দেশের প্রচলিত অরণ্য সংরক্ষণ আইনে বড়সড় পরিবর্তন ঘটালো বিজেপি সরকার। অরণ্য সংরক্ষণ আইন, ১৯৮০’র পরিবর্তন ঘটিয়ে নতুন সংশোধনী বিলটি ২৫ জুলাই ২০২৩ ধ্বনি ভোটে লোকসভায় পাস করানো হয়। এই সংশোধন অনুযায়ী সরকার অধিগৃহীত অরণ্যগুলিই এখন থেকে কেবল অরণ্য হিসেবে ধরা হবে। কিছু কিছু অরণ্যভূমিকে ব্যক্তি মালিকানায় বা বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য দিয়ে দেওয়া হবে। মুখে পরিবেশ ও অরণ্যরক্ষার কথা বলছে মোদী সরকার, কিন্তু যে আইন তারা করছে তা খতিয়ে দেখলে বোঝা যাচ্ছে বাস্তবে অরণ্য সম্পদের বাণিজ্যিকীকরণ এবং অরণ্যবাসীদের নানা অধিকার কেড়ে নেওয়াই তাদের এই নয়া আইনের উদ্দেশ্য।
১৯২৭ সালে ব্রিটিশ ভারতে যে বন আইন তৈরি হয়েছিল এই নয়া সংশোধনীতে তারই উত্তরাধিকার দেখা যায়। বিজেপি মুখে বলে যে তারা ঔপনিবেশিক ভারতের আইন কানুন রীতিনীতিকে বদলাতে চায়। কিন্তু তাদের কাজকর্ম ভালোভাবে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় তারা মুখে জাতীয়তাবাদের বুলি আওড়ালেও কার্যক্ষেত্রে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বার্থকে উপেক্ষা করে ভারতের জাতীয় সম্পদসমূহকে দেশি বিদেশি একচেটিয়া পুঁজিপতি মিত্রদের জন্য কুক্ষীগত রাখতে বদ্ধপরিকর।
ব্রিটিশ আমলের বন আইন অরণ্যের ওপর বনবাসীদের অধিকার খর্ব করে অরণ্য সম্পদের যথেচ্ছ লুটের ব্যবস্থা পাকা করে দিয়েছিল তাদের মিত্রদের জন্য। স্বাধীনতার অনেক পরে ১৯৮০ সালে এই আইনে বেশ কিছু বদল আনা তাই জরুরী হয়ে পড়েছিল। বিজেপি আবার চাকা পরিবেশ ও অরণ্যবাসীদের বিরুদ্ধে ঘুরিয়ে দিতে চাইছে।
১৯৫০ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে, আমাদের দেশে প্রায় ৪৩ লক্ষ হেক্টর অর্থাৎ ৪৩,০০০ বর্গ কিলোমিটার বনভূমি ধ্বংস করা হয়েছে। একদিকে সরকারের তরফে শিল্প, খনি, জলবিদ্যুৎ, পুনর্বাসন ও কৃষির মতো উন্নয়ন প্রকল্প, অন্যদিকে ব্যক্তিপুঁজির লোভ লালসা মেটাতে অরণ্যে বেআইনি দখল ছিল এই ধ্বংসের পেছনে থাকা মূল দুই কারণ।
১৯৭০’র দশক থেকে পরিবেশ আন্দোলন বিশ্বের নানা প্রান্তে জনপ্রিয় হতে শুরু করে। ১৯৭২ সালের স্টকহোম পরিবেশ সম্মেলন অরণ্য আইনকে নতুনভাবে তৈরি করার জন্য সরকারের ওপর চাপ তৈরি করে। ১৯৮০ সালের বন আইনে নতুন পরিবেশ চেতনা ও আন্দোলনের প্রভাব পড়েছিল। ১৯৫০ থেকে ১৯৮০ সাল অবধি নানা উন্নয়নমূলক কাজের জন্য ব্যাপকভাবে অরণ্য পরিবেশ ধ্বংস করা হয়েছিল। নতুন পরিবেশ সচেতনতা — নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গী বদলের দিকটির ওপর সবচেয়ে বেশি জোর দেয়। পরিবেশ প্রকৃতি ধ্বংস করে তথাকথিত উন্নয়নের মডেলটি প্রশ্নের মুখে পড়ে।
