প্রতিবেদন
নির্লজ্জ প্রগল্‌ভতা!
shameless-profundity_0

ভারতীয় নারীর রাজনৈতিক আত্মঘোষণা রাষ্ট্রের চক্ষুশূল! যেমনটা আমরা দেখেছি শাহীনবাগে। ভারতীয় নারীর স্বাধীনতা, স্বায়ত্ততা, সমানাধিকার- লিঙ্গ-বৈষম্য দীর্ণ সমাজের শিরঃপীড়া! যেমনটা গৈরিক শাসনের ভারতে উত্তরোত্তর বাড়তে দেখছি। কিন্তু সেই নারীই আজ ভোট-রাজনীতির আঙিনায় ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ আর প্রাসঙ্গিক; বিরোধী জোট-রাজনীতির মতোই বড় উৎকণ্ঠা তাকে ঘিরেও! তার ‘মন’ পাওয়া নিয়ে! কারণ? ভোটবাক্স! জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক এই ‘অর্ধেক আকাশ’কে আর উপেক্ষা করা যাচ্ছে না। তাই নির্বাচনী ইস্তাহারে তার জন্য রাজ্যে রাজ্যে হরেক রাজনৈতিক দলের হরেক জনমোহিনী প্রকল্পের মনমোহিনী পসরা!  সেখানে আমাদের ‘বিশ্বগুরু’ পিছিয়ে থাকবেন, এটা হতে পারে? তাই, যে তিনি জাতি-দাঙ্গার আগুনে ৪ মাস ধরে জ্বলতে থাকা ‘ডবল ইঞ্জিনের’ মণিপুরে নারীর চরম লাঞ্ছনায় তিন মাস ‘মৌনীবাবা’ ছিলেন, সেই তিনিই ভীষণ দিলখোলা হয়ে ‘ভারতীয় বোনেদের জন্য রাখির উপহার’ ঘোষণা করলেন!

হ্যাঁ, অবিশ্বাস্য! যে গার্হস্থ্য এলপিজি সিলিন্ডার ২০১৪-র ঠিক আগে প্রায় ৪০০ টাকা ছিল, লাগাতার বাড়তে বাড়তে (বিশ্ব বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম কমার সময়েও) আজ তার দাম ১১৫০ টাকা হয়েছে। জ্বালানির জ্বলনে ভারতীয় মহিলা সমাজ কতবার ছ্যাঁকা খেলেন এই ন’বছরে। উজ্জ্বলা যোজনার কত ‘বোন’ আবার ফিরে গেছেন সেই চোখ জ্বালা করা ঘুঁটে-কাঠ-কয়লায়। অনেকে সিলিন্ডার বিক্রি করে দিয়েছেন। যোজনার বাইরেও অনেক রান্নাঘরে সিলিন্ডার নির্বাসিত। না, তখন আমাদের স্বভাব-অভিনেতা প্রধানমন্ত্রীর প্রাণ এতটুকু গলেনি, সিল্কের রুমালে চোখের কোণ মুছতেও দেখা যায়নি। সেই তিনিই আসন্ন পাঁচটি বিধানসভা তথা ২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে, হঠাৎ সিলিন্ডার পিছু দাম ২০০ টাকা (১৮%) কমিয়ে দিলেন, যোজনার ‘বোনেদের’ জন্য ৪০০ টাকা ছাড়। ভোট বড় বালাই!

কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর বলেছেন এই খাতে চলতি অর্থবর্ষে নাকি সরকারের অতিরিক্ত ৭৬৮০ টাকা খরচ হবে। তবে সংবাদসংস্থাসূত্রে জানা যাচ্ছে, সম্ভবত এর সব দায়ভার বহন করতে হবে কেন্দ্রকে নয়, রাষ্ট্রায়ত্ত তেল বিপণনকারী সংস্থাগুলোকেই। তারা (ইন্ডিয়ান অয়েল, হিন্দুস্তান পেট্রোলিয়াম, ভারত পেট্রোলিয়াম) বর্তমান অর্থবর্ষের প্রথম ৫ মাসে বিপুল আয় করেছে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে এলপিজি-র দাম কমার জন্য তারা এই ব্যয় বহন করতে পারবে। প্রসঙ্গত সৌদি কন্ট্রাক্ট প্রাইস (যার ওপর ভিত্তি করে ভারতীয় এলপিজি-র দাম নির্ধারিত হয়) গত মার্চে ছিল প্রতি টন ৭৩২ ডলার, জুলাইয়ে তা কমে হয় ৩৮৫ ইউ এস ডলার। আগস্টে কিছু বেড়ে তা ৪৬৪ ডলার হলেও, একথা বলাই যায়, অপরিশোধিত তেলের আমদানি খরচ গত বছরের তুলনায় অনেকটাই কমেছে। সুতরাং এর সুফল দেশবাসীর নাগরিক হিসাবে অবশ্যই ‘প্রাপ্য’, এটা কোনো ‘দাক্ষিণ্য’ বা ‘উপহার’ নয়!

সরকারের সদিচ্ছা থাকলে এই প্রাপ্য আরও অনেক আগে হাতে পাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু মেলেনি! মূল্যস্তর কবে থেকে গ্যাস বেলুনের মতো আকাশে উঠে বসে আছে। এই বেলাগাম ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে সরকার চরম ব্যর্থ। আনাজ ও  খাদ্যপণ্যের দাম এতটাই বেড়েছে যে জুলাই মাসে খুচরো মূল্যবৃদ্ধি পৌঁছেছে ৭.৪৪%-এ। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর যতই আশ্বাস দিন, এই বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে আগামী আরও কয়েক মাস। এমনটাই জানিয়েছে এম আর অ্যান্ড পি গ্লোবাল রেটিংস। সামনে উৎসব। কিন্তু বহু মানুষ আজ আধপেটা খেয়ে কোনক্রমে বেঁচে আছেন। পুষ্টির মুখ শ্রমজীবী পরিবারগুলো বহুদিন দেখে না। কোভিড-এর সময় থেকে বহু মানুষ কাজ হারিয়েছেন, হারাচ্ছেন। মজুরি-বেতন বাড়ার পরিবর্তে ক্রমশ কমছে। স্বভাবতই ক্রয়ক্ষমতাও তাই নিম্নমুখী। এই অবস্থায় ঐ ২০০ টাকা কর্পূরের মতো উবে যাবে।

ভোটের তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে মহিলাদের দাক্ষিণ্য দেখাতে রাজনৈতিক দলগুলো উৎসুক, প্রতিযোগিতামূলকভাবে। কিন্তু স্বাধীনতার ৭৬তম বর্ষে, এই বিপুল জনসংখ্যাকে কেন দাক্ষিণ্যনির্ভর ক্ষুদ-কুঁড়োয় বেঁচে থাকতে হবে? কেন তাদের জন্য নাগরিক হিসাবে প্রাপ্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থায় এত অবহেলা?

