ইতিমধ্যেই আমাদের সামনে ক্যাগ রিপোর্ট এসেছে, সেখানে পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতির কথা আমরা জেনেছি। টাকার অঙ্কটা বিশাল — সাড়ে সাত লক্ষ কোটি! রাস্তাঘাট তৈরি, বা অযোধ্যা উন্নয়ন প্রকল্পের কথা আমরা সংবাদপত্রে পড়েছি। এই লেখার বিষয় সেগুলো নয়, বরং আরো যেসব বিষয় উঠে এসেছে ক্যাগের রিপোর্টে সেগুলি। আশা করি এখান থেকে বিজেপি সরকারের এই আর্থিক দুর্নীতি তথা ক্যাগ রিপোর্টের অন্তর্নিহিত ভয়াবহতা সম্পর্কে আরো একটু স্পষ্ট ধারণা হবে।
ক্যাগের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী আয়ুষ্মান ভারত (প্রধানমন্ত্রী জন আরোগ্য যোজনা) প্রকল্পের প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ উপভোক্তার নাম একটাইমাত্র মোবাইল নাম্বারে নথিবদ্ধ ‘৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯’। সঠিক করে বললে সংখ্যাটা ৭,৪৯,৮২০ জন। এবং এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এরকম উদাহরণ আরও আছে। ১.৩৯ লক্ষ থেকে বেশি সংখ্যক উপভোক্তার নাম নথিবদ্ধ আছে ‘৮৮৮৮৮৮৮৮৮৮’ মোবাইল নম্বরের সাথে। ৯৬,০০০ সংখ্যক উপভোক্তার নামের সাথে আছে ‘৯০০০০০০০০০’ মোবাইল নম্বর। স্কুলে বাংলার শিক্ষা পোর্টালে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, অনেক স্টুডেন্টের মোবাইল নম্বর নেই, কিন্তু মোবাইল নম্বরের ফিল্ডটা যেহেতু ম্যানডেটরি, তাই যাখুশি নম্বর একটা না দিলে হয়না। কিন্তু তা বলে লাখ লাখ লোকের! এছাড়াও ক্যাগের রিপোর্ট থেকে দেখা যাচ্ছে এরকম আরও ২০টা নম্বরে ১০,০০০ থেকে ৫০,০০০ উপভোক্তার নাম নথিবদ্ধ করা আছে। ক্যাগ তাদের রিপোর্টে এটাও উল্লেখ করেছে যে এই প্রকল্পে মোবাইল নম্বরের গুরুত্ব কতখানি। যদি কেউ তার পরিচয়পত্র হারিয়ে ফেলে, তাহলে তা পুনরায় ইস্যু করার জন্য মোবাইল ফোন নম্বরই একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।
ক্যাগ রিপোর্টে বলেছে যে ন্যাশনাল হেলথ অথরিটি তার এই পর্যবেক্ষণ মেনে নিয়েছে এবং বলেছে যে এইসব অসংগতি পরেরবার যখন বেনিফিশিয়ারি আইডেনটিফিকেশন সিষ্টেম ২.০ চালু করা হবে, তার মধ্যে মিটিয়ে ফেলা হবে। যদিও সেটা কীভাবে সম্ভব কেউ জানে না। হেলথ অথরিটির কথায়, “বিআইএস ২.০ ব্যবস্থাকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক পরিবার ছাড়া আর কেউ একই মোবাইল নম্বর ব্যবহার করতে না পারে।”
ক্যাগের ওই রিপোর্টেই পর্যবেক্ষণ রয়েছে যে কয়েক হাজার পরিবারের ক্ষেত্রে অবাস্তব সদস্যসংখ্যা দেখানো হয়েছে। ৪৩,১৯৭টা পরিবারের সদস্যসংখ্যা দেখানো হয়েছে ১১ থেকে ২০১ জনের মধ্যে। এই ক্ষেত্রেও ন্যাশনাল হেলথ অথরিটি ক্যাগের এই পর্যবেক্ষণকে মেনে নিয়েছে। তারা বলেছে যে তারা এমন একটা নীতি তৈরি করছে যাতে ডাটাবেসে একটা পরিবারের সর্বোচ্চ সদস্যসংখ্যা কোনোমতেই উপভোক্তা কোনো পরিবারের ক্ষেত্রে ১৫ জনের বেশি সদস্যকে যুক্ত হতে দেবে না।