এই নতুন পরিবেশ চেতনা ও আন্দোলনের প্রেক্ষাপটেই আসে ১৯৮০ সালের অরণ্য সংরক্ষণ আইন। এই আইন এই ধরণের ব্যাপক অরণ্য ধ্বংসের পরিমাণে হ্রাস ঘটাতে সক্ষম হয়। ১৯৮০ সালের আগে অরণ্য ধ্বংসের বার্ষিক হার ছিল ১,৪৩,০০০ হেক্টর। আইন প্রবর্তনের পর এই হার কমে দাঁড়ায় বার্ষিক ৪০,০০০ হাজার হেক্টর। কেন্দ্রীয় সরকার ফরেস্ট অ্যাডভাইজরি কমিটি (FAC) গঠন করে এবং বলে যে এই কমিটির অনুমোদন ব্যতিরেকে অরণ্যভূমিকে অন্য কোনওভাবে ব্যবহার করা যাবে না।
বিজেপি সরকার ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পরেই অরণ্য আইনকে শিথিল করে বনভূমিকে কর্পোরেটদের মুনাফার বাণিজ্যিক স্বার্থে ব্যবহারের সুযোগ করে দিতে থাকে। পরিবেশ ও অরণ্য রক্ষা সম্পর্কিত সমস্ত আইনের পরিবর্তন শুরু হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য ১৯২৭’র বন আইনে আমাদের দেশে তিন ধরনের অরণ্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল।
১) রিজার্ভ ফরেস্ট — এখানে বনবাসীদের কোনও অধিকার ছিল না।
২) প্রোটেক্টেড ফরেস্ট — এখানে কেবল কাঠ নয় এমন বনজ সম্পদের উপর কিছু অধিকার বনবাসীদের ছিল।
৩) গ্রামের বনাঞ্চল — এগুলির ওপর গ্রামবাসীদের যৌথ অধিকার ছিল। অনেক ক্ষেত্রে বনবাসীদের ইষ্টদেবতার নামে কিছু বনাঞ্চল সংরক্ষিত থাকত।
২০১৮ সালের নতুন বন আইনে ১৯২৭’র আইনের সংশোধন করে আগের তিন ধরণের বনভূমির সঙ্গে আর এক ধরনের বনভূমিকে নতুন করে যুক্ত করা হয়েছে। একে বলা হয়েছে উৎপাদক অরণ্য। এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে বনজ সম্পদ উৎপাদনের জন্য নির্দিষ্ট করা যেকোনো ধরনের বনাঞ্চলকে এই ধরনের বন হিসাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় অরণ্যের যে ভূমিকার কথা ১৯৭২’র স্টকহোম পরিবেশ সম্মেলন বা ১৯৮০’র অরণ্য সংরক্ষণ আইনের মধ্যে দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, উৎপাদক অরণ্যের প্রসঙ্গটি আইনিভাবে এনে বিজেপি সরকার তার একেবারে উল্টোপথে যাত্রা করল। এই উৎপাদক বনাঞ্চলগুলিকে এবার থেকে আসবাব তৈরির কাঠ, কাগজ তৈরির কাঠ, বিভিন্ন ধরনের অকাঠজাত বনজ সম্পদ, ঔষধি গাছ ইত্যাদি উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা যাবে। সন্দেহ নেই পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে অরণ্যের যে বৃহৎ ভূমিকা রয়েছে, এরফলে তা ব্যাপকভাবে সঙ্কটে পড়বে। এই উৎপাদক অরণ্যভূমি হবে কৃষিভূমির মতো।
- সৌভিক ঘোষাল