বিজেপি পারেও বটে। বাজপেয়ী আদবানি রামশিলা মানে ইটপূজোর কথা বললেন, তবেই না আমরা রামকে জানলাম! বাপ, চোদ্দ পুরুষের আমল থেকে রামকানাই, রামগোপাল, রামমোহন — এমনতর রামময় নাম তো আমাদের চিরচেনা। তবে ‘রাম জনমভূমি’ নিয়ে বিজেপি যে ধামাকা সৃষ্টি করল, হিংসা ও বিভেদের যে তান্ডব নাচ দেখিয়ে চলল, তাতে আমাদের চিরকালের সাদাসিধে গাঁয়ের রামেরা হারিয়ে গেল। রহিমের কাঁধে হাত দিয়ে চলা সরলমনা রামকে ডান্ডা পিটিয়ে করে দেওয়া হল বিজেপির প্রাইভেট প্রপার্টি।
রামের ঘাড়ে চেপে দিল্লীর গদিতে বেশ পাকাপোক্ত ভাবেই বসেছেন বিজেপির দ্বিতীয় প্রজন্মের শাহেনশা নরেন্দ্র মোদি। রামমন্দির প্রায় তৈরিই হয়ে গেছে। মাস দু-তিনের মধ্যেই, ’২৪ এর ভোটের ঠিক আগে আগে মোদিজি মন্দির উদ্বোধনে এমন জনতরঙ্গ সৃষ্টি করবেন যে তার ঢেউয়ে যেটুকু বিরোধী শক্তি আছে তা খড়কুটোর মতো ভেসে যাবে। তবু মোদিজি নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। একটু রিস্ক ফ্যাক্টর যে থেকেই যাচ্ছে। বিভেদপন্থী, দেশবিরোধী, টুকরে টুকরে গ্যাং সবাই মিলে মহঙ্গাই আর বে-রোজগারি নিয়ে জল কম ঘোলা করছেনা! কোথা থেকে এক “ইন্ডিয়া” বানিয়ে তাঁর সাধের ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’, ‘শাইনিং ইন্ডিয়া’কে প্রায় দিল চৌপট করে। সুতরাং শুধু রামনামে বোধহয় পুরোপুরি কার্যসিদ্ধি হবে না। কিন্তু কোনমতেই তো মোদিজির ব্যাটারি ডাউন হতে দেওয়া চলবেনা। তাঁর ব্যাটারি রিচার্জের জন্য আরএসএস তাই “ভারত” অ্যাপসকে সামনে আনছে।
ভারতকে আমরা এত দিন কেউ জানতাম না! মোদিজিই তো সারা বিশ্বের কাছে ভারতকে চিনিয়ে দিচ্ছেন। জি-২০’র সম্মেলনে দুনিয়ার তাবড় রাষ্ট্রনেতাদের “প্রেসিডেন্ট অফ ভারত” মহাভোজ দিলেন। প্রেসিডেন্ট অব ইন্ডিয়া নয়, ‘প্রেসিডেন্ট অব ভারত’। কারণ ইন্ডিয়া নামটা নাকি ব্রিটিশের দেওয়া। ব্রিটিশের গোলামির চিহ্ন ভারত বইবে কেন? এ কী কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে! যারা কোনোদিন ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেয়নি, উলটে ইংরেজ শাসকদের ‘ভাগ করে শাসন করার’ নীতিকে দুহাত তুলে সমর্থন করেছে তারাই আজ ‘ব্রিটিশের দেওয়া’ ইন্ডিয়া নামকে মুছে ফেলতে চাইছে। তাদের হঠাৎ এই ‘ভারত’ নিয়ে আবেগ সৃষ্টির পিছনে যে ছলনা ও মিথ্যাচার তা ধোপে টিকবে না। জিতেগা ইন্ডিয়া, জোড়েগা ভারত। সাথে সাথে এটাও জানিয়ে দিতে হবে, ইন্ডিয়া নাম ব্রিটিশের দেওয়া নয়।