ক্যাগ তার রিপোর্টে দেখিয়েছে যে ন্যাশনাল সোশ্যাল অ্যসিস্ট্যান্স প্রোগ্রামে ২০১৭ থেকে ২০২১’র মধ্যে ২,১০৩ জন এমন ব্যক্তিকে পেনশন দেওয়া হয়েছে যারা মৃত। এই ন্যাশনাল সোশ্যাল অ্যসিস্ট্যান্স প্রোগ্রাম হল এমন একটা ব্যবস্থা যেখানে দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা বৃদ্ধ, বিধবা আর প্রতিবন্ধীদের পেনশন দেওয়া হয়। রিপোর্টে আরো দেখানো হয়েছে যে এই যে ব্যক্তিরা মারা গেছেন, সেই মারা যাওয়ার ঘটনা সময়মত সেই সেই অঞ্চলের পঞ্চায়েত বা পৌরসভা রিপোর্ট করেনি। এই তালিকায় সবার ওপরে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের নাম (৪৫৩ জন)। তারপর গুজরাত (৪১৩ জন), আর তারপর ত্রিপুরা (২৫০ জন)।
আয়ুষ্মান ভারত (প্রধানমন্ত্রী জন আরোগ্য যোজনা) প্রকল্প চালু হয় ২০১৮ সালে। এই প্রকল্পে এখনো পর্যন্ত মোট ৬.৯৭ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে এমন ৩,৪৪৬ জন রোগীর পেছনে, যারা আগেই মৃত ঘোষিত। ক্যাগের রিপোর্টে এমনই তথ্য উঠে এসেছে। এই আয়ুষ্মান ভারত বা পিএমজেএওয়াই হল এমন একটা প্রকল্প যেটা তৈরি করা হয়েছিল একটা ফ্ল্যাগশিপ স্কিম হিসাবে। এটা প্রকৃতপক্ষে গরিব মানুষদের জন্য পরিবার পিছু বছরে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত একটা সরকারি হেলথ ইন্স্যুরেন্স প্রকল্প। এই প্রকল্পের পারফরম্যান্স অডিট করার সময় ক্যাগ নজরে এনেছে যে এর ট্রান্সঅ্যাকশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে আগেই যাদের মৃত হিসাবে দেখানো হয়েছিল, তারা নিয়মিত এই প্রকল্পের আওতায় চিকিৎসা পেয়ে এসেছে। এবং এমন ক্লেইমের সংখ্যা ৩,৯০৩টা, যা কিনা মোট ৩,৪৪৬টা পরিবারের। এই রিপোর্ট অনুযায়ী এই মৃত রোগীর সংখ্যা কেরালাতে সবচেয়ে বেশি, ৯৬৬ জন। এরজন্য সেখানে ব্যয় হয়েছে ২.৬০ কোটি টাকা। এরপর রয়েছে মধ্যপ্রদেশ। সেখানে এমন পরিবারের সংখ্যা ৪০৩। সেখানে খরচ দেখানো হয়েছে ১.১২ কোটি টাকা। এরপর রয়েছে ছত্তিসগড়। সেখানে সংখ্যাগুলো যথাক্রমে ৩৬৫টা ও ৩৩.৭০ লক্ষ টাকা।
ক্যাগের মত অনুযায়ী তারা ২০২০ সালেই ন্যাশনাল হেল্থ অথরিটিকে মৃত রোগী রেজিস্ট্রেশনের বিষয়টা জানিয়েছিল। এনএইচএ বা ন্যাশনাল হেল্থ অথরিটি ক্যাগের এই বক্তব্য মেনে নিয়ে বলেছে যে, ২০২০ সালের ২২ এপ্রিল তারা এই ব্যপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করেছে এবং এটা নিশ্চিত করেছে যাতে মৃত কোন ব্যক্তির আইডি সিস্টেমে অকার্যকর করে দেওয়া হয়। কিন্তু তার পরেও মৃত হিসাবে চিহ্নিত আইডিগুলোয় কিভাবে টাকা ঢুকেছে সেটা নিয়ে ক্যাগ আলাদা করে মন্তব্য করেছে। তারা তাদের রিপোর্টে দেখিয়েছে যে এনএইচএ ২০২২’র আগস্ট মাসে ‘অপারেশনাল রিজন’ দেখিয়ে হাসপাতালে ভর্তির জন্য ব্যাকডেটকে মান্যতা দিয়েছে।
ক্যাগের রিপোর্ট থেকে আরো একটা ভয়ানক তথ্য উঠে এসেছে — কেন্দ্র ২.৩৮ কোটি টাকার তহবিল নিজের নানা উদ্যোগের প্রচারে ব্যয় করে ফেলেছে। এই ২.৩৮ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল নানা পেনশন প্রকল্পের জন্য। ২০১৭ সালে দুই ভাগে, জুন আর আগস্ট মাসে এই খরচ করা হয়েছে। ন্যাশনাল সোশ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স প্রোগ্রামের ২০১৭-১৮ থেকে ২০২০-২১’র পারফরম্যান্স অডিট রিপোর্টে এই তথ্য সামনে এসেছে।
