‘এক দেশ, এক ভোট’ গণতন্ত্র ও যুক্তরাষ্ট্রীয়তার মূল সত্তাকে খর্ব করবে
democracy-and-federalism

(সম্প্রতি আরো একবার কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ‘এক দেশ, এক ভোট’ চালু করার প্রস্তাব তুলে হৈচৈ শুরু করেছে। এর আগেও দু’বার তারা এই এজেন্ডাকে সামনে এনেছিল। গত বছর ডিসেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় আইন কমিশন এই প্রস্তাবনা পাঠিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছে মতামত চেয়েছিল। সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পক্ষ থেকে সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বিস্তারিত উত্তর পাঠিয়েছিলেন। এই উত্তরের মূল বিন্দুগুলি তুলে ধরে পার্টির পক্ষ থেকে ১৬ জানুয়ারি ২০২৩ যে বিবৃতি জারি করে তা এখানে দেওয়া হল)

লোকসভা ও রাজ্য বিধানসভাগুলির নির্বাচন একসাথে করা প্রসঙ্গে আইন কমিশনের চিঠির উত্তরে সিপিআই(এমএল) সাধারণ সম্পাদক এই প্রস্তাবটির তীব্র বিরোধিতা করেন এবং এই পদক্ষেপকে অসাংবিধানিক ও অগণতান্ত্রিক বলে অভিহিত করেন। যুগপৎ নির্বাচন দেশের গণতন্ত্র ও যুক্তরাষ্ট্রীয়তার মৃত্যুঘণ্টা। যুগপৎ নির্বাচনকে বৈধতা দিতে যে সংবিধান সংশোধনীর প্রস্তাব আনা হচ্ছে তা আক্ষরিক অর্থেই সংবিধান পুনর্লিখনের নামান্তর এবং সংবিধানের বুনিয়াদি কাঠামোর লঙ্ঘন।

২৩ ডিসেম্বর ২০২২ দিনাঙ্কিত একটি চিঠির মাধ্যমে আইন কমিশন বিভিন্ন স্বার্থজড়িত পক্ষের মতামত চেয়ে পাঠায়, যদিও ২০১৮ সালে একই অনুশীলন চলেছিল এবং তখন অনেক রাজনৈতিক দলই একে অগণতান্ত্রিক গণ্য করে বিরোধিতা ব্যক্ত করেছিল। নতুন করে আবার এই যুগপৎ নির্বাচনকে, বা বলা ভালো, বিজেপির দীর্ঘ লালিত আইডিয়া ‘এক দেশ, এক ভোট’ এজেন্ডাকে, এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার তৎপরতা সংবিধানের জীবনীশক্তি গণতন্ত্র ও যুক্তরাষ্ট্রীয়তার মূল সত্তাকে খর্ব করে। আজ ‘এক দেশ, এক ভোট’-এর নামে বিজেপি রাজনৈতিক গতির চাকা উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দিতে চাইছে এবং সংবিধান সংশোধনের মধ্যে দিয়ে সমগ্র রাজনীতির এককেন্দ্রীকরণ করতে চাইছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, মনে হচ্ছে আইন কমিশন বিজেপির এজেন্ডায় ভেসে যাচ্ছে।

