বনভূমিতে বাস করা জনগণের কাছে ২০২৩ সাল হাজির হয়েছে ২০০৬-এর তুলনায় অনেক ফারাক নিয়ে। ইউপিএ জমানায় ২০০৬ সালে তৈরি বনাধিকার আইনের বলে বনবাসীরা নিজেদের বনভূমিকে সুরক্ষিত রাখতে ও তার তত্ত্বাবধান করতে পারতেন, কাঠ ছাড়া বনে উৎপাদিত অন্যান্য দ্রব্যসমূহ সংগ্ৰহ করে নিজেদের প্রয়োজনে লাগাতে এমনকি বিক্রি করতেও পারতেন, বনভূমিতে পশু চরাতে পারতেন এবং সেখানের জলাশয়গুলিকে ব্যবহারের অধিকারও তাঁদের ছিল। এই আইনের বলেই বনভূমিতে শিল্প স্থাপনের জন্য গ্রামসভার সম্মতি অপরিহার্য ছিল, এবং প্রকৃতির সুরক্ষায় সরকার ও কর্পোরেট প্রস্তাবিত শিল্প প্রকল্পকে বাতিল করার ক্ষমতাও গ্রামসভার ছিল। কিন্তু ২০২৩ সালের জুলাই মাসে বন সংরক্ষণ আইনে আনা মোদী সরকারের সংশোধনী বনভূমিতে শিল্প স্থাপনে গ্রামসভার সম্মতিকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নাকচ করেছে, বনভূমি হাতানোর কর্পোরেট অভিপ্রায়ের সিদ্ধিকে অনেক অনায়াস করেছে, ‘উন্নয়ন’-এর নামে প্রকৃতি ধ্বংসের পথকেও প্রশস্ত করা হয়েছে। সংশোধিত আইনে বন বলে বিজ্ঞাপিত নয় এমন বনভূমিকে (যেগুলোর পরিমাণ মোট বনভূমির তিন চতুর্থাংশ) লিজ দেওয়ার জন্য গ্রামসভার সম্মতি এখন পরিহার্য। অথচ, ২০০৬ সালের আইনই নির্দিষ্ট পরিবেশে শিল্প স্থাপনের যুক্তিসিদ্ধতা নির্ধারণের অধিকার বনাঞ্চলের গ্রামবাসীদের দিয়েছিল, এই ক্ষমতার বলেই তাঁরা বেদান্তর মতো সরকার ঘনিষ্ঠ অতীব ক্ষমতাশালী কর্পোরেটকে নিয়ামগিরি পাহাড়ে বক্সাইট খনন প্রকল্প স্থাপন থেকে দীর্ঘদিন দূরে রাখতে পেরেছিলেন, প্রকৃতিকে বিপর্যস্ত হতে না দেওয়ার লক্ষ্য পূরণে কর্পোরেটদের মতো ক্ষমতাশালী সংস্থার সঙ্গে লড়াইয়ের আইনি সামর্থ্য তাঁরা পেয়েছিলেন।
যে ওড়িশায় বনবাসীদের বেদান্ত-বিরোধী ঐতিহাসিক লড়াই দেখা গিয়েছিল সেই ওড়িশাতেই এখন সংশোধিত বন সংরক্ষণ আইনের বলে বনাঞ্চল সংলগ্ন গ্রামবাসীদের মতামত উপেক্ষা করে সরকার ঘনিষ্ঠ করপোরেটদের লিজ দেওয়া হচ্ছে বনভূমি। বক্সাইট খননের জন্য আদানিদের লিজ দেওয়া হয়েছে রায়গড়া ও কালাহান্ডি জেলার মধ্যবর্তী কুটরুমালি পর্বত, বেদান্ত গোষ্ঠী পাচ্ছে রায়গড়া জেলার সিজমালি পার্বত্য অঞ্চল, আর হিন্দালকো গোষ্ঠীর বক্সাইট খনন প্রকল্প হচ্ছে কোরাপুট জেলার পতঙ্গ ব্লকের মালিপর্বত এলাকায়। এই প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন হলে নিজেদের বসবাসের জমি থেকে উচ্ছেদের এবং জীবনধারণের উপায় থেকে বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা যেমন অনিবার্য, সেরকমই অমোঘ হলো যে প্রকৃতির সঙ্গে তাঁদের আত্মিক সম্পর্ক তার ধ্বংসের অবশ্যম্ভাবিতা। তাঁরা তাই দীর্ঘদিন ধরেই এই প্রকল্পগুলোর বিরোধিতায়, সেগুলির প্রতিরোধে সক্রিয় হয়েছিলেন। কিন্তু কর্পোরেট সংস্থাগুলো যেমন কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় সরকারেরই মদত পেয়ে থাকে, তেমনি