প্রতিবেদন
মোদীর ভারতে ৭৪ শতাংশ মানুষ অপুষ্টির শিকার
people-are-malnourished

অর্থনৈতিকভাবে দ্রুততম বিকাশশীল দেশের শিরোপা ও এই অর্থবর্ষের প্রথম ত্রৈমাসিকে ৭.৮ শতাংশ হারে জিডিপি বৃদ্ধির উচ্ছ্বাসে যখন মোদীর ভক্তকুল আকুল, ঠিক তখনই রাষ্ট্রপুঞ্জের একটি সংস্থা কর্তৃক প্রকাশিত রিপোর্ট এই বিজ্ঞাপনের গালে সজোরে চপেটাঘাত করল।

স্টেট অফ ফুড সিকুউরিটি অ্যান্ড নিউট্রিশন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড (এসওএফআই), ২০২৩, গত মাসে এক রিপোর্ট প্রকাশ করে জানিয়েছে, গত কয়েক বছরে ভারতে পুষ্টিকর খাদ্যের দাম বাড়লেও ব্রিকস্ দেশগুলোর মধ্যে (এমনকি নতুন যে ৬টি দেশ যুক্ত হয়েছে) এবং প্রতিবেশি দেশগুলোর তুলনায় আমাদের দেশে তা বেশ খানিকটা কম। কিন্তু তা সত্ত্বেও, ৭৪ শতাংশ ভারতীয় এই পুষ্টিকর খাদ্য কিনতে পারেনা দুর্বল ক্রয় ক্ষমতার জন্য। উল্লিখিত দেশগুলোর মধ্যে ভারতের স্থান সবার নীচে — অর্থাৎ, দেশের ৭৪ শতাংশই মানুষই অপুষ্টির শিকার।

মুম্বাইকে একটা উদাহরণ হিসাবে বেছে নিয়ে দেখানো হয়েছে যে গত পাঁচ বছরে খাদ্যদ্রব্যের দাম ওই রাজ্যে ৬৫ শতাংশ বাড়লেও বেতন বা মজুরি বেড়েছে মাত্র ২৮ থেকে ৩৭ শতাংশ! মুম্বাইকে এজন্য তারা বেছে নিয়েছেন, কারণ ওই সংস্থার মতে সেখানে পরিসংখ্যান পাওয়ার এক ধারাবাহিক রেওয়াজ রয়েছে।

যথারীতি, মোদী সরকার এসওএফআই’র এই রিপোর্ট ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে খারিজ করে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার উক্ত সংস্থার সমীক্ষার পদ্ধতি, উদ্দেশ্য এবং তাদের যোগ্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছে। এই সংস্থাটি বিশ্বজুড়েই সমীক্ষা চালিয়েছে নির্দিষ্ট সূচককে ধরে। তিন বছরের গড় ধরে এই সমীক্ষা তারা চালায়। সেই অনুযায়ী, ২০২০-২২-এ ভারতে ছিল ২৩ কোটি ৩৯ লক্ষ মানুষ যারা অপুষ্টিতে ভুগছেন, আর এশিয়ার মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছেন এই ভারতবর্ষে। ভারতে বেড়ে চলা অসাম্যের জন্যই বাড়ছে এই অপুষ্টি, উল্লিখিত সংস্থার এই পর্যবেক্ষণ ভারত সরকার খারিজ করে দিয়েছে। এদিকে, শেষবারের মতো তৈরি করা মাথাপিছু ভোগ বা কনসামশন এবং ব্যয় সংক্রান্ত সমীক্ষাটি কেন্দ্রীয় সরকার এখনও প্রকাশ করল না। কোন যুক্তির ভিত্তিতে, বা কোন ভিন্ন একগুচ্ছ সূচকের উপর কেন্দ্রীয় সরকার নিজেদের দাবি প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে তার কোনো উল্লেখ নেই।

74-percent-of-people-are-malnourished

২০১৯-২০২১’র মধ্যে অপুষ্টিতে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিল এশিয় মহাদেশে, আর তারপরই ছিল আফ্রিকা — পুষ্টিকর খাদ্য কেনার সামর্থ যাদের ছিল না। এই দুই মহাদেশের সম্মিলিত যোগফল বৈশ্বিক অপুষ্টির হার বৃদ্ধি করেছে ৯২ শতাংশ! এশিয়া মহাদেশের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়াতেই জনসংখ্যা সবচেয়ে বেশি (১০০ কোটি ৪০ লক্ষ), যাদের মধ্যে ৭২ শতাংশ মানুষের পুষ্টিকর খাবার কেনার সামর্থ নেই। আফ্রিকা মহাদেশের মধ্যে পূর্ব ও পশ্চিম আফ্রিকায় রয়েছে সবচেয়ে বেশি মানুষের বসবাস (৭১ কোটি ২০ লক্ষ) আর তার মধ্যে ৮৫ শতাংশ মানুষ পুষ্টিকর খাবার কিনতে পারেন না।

আন্তর্জাতিক এই সমীক্ষা জানাচ্ছে, ২০১৯’র পর নতুন করে আরও ১২ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ ক্ষুধার কবলে পড়েছেন, যার পেছনে রয়েছে বহুমাত্রিক সংকট। সমীক্ষা আরও জানিয়েছে, ২০১৯-এ ক্ষুধার কবলে ছিল ৬১ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ, যা বর্তমানে বেড়ে হয়েছে ৭৩ কোটি ৫০ লক্ষ!

এই সমীক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ হল, খাদ্য নিরাপত্তা এখন আর শুধু গ্রামীণ সমস্যা নয়। এই সমস্যা এখন গ্রাম শহর নির্বিশেষে ছড়িয়ে পড়েছে। মহিলারা তুলনামূলকভাবে বেশি সংখ্যায় অপুষ্টি ও ক্ষুধার কবলে পড়েছেন। বর্তমানে, ২০০ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ, গ্রামীণ মহিলা সহ ২০২২ সালে খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টিকর খাবার ও পর্যাপ্ত খাদ্য থেকে বঞ্চিত।

দেখা যাচ্ছে, উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপ বাদে বিশ্বজুড়ে অধিকাংশ মানুষই পুষ্টিকর খাবার কিনে খেতে পারেন না। দক্ষিণ এশিয়া, পূর্ব ও উত্তর আফ্রিকায় খাদ্যপণ্যের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধির কারণে পুষ্টিকর খাদ্য কেনাকাটা ক্রমেই সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। এরফলে বাড়ছে অপুষ্টি, বয়সের তুলনায় শারীরিক উচ্চতা ও ওজন বাড়ছে না, সদ্যজাত শিশুদের ওজন খুবই কম হচ্ছে।

বৈশ্বিক অসাম্য আজ এক রূঢ় বাস্তব। আমাদের দেশেও এই ফারাক প্রবল বেগে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মুষ্ঠিমেয় সুবিধাভোগীরা কুক্ষিগত করেছে দেশের বিপুল সম্পদ, আর জনসাধারণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ক্রমেই দারিদ্র, দুর্দশা অপুষ্টি, অনাহারে তলিয়ে যাচ্ছে।

- অতনু চক্রবর্তী

খণ্ড-30
সংখ্যা-31