এক পার্টি আধিপত্য তৈরির প্রচেষ্টা

আইন কমিশনের নিজস্ব পর্যবেক্ষণ [২০১৮র “যুগপৎ নির্বাচন”-এর খসড়া প্রতিবেদনে] দেখাচ্ছে যে “তখন পর্যন্ত [১৯৬০ দশকের মধ্যভাগ] একসাথে নির্বাচনের মূল কারণ ছিল একটি মাত্র জাতীয় রাজনৈতিক দলের আধিপত্য ও শাসন এবং আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলির প্রভাব ও প্রতিপত্তি না থাকা”। পঞ্চাশ বছর আগে কংগ্রেস দলটি যে নির্বাচনী প্রাধান্য ভোগ করত এখন বিজেপি তা অর্জন করেছে বলেই তা সংবিধান সংশোধন করার এবং ইতিহাসের চাকা পেছন দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার ভিত্তি হয়ে উঠতে পারে না। বিজেপি আগামী পঞ্চাশ বছর ভারতের শাসক দল, একমাত্র শাসক দল, থাকার ইচ্ছা প্রকাশ্যেই ব্যক্ত করে থাকে। কিন্তু শাসক দলের রাজনৈতিক আকাঙ্খা চরিতার্থ করতে তো সংবিধানটাই বদলে দেওয়া চলে না।

গণতন্ত্রকে রসদ/খরচ সংক্রান্ত সুবিধা অসুবিধার অধীনস্থ বানিয়ে দেওয়া যায় না

বিধানসভা ও লোকসভা নির্বাচনের নিজ নিজ বিশিষ্ট প্রেক্ষিত আছে। পঞ্চায়েত ও পৌর নির্বাচনগুলির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। রসদ বা খরচ সংক্রান্ত বিবেচনা থেকে এইসব নির্বাচনগুলিকে একই বন্ধনীর মধ্যে এনে ফেলার অর্থ হল বিধানসভা নির্বাচনের স্বায়ত্ত ক্ষেত্রকে কেড়ে নেওয়া এবং তাকে কেন্দ্রীয় প্রেক্ষিতের অধীনস্থ করে দেওয়া। যুগপৎ নির্বাচন হলে রসদ সংক্রান্ত সুবিধা পাওয়া যাবে এবং অর্থনিয়োগ কম করতে হবে – এরকম পূর্বসিদ্ধান্ত কোনো বিশ্বাসযোগ্য সমীক্ষা দ্বারা পুষ্ট নয় বা এযাবৎ কালের নির্বাচনী ব্যয় ও রসদ ব‍ন্দোবস্তের বিশ্লেষণ দ্বারা সমর্থিত নয় (আইন কমিশনের খসড়া প্রতিবেদনেও এটা মেনে নেওয়া হয়েছে)। ফলত আর্থিক বিষয়-আশয়ে আইন কমিশনের টানা সিদ্ধান্ত প্রশ্নের মুখে পড়ে।

তাছাড়া, আইন কমিশনের খসড়া প্রতিবেদন অনুসারে ২০১৪’র নির্বাচনগুলিতে ভারতের নির্বাচন কমিশন ৩৫৮৬ কোটি টাকা খরচ হওয়ার কথা বলেছে (প্যারা ২.১০)। বিষয়টিকে প্রেক্ষাপটে স্থাপন করতে বলা যায়, বিজেপি ২০১৪ সালে কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় আসার পর ইউনিয়ন সরকার ৩২৬০.৭৯ কোটি টাকা খরচ করেছে বৈদ্যুতিন মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিতে এবং ৩২৩০.৭৭ কোটি টাকা খরচ করেছে ছাপা মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিতে। সত্যি যদি টাকা বাঁচানোটাই প্রশ্ন হয় তাহলে স্পষ্টতই নজরটা অন্যত্র পড়ার কথা। খরচের প্রশ্নটা কখনই গণতন্ত্রের মূল নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয় হতে পারে না।

undermine-the-essence-of-democracy
আদর্শ আচরণ বিধির ক্ষেত্রে কমিশনের দৃষ্টিভঙ্গি গণতন্ত্রের কেন্দ্রে জনতার থাকার ধারণার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা

যুগপৎ নির্বাচনের প্রস্তাবের যথার্থতা প্রমাণ করতে আইন কমিশন খানিক অসৎ একটি যুক্তির অবতারণা করেছে আদর্শ আচরণ বিধিকে ঘিরে। আদর্শ আচরণ বিধি উন্নয়নকে ব্যাহত করে না বা শ্লথ করে দেয় না; তা সরকারের ওপর কিছু নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে মাত্র যাতে সরকার নতুন প্রকল্প বা পলিসি ঘোষণার মাধ্যমে ভোটারদের প্রভাবিত করতে না পারে। নির্বাচন জনগণকে সক্ষম করে সরকার বা তার তথাকথিত উন্নয়নের কার্যকলাপকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে বা সে সম্পর্কে নিজেদের মতামত ব্যক্ত করতে। আচরণবিধিকে উন্নয়নের পথের বাধা হিসেবে দেখানোটা গণতন্ত্রে জনগণের কেন্দ্রীয়তার বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করে শাসনব্যস্থার সাথে প্রতিনিধি বেছে নেওয়ার জনগণের অধিকারের, যে কোনো সরকার সম্পর্কে, সরকারের কাজ সম্পর্কে, বা তার তথাকথিত উন্নয়ন পরিকল্পনা সম্পর্কে জনগণের মতামত দেওয়ার অধিকারের, এক কৃত্রিম বিরোধ খাড়া করে।

সাংবিধানিক নৈতিকতাকে ও সংবিধানের বনিয়াদকে লঙ্ঘন করছে

আইন কমিশন বুনিয়াদি কাঠামো সংক্রান্ত অনুশাসনের ভুল আইনি ব্যাখ্যার আশ্রয় নিচ্ছে এর প্রয়োগক্ষেত্রকে সংকুচিত করার উদ্দেশ্যে যাতে একটা সমস্যাজনক ও গ্রহণ-অযোগ্য যুক্তিকে মান্যতা দিয়ে বলা যায় যে সংবিধান পুনর্লিখন হলেই তা মৌলিক কাঠামো লঙ্ঘন নয়।

কোনো গণতন্ত্রে পরিবর্তনশীল সাংবিধানিকতা এই বাধ্যবাধকতা তৈরি করে যে, যে কোনো সংবিধান সংশোধনীকে মৌলিক কাঠামোর নিরিখ ছাড়াও সাংবিধানিক নৈতিকতা, সাংবিধানিক শাসন ও সাংবিধানিক বস্তুগততার নিরিখেও অবশ্যই পরীক্ষিত হতে হবে। অবশ্য, বিদ্যমান সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থাকে কার্যত প্রতিস্থাপন করে দেবে এমন সব ব্যাপক-বিস্তৃত সংবিধান সংশোধনীর প্রস্তাব থাকা সত্ত্বেও সমগ্র খসড়া প্রতিবেদনে ‘সাংবিধানিক নৈতিকতার’ ধারণাটিই সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত।

যুগপৎ নির্বাচনের রাস্তা পরিষ্কার করার লক্ষ্যে ব্যাপক-বিস্তৃত সংবিধান সংশোধনীসমূহকে যথার্থতা দিতে আইন কমিশন ভারতীয় বিচারশাস্ত্রের ভোটাধিকার ও নির্বাচিত করার অধিকারকেই অযথা খাটো করতে চেয়েছে। সংসদীয় গণতন্ত্র, বহুদলীয় ব্যবস্থা এবং অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন – এগুলো সবই সংবিধানের বুনিয়াদি কাঠামোর অঙ্গ। সংসদ ও রাজ্য বিধানসভাগুলির যুগপৎ নির্বাচনকে বাধ্যতামূলক করা যে কোনো সংবিধান-সংশোধনী সংবিধানের বুনিয়াদি কাঠামাকেই আঘাত করবে এবং সংবিধানের জীবনশক্তি যে গণতন্ত্র ও যুক্তরাষ্ট্রীয়তা তার মূল সত্তাকেই খর্ব করবে।

আমরা তাই আইন কমিশনের কাছে আবেদন জানাচ্ছি যে তারা এই অবাঞ্ছিত ও বিপর্যয়সম্ভব কার্যভাবনা থেকে সরে আসুক।

খণ্ড-30
সংখ্যা-31