতীক। হাজারে হাজারে বস্তি-ঝুপড়িবাসীকে উচ্ছেদ করা হল। রাতারাতি নয়, এই উচ্ছেদ অভিযান চালালো হয়েছে কয়েকমাস ধরে। তিলে তিলে দিল্লীকে সাজানোর, বৈভবের প্রসাধনী প্রলেপ দিতে চলেছিল বেশ কয়েকমাস ধরে এই ধ্বংসযজ্ঞের বহু বিজ্ঞাপিত আয়োজন।

ভারত জি-২০’র প্রেসিডেন্সি পাওয়ার পর থেকেই দিল্লী জুড়ে শুরু হয় এই উচ্ছেদ অভিযান। মেহেরলিতে ৭০০টি উচ্ছেদের নোটিস দেওয়া হয়, ২৫টি বাড়ি ভেঙে গুড়িয়ে দেয় প্রশাসন। কিন্তু তুঘলাকাবাদের উচ্ছেদ ছিল সবচেয়ে ব্যাপক ও হিংস্র। অধিকাংশ সংখ্যালঘু মেহনতিদের বাস এই অঞ্চলে উচ্ছেদের ১,৫০০ নোটিশ দেওয়া হয়, ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় ৩০০০’র উপর ঘরবাড়ি কিন্তু অপেক্ষাকৃত সচ্ছল অধিবাসিদের বাড়ি-ঘরে কোনো আঁচড় পড়েনি। ওই এলাকাটি এখন যেন বোমা বিধ্বস্থ! এতো বড় মাপের, এত বৃহৎ পরিধি জুড়ে আর কোথাও হয়নি উচ্ছেদ অভিযান। উচ্ছেদের দিনে বিশাল বাহিনী নিয়ে পুলিশ বস্তি ঘিরে ফেলে, কেউ যাতে উচ্ছেদ অভিযানের ভিডিও করতে না পারে তারজন্য পুরো এলাকা জুড়ে জ্যামার লাগান হয়, উচ্ছেদের খবর পেয়ে যারা যারা প্রতিবাদ জানাতে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছিলেন, তাঁদের মোবাইল ফোন বাজেয়াপ্ত করা হয়, আশপাশের সমস্ত হোটেল-দোকানপাট বন্ধ করে দেয় প্রশাসন, দিন দুয়েকের মধ্যে বিশাল বস্তি অঞ্চলটি গুঁড়িয়ে সাফ করে দেওয়া হয়।

সমাজের বিভিন্ন স্তরের ‘উদ্বিগ্ন নাগরিক’দের এক প্রতিবাদী ফোরাম দিল্লির বুকে সংগঠিত এই উচ্ছেদ অভিযানকে ‘বেআইনি, সংবিধান বহির্ভূত’ আখ্যা দিয়েছেন। তাঁদের সম্মিলিত প্রতিবাদী মঞ্চ, যার মধ্যে রয়েছেন হর্ষ মন্দার, আনন্দ য়াজ্ঞনিক, শিমলার অবসরপ্রাপ্ত মেয়র টিকেন্দর পানওয়ার সহ বেশ কিছু প্রবীন সাংবাদিক অভিযোগ করেছেন এই জি-২০’র দোহাই দিয়ে শহরের আপামর গরিব মেহনতি খেটে খাওয়া মানুষের উপরই তান্ডব নামিয়েছে রাষ্ট্র। এরআগে বিভিন্ন আদালতের যতগুলো রায় বেরোয়, তার প্রতিটিতেই উচ্ছেদের আগে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে বলেছে সর্বোচ্চ আদালত। বম্বে হাইকোর্ট এমনকি এটাও স্পষ্ট করেছে যে, ‘জবরদখলকারী’দের (এনক্রোচার) ক্ষেত্রেও পুনর্বাসন প্রশাসনকেই নিশ্চিত করতে হবে।

জি-২০’র প্রস্তুতি পর্বে নাগপুরে ‘সিভিল ২০’ নামক এক মেগা ইভেন্টের সময় এক বিচারপতি বলেই বসেন, “নাগপুরবাসীকে শৃঙ্খলা পরায়ণ হয়ে সেই সময় থাকতে হবে”। সেখানকার পুলিশ কমিশনার এক সরকারি আদেশনামায় ঘোষণা করে দিলেন সেই সময় কোনো ভিখারি যেন প্রকাশ্য রাস্তায় ভিক্ষা না করে। আর, জি-২০ চলাকালীন গোটা দিল্লী শহরে কার্যত কার্ফু জারি করা হয়, বন্ধ থাকে সমস্ত স্কুল কলেজ, সরকারি বেসরকারি সংস্থা, কতজন রোজগেরে মানুষকে যে ওই কয়েকটা দিন আয় হীন, উপার্জন হীন হয়ে থাকতে হয়েছিল, তার হিসাব আর কেই বা রাখে!

দু’দিনের জি-২০ সম্মেলনের রাজসূয় যজ্ঞ উপলক্ষ্যে শুধুমাত্র দিল্লীর সৌন্দর্যায়নে খরচ হয়েছে প্রায় ৪,০০০ কোটি টাকা। সম্পদ সৃষ্টিকারী মেহনতি মানুষ, যাদের ছাড়া একমুহূর্তও সচল থাকে না মহানগরী, তাঁরাই রাষ্ট্রের চোখে হয়ে উঠল অসুন্দর, কুৎসিত, আর তাঁদের বর্বর উচ্ছেদ যজ্ঞের আবাহনেই ‘বিশ্বগুরু’ তুলে ধরলেন ‘এই কপট কদর্য’ প্রাচুর্যের ছবি।

কী নির্মম এই রসিকতা!

খণ্ড-30
সংখ্যা-32