তারা প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদরত জনগণের বিরুদ্ধে ভাড়াটে গুণ্ডাবাহিনীকেও লাগায়। এই গুণ্ডাবাহিনী বেশ কয়েকজন প্রকল্প-বিরোধী আন্দোলনকারীকে অপহরণ করেছে। এরা আবার আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলে পুলিশকে, এবং পুলিশও তাদের কথায় আন্দোলনকারীদের ও আন্দোলনের নেতৃবর্গকে গ্রেপ্তার করে। গত তিন সপ্তাহে পুলিশ অন্তত ২৫ জন প্রতিবাদী জনগণকে গ্রেপ্তার করেছে। গত ১৮ সেপ্টেম্বর সোমবার জনজাতি অধিকার সংগঠন প্রকল্পগুলো এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংগঠিত করে কর্পোরেট সংস্থাগুলোকে দেওয়া লিজ বাতিল করার দাবি জানায়, এবং প্রতিবাদকারী যুবকদের বিরুদ্ধে নিপীড়ন বন্ধে সোচ্চার হয়। বনবাসীদের সংগঠন মূলনিবাসি সমাজসেবক সংঘ দিল্লীতে সাংবাদিক সম্মেলন করে সংশোধিত আইন প্রত্যাহারের দাবি তোলে। মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মী ও আইনজীবী বিশ্বপ্রিয় কানুনগো দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকাকে জানিয়েছেন, “৯৪ জনের বিরুদ্ধে হত্যার চেষ্টার মামলা রুজু হয়েছে এবং আরও ২০০ জন নাম অনুল্লেখিত ব্যক্তির বিরুদ্ধেও অভিযোগ দায়ের হয়েছে।” গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৯ জনের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হয়েছে দানবীয় আইন ইউএপিএ। প্রতিবাদকারী জনগণের বিরুদ্ধে নিপীড়নের এক শঙ্কাজনক নিদর্শন দেখা গেল গত ২৬ আগস্ট। সেদিন সাদা পোশাক পরিহিত কয়েকজন মোটরবাইকে এসে কোরাপুটের মালি পর্বত সুরক্ষা সমিতির দুই কর্মকর্তা অভি সোডি ও দাস খাড়াকে তুলে নিয়ে যায়। কালাহান্ডি জেলার নিয়ামগিরি এবং রায়গড়া জেলার সিজমালি ও কুটরুমালি এলাকাতেও একই ধরনের ঘটনা ঘটে ৫ ও ১৬ আগস্ট। যারা এইভাবে তুলে নিয়ে যায় তাদের সাদা পোশাকের পুলিশ বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। পুলিশ হোক বা করপোরেটদের লাগানো দুর্বৃত্তই হোক, এটা যে সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধে চালোনো নির্ভেজাল নিপীড়ন তা কেউই অস্বীকার করতে পারবেন না।
ওড়িশার নবীন পট্টনায়ক সরকার এনডিএ ঘেঁষা এবং মোদী সরকারের কর্পোরেটপন্থী নীতিমালার অনুগামী। কর্পোরেটদের স্বার্থ রক্ষায় নবীন পট্টনায়ক সমস্ত ধরনের সহায়তা জুগিয়ে থাকেন। মূলনিবাসি সমাজ সংঘের নেতা মধু অভিযোগ করেছেন– ওড়িশা সরকার আদানি ও বেদান্ত গোষ্ঠীকে বক্সাইট খননের বনজমি লিজ দেয় এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে। বন আইন তখনও সংশোধিত হয়নি। আইন সংশোধনের আভাস তিনি সম্ভবত পেয়েছিলেন, আর তাই এই বেআইনি কাজটা করতে, গ্রামসভার সম্মতি না নিয়েই জমি লিজ দিতে তিনি একটুও দ্বিধা করেননি। মধু আরও জানিয়েছেন, আদানি ও বেদান্তর খনি প্রকল্পের বাস্তবায়নে ১৮০টা গ্রাম অস্তিত্বহীন হবে এবং ২ লক্ষ জনগণ বাস্তুচ্যুত হবেন।
