সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয় : স্পেনে মমতার শিল্পায়নী মডেল
model-in-spain

আবার মৃত্যু হল এ রাজ্যের চারজন পরিযায়ী শ্রমিকের। একই পরিবারের। আলিপুরদুয়ারের কুমারগ্রামের সংকোশ চা বাগানের নেপালি লাইনে এই শ্রমিক পরিবারটির বাড়ি। বোঝাই যাচ্ছে, চা বাগিচার নিতান্ত অল্প মজুরিতে দিন গুজরান করতে না পেরে এই পরিবারটি পাড়ি দেন বেঙ্গালুরুর এক পোল্ট্রি ফার্মে। সেখানেই মৃত্যু হয় দুর্ঘটনায়। কয়েকমাস ধরেই ভিন রাজ্যে একের পর এক পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যুর মিছিল এ রাজ্যে কর্মহীনতার ধারাবাহিক সংকটকে প্রকট রূপে আবার সামনে আনল।

দুয়ারে সরকারের যে কর্মসূচি চলছে, সরকারি তথ্য অনুযায়ী তাতে এখন পর্যন্ত ১২.১৫ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক তাঁদের নাম নথিভুক্ত করেছেন। রাজ্যের স্বরাষ্ট্র সচিব জানিয়েছেন, ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই নথিভুক্তিকরণের কাজটি চলবে। এই রাজ্য থেকে কত সংখ্যক পরিযায়ী শ্রমিক অন্য রাজ্যে ছুটছেন, তার এক তথ্য ভান্ডার তৈরি করতে রাজ্য সরকার সম্প্রতি এক উদ্যোগ নিয়েছে। নথিভুক্ত পরিযায়ীদের মৃত্যু বা দুর্ঘটনায় আহত হলে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা রয়েছে। সংবাদে প্রকাশ, মৃত পরিযায়ী শ্রমিকের স্ত্রীকে সরকারের প্রতিনিধি ক্ষতিপূরণ দিতে গেলে তিনি প্রশ্ন করেন, “টাকা চাই না, চাকরি দিন”। অযুত-নিযুত পরিযায়ী শ্রমিকদের মনের কথা কয়েকটি বাক্যের মাধ্যমে যেন গোটা রাজ্যে প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল তাঁর মাধ্যমে।

২০১১-র সর্বশেষ সেন্সাস অনুয়ায়ী এ রাজ্য থেকে ভিন রাজ্যে চলে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের সংখ্যা ছিল ৫.৮ লক্ষ। এতদিনে এই সংখ্যা যে বহুগুণ বেড়েছে, সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র সচিবের দেওয়া তথ্যেই তার প্রমাণ মেলে। লক্ষ্য করার বিষয়, রাজ্যের সমস্ত জেলা থেকেই দলে দলে শ্রমিক অন্য রাজ্যে চলে যাচ্ছেন। কাজের অভাবের জন্যই যে অন্যত্র তাঁরা চলে যাচ্ছেন, তা কিন্তু নয়। এরাজ্যে একেবারে নিচের দিকে অসংগঠিত শ্রমের মজুরি এতই কম, যে এমনকি রং পালিশ, ইঁট ভাটার কাজের খোঁজেও তাঁরা রাজ্যের বাইরে চলে যাচ্ছেন। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্যই দেখাল, এরাজ্যে দিন মজুরদের মজুরি জাতীয় গড়ের তুলনায় বেশ খানিকটা কম। এছাড়া বেশ কিছুদিন ধরে এরাজ্যে একশ দিনের কাজ বন্ধ হওয়ার ফলে ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে নেমে আসা সংকট এই প্রবণতাকে অনেক বাড়িয়ে তুলেছে।

১২ দিনের জন্য স্পেন ও সংযুক্ত আমিরশাহী সফরে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী। সফর সঙ্গী হিসাবে ছিলেন মুখ্য সচিব, মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের কর্ণধার, এবং বার্সালোনায় তাঁর সাথে যোগ দেন সৌরভ গাঙ্গুলি। সংবাদে প্রকাশ, বার্সালোনায় স্পানিশ বনিক সংস্থাগুলোর সাথে তিনি সভাও করেছেন। সেখানে শিল্পপতিদের সামনে এ রাজ্যে পুঁজি বিনিয়োগের অনুকূলে যে পাঁচটি ‘অ্যাডভান্টেজ’এর কথা মমতা শুনিয়েছেন তার মধ্যে দু’টি হল দক্ষ মেধাসম্পন্ন সস্তা শ্রম এবং ‘এরাজ্যে ধর্মঘট করতে দেওয়া হয়না’-র ঔদ্ধত্যপূর্ণ বিজ্ঞাপন। দক্ষ মেধা সম্পন্ন শ্রমিকদের এরাজ্যে ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত করার পেছনে যে রাজ্য সরকারের প্রশ্রয় রয়েছে আর সরকার তাঁদের শিল্প গণতন্ত্র (ধর্মঘট করার অধিকার) হরণ করেছে, খোদ মমতাই এই দু’টি শর্তকে বিজ্ঞাপিত করে উন্মোচিত করলেন তাঁর শ্রমিক বিরোধী ভাবমূর্তি। যখন গোটা পৃথিবী জুড়ে জীবাশ্ম জ্বালানির বিরুদ্ধে তীব্র জনমত গড়ে উঠছে তখন “এশিয়ার বৃহত্তম কয়লা ক্ষেত্র ডেউচা পাচামিকে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের” উৎস হিসাবে চিহ্নিত করে বুঝিয়ে দিলেন, বৈশ্বিক জলবায়ু সংকটকে প্রশমিত করতে তাঁর কোনও দায় নেই, তিনি বিন্দুমাত্রও চিন্তিত নন।

বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছরের স্থায়ী সরকার বা পরবর্তীতে তৃণমূলের ১২ বছরের নিরবচ্ছিন্ন শাসনকাল কিন্তু রাজ্যে গ্রামীণ বা শিল্প অর্থনীতির কোনও উন্নয়ন ঘটাতে পারল না। এটা আরেকবার প্রমাণ করল, রাজনৈতিক ক্ষমতার স্থায়ী কেন্দ্র উন্নয়নের সোপান নয়। সমস্ত রাজ্যের (এমনকি গুজরাটও) তুলনায় একমাত্র মহারাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি পুঁজি বিনিয়োগ সেই পর্বে হয়, যখন ওই রাজ্যের রাজনৈতিক ক্ষমতায় সবচেয়ে বেশি টানাপোড়েন চলছিল।

শোভন কাজ, ভদ্রস্থ মজুরি, সামাজিক সুরক্ষা, ঝুঁকিবিহীন সুরক্ষিত কর্মস্থল, শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সম্মত বাসস্থান — অত্যন্ত মৌলিক এই শর্তগুলোকে পূরণ করাই হল এরাজ্যে শিল্পায়নের আরম্ভবিন্দু।

খণ্ড-30
সংখ্যা-33