সাধারণ ঘরের মেয়েদের ক্ষেত্রে অতি ব্যয়বহুল উচ্চশিক্ষার দ্বার ক্রমশ বন্ধ হচ্ছে। মোদী সরকারের সৌজন্যে এখন গবেষণাও কর্পোরেট-অনুদান নির্ভর হয়ে পড়বে। মহিলাদের কর্মসংস্থানও সংকুচিত হয়ে চলেছে। জনসংখ্যার প্রায় ৪৯% মহিলা, কিন্তু বর্তমানে জাতীয় উৎপাদনে তাদের অংশগ্রহণ মাত্র ১৮%। তার জন্য দায়ী সরকারের উপযুক্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টির পরিকল্পনার অভাব, লিঙ্গ বৈষম্য, সমাজের পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা ও কুসংস্কার। উচ্চশিক্ষিত মহিলারা উপযুক্ত কাজ ও নিরাপত্তার অভাবে এবং লিঙ্গ বৈষম্যের দরুণ কাজে যোগদানে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। পরোক্ষে তাদের এইভাবেই শ্রমশক্তি থেকে বিতাড়িত করা হচ্ছে। আর যাদের পছন্দের কোন সুযোগ নেই, সেই দরিদ্র শ্রমজীবী মহিলাদের অত্যন্ত কম মজুরিতে, চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে নিকৃষ্ট ধরনের কাজে যোগ দিতে হচ্ছে। যাদের ওপর দেশের শিশু ও মায়ের পুষ্টি নির্ভর করছে, বলতে গেলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য অনেকাংশে দাঁড়িয়ে আছে, সেই আশা, অঙ্গনওয়াড়ি, মিড ডে মিল কর্মীরা কী নৃশংসভাবে সরকারের দ্বারা প্রতারিত হচ্ছেন! প্রসঙ্গত বিশ্ব লিঙ্গ বৈষম্য সূচকে ভারত বর্তমানে ১৩৫তম অবস্থানে আছে। এর দায় সরকার নেবে না?

ভারতের জিডিপি ৩.৭ লক্ষ কোটি ডলার। কিন্তু মাথাপিছু আয়ে কেন আমরা ১৮১টা দেশের মধ্যে ১৪১তম? বিশ্ব ক্ষুধাসূচকে কেন আমরা ১২১টি দেশের মধ্যে ১০৭তম? কেন ১% ধনকুবেরের হাতে কেন্দ্রীভূত দেশের ৪০% সম্পদ? জবাব দেবেন প্রধানমন্ত্রী? তিনি আদিবাসী জনজাতিদের উচ্ছেদ করে চরম বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়ে জল জঙ্গল  জমি পাহাড় নদী খেত খামার সমস্ত কিছু ‘নজরানা’ হিসেবে তুলে দিচ্ছেন কর্পোরেটদের হাতে। আর সব কেড়ে নেওয়া দেশবাসীকে তার প্রাপ্যটাই ‘উপহার’ দিচ্ছেন! সীমাহীন নির্লজ্জতা!

ভারতীয় মহিলারা কি সুবিচার পাচ্ছেন? গুজরাত গণনিধনের অপরাধীদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বিচার পাননি জাকিয়া জাফরিসহ অন্যান্যরা। ইসরত জাহানের হত্যাকারীরা সাজা পায়নি। বিলকিস বানোর ধর্ষক তথা তার পরিজনদের হত্যাকারীদের সসম্মানে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। মহিলা মানবাধিকার কর্মীদের বিনা বিচারে জেলে আটকে রাখা হয়েছে। মহিলা কুস্তিগীরদের যৌন নিপীড়নে অভিযুক্ত ব্রিজভূষণ শরণ সিং এর বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, তিনি বহাল তবিয়তে সংসদে রয়েছেন। মণিপুরে নারীনিগ্রহের ঘটনায় সারা পৃথিবীর কাছে দেশের মাথা হেঁট হয়ে গেছে অথচ তিনি মামুলি দুঃখপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই করেননি। নুহ্-তে এখনও দুষ্কৃতীরা পরিযায়ী শ্রমিকদের মহল্লা ছাড়ার, মহিলাদের ধর্ষণের হুমকি দিচ্ছে। প্রশাসন উল্টে বলছে ‘সবাইকে নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব না’। এসব কোনো ব্যাপারে তার মুখে টুঁ-শব্দ নেই। আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ভারতীয় নারীর মনে এত ক্ষোভের আগুন জ্বেলে এখন ঐ সামান্য ‘উপহারে’ কি ভোলানো যাবে তাদের?

- জয়ন্তী দাশগুপ্ত

খণ্ড-30
সংখ্যা-31