সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয় : মোদীর রকফেলার
modis-rockefeller_0

কর্পোরেট জগতের বিশ্বস্ত মুখপত্র ‘ফাইনান্সিয়াল টাইমস্’ সেই ১৩ নভেম্বর ২০২০ সালেই ‘মোদীস্ রকফেলার : গৌতম আদানি অ্যান্ড দ্য কনসেন্ট্রেশন অফ পাওয়ার ইন ইন্ডিয়া’ শিরোনামে এক নিবন্ধ প্রকাশ করে। তাতেই মোদীর আমলে তাঁর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু আদানি’র উল্কাগতিতে উত্থানের নেপথ্যে কীভাবে কেন্দ্রীয় সরকার ও তার আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দরাজ হাত ছিল, তা তুলে ধরে। কিভাবেই বা সরকারি বদান্যতায়, সমস্ত নিয়ম কানুনকে দুমড়ে মুছড়ে, রাজনৈতিক নীতি নির্ধারণকে প্রভাবিত করে, কোনো অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও ২০১৮-তে রাতারাতি আদানি ছ’ছটা বিমান বন্দরের মালিকানা হাতিয়ে নিল, তার বর্ণনাও রয়েছে। সেই আদানিকে নিয়ে বিতর্কের আর শেষ নেই। ক’দিন যাবত, ভারতের রাজনীতি আবার সরগরম হয়ে উঠল সেবি কিভাবে আদানির সমস্ত আর্থিক অপরাধকে ধামা চাপা দিয়েছে, বা দেখেও না দেখার ভান করেছে। আর যার আমলে এই ধামাচাপা দেওয়া হয়েছিল, সেবি’র সেই কর্ণধার এখন আদানি’র দখলে থাকা এনডিটিভি’র এক স্বাধীন ডিরেক্টর!

এবার, শ্রীলঙ্কার রাজনীতিও সরগরম হয়ে উঠল আদানিকে কেন্দ্র করে। ঘটনার শুরু ২০২২’র জুন। সিলন (শ্রীলঙ্কার পূর্বতন নাম) ইলেক্ট্রিসিটি বোর্ডের কর্ণধার ফার্ডিনান্ডো শ্রীলঙ্কার পাবলিক এন্টারপ্রাইজ কমিটির কাছে জানান যে ২০২১ সালের নভেম্বরে রাষ্ট্রপতি রাজাপক্ষ তাঁকে বলেন, প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ প্রকল্পটি যেন ভারতের আদানিই পায়, কারণ ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাঁর কাছে ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন ওই প্রকল্পটির বরাত যেন আদানিকে দেওয়া হয়। প্রবল রাজনৈতিক চাপের মুখে, ঠিক তার তিনদিন পর ফার্ডিনান্ডো নিজের মন্তব্যকে সরকারিভাবে প্রত্যাহার করে পদত্যাগ করেন, যা নিয়ে সেই সময় শ্রীলঙ্কার ঘরোয়া রাজনীতি আলোড়িত হয়।

এবার, কলম্বো’স্থিত শ্রীলঙ্কার প্রথম সারির সংবাদপত্র ‘সান্ডে টাইমস্’ ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ একটি খবর প্রকাশ করে জানায় যে ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের যে বিনিয়োগের ভিত্তিতে ভারতের আদানি গ্রীণ এনার্জি লিমিটেডকে ৫০০ মেগাওয়াটের বরাত বরাদ্দ করেছিল, তা এবার ভারত সরকার ও শ্রীলঙ্কা সরকারের পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে বিদ্যুৎ প্রকল্প হিসাবে বিবেচিত হবে।

কিন্তু কেন? কারণ, শ্রীলঙ্কার বিদ্যুৎ আইন অনুযায়ী কোনো বেসরকারি সংস্থাকে বিদ্যুৎ প্রকল্পে বরাত সরাসরি দেওয়া যাবেনা। অত্যন্ত স্বচ্ছতার সাথে, প্রতিযোগিতামূলক খোলা টেন্ডারে যে সংস্থা যোগ্যতাবলে তা অর্জন করবে, সেই প্রকল্প পাবে। কিন্তু, প্রধানমন্ত্রী মোদীর ‘ইচ্ছাপূরণ’ করতে গিয়ে সেই আইন লঙ্ঘন করতে হল। তাই, টেন্ডার ছাড়াই আদানির বিদ্যুৎ প্রকল্পকে আইনি জামা পরাতে ‘দুই সরকারের বোঝাপড়ার ভিত্তিতে’ আদানি এবার পেয়ে যাচ্ছেন বিপুল বিনিয়োগের সেই শাঁসালো শ্রীলঙ্কার প্রকল্প! সেখানে বিরোধীরা সঙ্গত প্রশ্ন তুলেছেন, বেসরকারি সংস্থা আদানি’র প্রকল্পকে কোন যুক্তিতে ভারত সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে?

হিন্ডেনবার্গ আদানিকে আখ্যা দিয়েছে, “এযাবৎ কর্পোরেট জগতের সবচেয়ে বড় জোচ্চোর” হিসাবে। ক্যাগ রিপোর্টও প্রশ্ন করেছে, সড়ক তৈরির কোনো ধরনের যোগ্যতা আদানি ট্রান্সপোর্টের না থাকা সত্ত্বেও তেলেঙ্গানায় সূর্যপেট থেকে খাম্মাম পর্যন্ত ২৫০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের বরাত কি করে তারা পেল। শুধু তাই নয়, ক্যাগ রিপোর্ট এই অভিযোগও তুলেছে যে প্রকৃত খরচের তুলনায় প্রকল্পটির খরচ অনেক বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে।

মোদীর ‘আত্মনির্ভর ভারত’ গড়ার ছলনাময় স্লোগানকে বাস্তবায়িত করতে আদানিও দেশগঠন, দেশপ্রেমের মোড়কে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান সহ নানা সংস্থার মদত নিয়ে অত্যন্ত অল্প সময়ের ব্যবধানে দৈতাকার এক সাম্রাজ্যের কর্ণধার হয়ে উঠেন। বিজেপির স্বদেশী জাগরণ মঞ্চ খোলাখুলি আদানির পক্ষ নিয়ে যুক্তিজাল বুনেছে।

হিন্দুত্ব-দেশপ্রেম-আদানি-দেশের আর্থিক আত্মনির্ভরতা একাকার হয়ে মোদী ফ্যাসিবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ক্রোনি পুঁজিবাদ আজ চরম বর্বর রূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে।

আসন্ন দিনগুলোতে এই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুটি আবার এক বড় ধরনের রাজনৈতিক ঝড় তৈরি করবে।

খণ্ড-30
সংখ্যা-31