খ্রিস্টপূর্ব ৩২৬ সালে আলেকজান্ডার যখন সিন্ধু নদ পার হয়ে ভারত (পাঞ্জাব) আক্রমণ করেন তখন গ্রীকরা সিন্ধুকে (সিন্দ) নিজেদের উচ্চারণে ইন্দু(ইন্দাস) বলে আনত। সিন্ধ, হিন্দ, ইন্ডাস, ইন্ড সবই সেই সিন্ধু উপত্যকা বা ইন্দাস ভ্যালির উচ্চারণ যা কালক্রমে আন্তর্জাতিক স্তরে ইন্ডিয়া নামে স্থিত হয়। আরও নির্দিষ্টভাবে বলা চলে, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজত্বকালে গ্রীক পর্যটক তথা লেখক মেগাস্থিনিস মগধ তথা উত্তর ভারত ভ্রমণের পর “ইন্ডিকা” নামক যে গ্রন্থ লেখেন (২৯০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ) তা থেকেই ইন্ডিয়া নামের প্রচলন।
ব্রিটিশ বিরোধী আমাদের গৌরবময় স্বাধীনতা সংগ্রামকে গোটা দুনিয়া ‘ফ্রিডম স্ট্রাগল অফ ইন্ডিয়া’ বলে স্যালুট করে। আমরা গর্বভরে বলি, ‘ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম।’ মোদি সাহেব, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে আপনাদের কোনো অবদান ছিল না। আপনারা ‘ভারত’ নিয়ে এতদিন মাথা ঘামাননি। জোর করে কিছু একটা চাপিয়ে দেওয়ার স্বভাব আপনাদের মজ্জায় মজ্জায়। মাঝে “হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান” বলে হৈ চৈ করলেন। সে শ্লোগানও মাঠে মারা গেল। এখন ‘ইন্ডিয়া’ জোটের ধাক্কায় বেসামাল হয়ে ভারত, ভারত বলে চিৎকার করছেন। ভারতবর্ষের প্রতি ভালোবাসা বা আবেগ থেকে দেশের নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব এলে মানুষ নিশ্চয় ভেবে দেখত। সংসদে আপনাদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। সংসদের অধিবেশন ডেকে, দেশের নাম বদলে দিয়ে ‘ভারত’ নামের আপনারা ব্র্যান্ড অ্যামবাসাডর হয়ে যাবেন? এত সহজ? দেশের নাম ইন্ডিয়া থাকবে, না ভারত হবে – এটা কোনো বিতর্কের বিষয়ই নয়। সংবিধানে বলা আছে, “ইন্ডিয়া, দ্যাট ইজ ভারত”। নাম পরিবর্তনের জন্য দেশবাসীর হৃদয় থেকে কোনো আকাঙ্খা উৎসারিত হয়নি। মানুষ সরকারের কাছে খাদ্য-বস্ত্র-আবাসন-শিক্ষা-স্বাস্থ্যের পর্যাপ্ত সুযোগ সহ মর্যাদাপূর্ণ জীবন চায়। এসবের গ্যারান্টি না দিতে পেরে এখন দেশভক্তির এমন সস্তা নাটকের আশ্রয় নিচ্ছেন? আর দেশের নাম পরিবর্তনের যদি একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়ে, তাহলে তা প্রশাসনিক ক্ষমতার জোরে চাপিয়ে দেওয়া যাবেনা। দেশবাসীর সমস্ত অংশের সাথে পর্যাপ্ত আলোচনা, মত বিনিময়ের গণতান্ত্রিক পদ্ধতির মধ্য দিয়েই এমন এক সংবেদনশীল প্রশ্নের ফয়সালা হতে পারে। ক্ষমতার দম্ভ দিয়ে দেশপ্রেমের মালিক হওয়া যায় কি? যাবে না।
- মুকুল কুমার