বনাঞ্চলে খনি প্রকল্পের বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগণের বিরোধিতা ও তাদের দাবিগুলো সম্পর্কে ওড়িশার ইস্পাত ও খনি মন্ত্রী প্রফুল্ল কুমার মালিককে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “আমরা ওদের দাবিগুলো সম্পর্কে অবহিত নাই। ওরা দাবিগুলো তুলে ধরলে আমরা বিবেচনা করব।” নবীন পট্টনায়ক সরকার প্রকল্প বিরোধী আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে নিপীড়ন নামিয়েছে, বেশ কিছু আন্দোলনকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং অন্যান্যদের বিরুদ্ধেও হত্যার চেষ্টার অভিযোগ আনা হয়েছে, কারো-কারো বিরুদ্ধে ইউএপিএ পর্যন্ত প্রয়োগ করা হয়েছে। এর পরও মন্ত্রী যখন বলেন যে তিনি আন্দোলনরত জনগণের দাবি সম্পর্কে অবগত নন, তখন তাঁর মন্তব্যের সত্যতা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে থাকতে পারে না। এবং ওড়িশা সরকার যে মাত্রায় কর্পোরেটদের মদত জোগাচ্ছে তাতে তাঁদের বিবেচনা কতটা প্রতিবাদকারী জনগণের স্বার্থের অনুকূল হবে তা যে কেউই অনুমান করে নিতে পারবেন।
ওড়িশার বনাঞ্চলে বসবাসকারী গ্রামবাসীরা দীর্ঘদিন ধরেই সরকার-কর্পোরেট যৌথ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে নিপীড়ন নামাতে সরকার তাঁদের কখনও ‘মাওবাদী’, কখনও বা ‘উন্নয়ন বিরোধী’ বলে ছাপ মেরে দেয়। এই দীর্ঘ লড়াইয়ের প্রক্রিয়াতেই নিয়ামগিরি সুরক্ষা সমিতির সভাপতি লাড়া সিককা ২০১৮র এপ্রিলে বলেছিলেন, “বলা হচ্ছে যে আমরা উন্নয়ন-বিরোধী। আমাদের কাছে নিয়ামগিরির বাস্তুতন্ত্রই অগ্রাধিকারে রয়েছে। আমরা এর বন, নদী, বৃক্ষরাজিকে রক্ষা করতে চাই। আমরা একই সঙ্গে চাই আমাদের ভাষায় শিক্ষা, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, এবং আমাদের উৎপাদিত বনভিত্তিক দ্রব্যগুলি বাজারে বিক্রির জন্য সরকারি সহায়তা। আমাদের যা কিছু প্রয়োজন সবই বন থেকে পাই, আমরা রাস্তা চাই না যদি তা বোঝায় যে এখানে কোম্পানিকে খনন কাজ চালানোর অনুমতি দেওয়া হবে।” এই অবস্থান বনবাসীদের জীবনধারার সঙ্গে আজও একশ শতাংশ সংগতিপূর্ণ। আর এর জন্য তাঁদের যে সরকার-কর্পোরেট গাঁটছড়ার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে তা নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে তাঁরা খুব ভালো করেই জানেন। তাঁরা আরো জানেন, মোদী সরকারের “সবকা সাথ, সবকা বিকাশ”-এর সাধু ঘোষণা পরিণতি পেয়েছে “কর্পোরেটকা বিকাশে”। তাঁদের উপলব্ধি হল, সরকারের কাছ থেকে সুবিচার তাঁরা পাবেন না, লড়াই করেই তাঁদের ন্যায় আদায় করে নিতে হবে। আর কর্পোরেটদের বনজমি হাতানোকে সম্ভবপর করতেই বন সংরক্ষণ আইনে সংশোধন আনা হয়েছে বলে যে কথা মুখে-মুখে ফিরছে, সংশোধিত বন সংরক্ষণ আইন বাতিলের যে দাবি সামনে এসেছে তাকে ওঠাতে হবে আরও সোচ্চারে।
- জয়দীপ মিত্র