এই ন্যাশনাল সোশ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স প্রোগ্রামের আওতায় রয়েছে তিনটে পেনশন প্রকল্প — একটা বয়স্ক নাগরিকদের জন্য, একটা প্রতিবন্ধীদের জন্য, আর আরেকটা বিধবাদের জন্য। এছাড়াও আরো দুটো প্রকল্প রয়েছে এই প্রোগ্রামের আওতায় — যার একটা বৃদ্ধদের খাদ্যসুরক্ষা প্রদান করার জন্য, আরেকটা যদি কোনো পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যু হয়, সেই পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার জন্য।
ক্যাগের রিপোর্টের বক্তব্য অনুযায়ী, “এই প্রোগ্রামের প্রশাসনিক ব্যয়ের জন্য একটা রাজ্য/কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের জন্য বরাদ্দ ছিল তহবিলের সর্বমোট ৩ শতাংশ অংশ। অডিট করার সময় ন্যাশনাল সোশ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স প্রোগ্রামের তহবিল থেকেও (অর্থাৎ এই ৩ শতাংশের বাইরে) টাকা অন্য খাতে ব্যয় করার উদাহরণ পাওয়া গেছে।”
ক্যাগের পাওয়া তথ্য অনুসারে ২০১৭ সালের জুন মাসে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক নানা পেনশন প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ টাকা থেকে ৩৯.১৫ লক্ষ টাকা ব্যয় করেছে শুধুমাত্র এই মন্ত্রকের নানারকম পাবলিসিটি ক্যাম্পেনের প্রচার বাবদ। একইভাবে ২০১৭’র আগস্টে এই তহবিল থেকে ২.৪৪ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছিল একদিকে ‘গ্রাম সমৃদ্ধি’, ‘স্বচ্ছ ভারত পাখওয়ারা’ প্রভৃতির প্রচারের জন্য, অন্যদিকে এই মন্ত্রকের আরো নানান স্কিম, প্রকল্প ইত্যাদির প্রচারের জন্য ১৯টা রাজ্যের প্রত্যেকটা জেলায় ৫টা করে হোর্ডিং দেওয়ার জন্য।
ক্যাগের এই রিপোর্টে আরো উল্লেখ রয়েছে যে, এই যে এত এত টাকা তহবিল থেকে সরানো হয়েছে শুধুমাত্র বিজ্ঞাপনের জন্য, তার বরাত দেওয়া হয়েছিল ডাইরেক্টরেট অফ অ্যাডভার্টাইজিং অ্যাণ্ড ভিজ্যুয়াল পাব্লিসিটি ‘ডিএভিপি’কে। কিন্তু সেই বরাত বা ওয়ার্ক অর্ডারে ন্যাশনাল সোশ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স প্রোগ্রামের উল্লেখমাত্র ছিল না। শুধুমাত্র উল্লেখ ছিল ‘প্রধানমন্ত্রী গ্রামীণ আবাস যোজনা’ আর ‘দীনদয়াল উপাধ্যায় গ্রামীণ কৌশল্যা যোজনা’র।
এছাড়াও ক্যাগ তাদের রিপোর্টে উল্লেখ করেছে যে, ডিএভিপি’র এই ক্যাম্পেনগুলো মন্ত্রককে বিস্তারিত সব জানিয়ে করার কথা। কিন্তু শেষপর্যন্ত কর্ম সম্পাদন বা ওয়ার্ক এক্সিকিউশনের কনফারমেশন ছাড়াই ডিএভিপি’কে টাকা দেওয়া হয় মন্ত্রকের তরফ থেকে।
অডিটরের প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রক ডিসেম্বর মাসে জানায় যে এই বিষয়টা দেখার জন্য তারা তাদের তথ্য, সম্প্রচার ও শিক্ষা বিভাগকে দায়িত্ব দিয়েছে।
- সুমন্ত নারায়ন, স্কুল শিক্ষক ও আন্দোলনকর্মী