টিভি’তে তখন সবার চোখ। আবেগে, আনন্দে, উত্তেজনায় সবাই থরথর। চন্দ্রযান-৩’র সফল অবতরণ ঘটছে চন্দ্রপৃষ্ঠে!
আরেকটা খবরও তখন টিভির পর্দায় সরে সরে যাচ্ছিল। মালদা’র ২৩ জন পরিযায়ী শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু — ভিনরাজ্যের কর্মস্থলে।
দু’দিন ধরে কফিনবন্দি দেহগুলো পৌঁছালো। কফিন থেকে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে। রাষ্ট্রের কাছে তারা শুধু ‘লাশ’। গরিবের ‘লাশের’ আবার মর্যাদা! আইজল হাসপাতালের মর্গ থেকে বিনা রাসায়নিকে সেই দেহ যখন ৩৬ ঘণ্টার দীর্ঘ রাস্তা উজিয়ে মালদা মেডিকেল কলেজে পৌঁছালো শনাক্তকরণের জন্য, তখন দুর্গন্ধে টেঁকা যাচ্ছে না। তরতাজা যে সন্তানদের হয়তো অনেক আশা নিয়ে ভিনরাজ্যের পথে বিদায় জানিয়েছিলেন, অন্তিম বিদায়ের ক্ষণে সেই প্রিয়তম সন্তানদের প্রাণভরে শেষ আদর করার সুযোগ কি পেলেন হতভাগ্য বাবা-মা!
মালদা’র রতুয়া-২ ব্লকের পুখুরিয়া চৌদুয়ার (১৫ জন মৃত), গাজোল (১ জন মৃত), ইংলিশবাজারের সাট্টারি (৫ জন মৃত), কালিয়াচক (১ জন মৃত) থেকে ওরা মিজোরামে গিয়েছিল কাজে। ১৮ থেকে ৩৫’র এই কিশোর ও যুবকরা সকলেই দরিদ্র পরিবারের। উচ্চমাধ্যমিকের মেধাবী পড়ুয়াও ছিল। সংসারের প্রয়োজনে পড়া ছেড়ে কাজে যোগ দিতে হয়েছে। কেউ সদ্যবিবাহিত। ২৩ জনেরই মৃত্যু হয়েছে ২৩ আগস্ট মিজোরামের সাইরাং’এ একটি রেলসেতু তৈরির সময় এক ভয়াবহ দুর্ঘটনায়। ২২টি দেহ ফিরেছে, কিন্তু সেনাউল হকের মৃতদেহ এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। ভৈরবী- সাইরাং নিউ রেলওয়ে লাইন প্রজেক্টের ১৩০টি রেলসেতুর মধ্যে অন্যতম এই ব্রিজটি প্রায় দু’বছর ধরে তৈরি হচ্ছিল। দায়িত্বে আছে ‘ব্রেথওয়েট বার্ন অ্যান্ড জেশপ কনস্ট্রাকশন কোম্পানি’। বাংলার দুই ইঞ্জিনিয়ার সহ আহত আরও তিনজন হাসপাতালে। নিখোঁজ আছেন কয়েকজন। কেন এই দুর্ঘটনা, তার উচ্চপর্যায়ের তদন্তের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। সাট্টারির সারথি সরকারের বুকভাঙা কান্না — পরিবারে পুরুষ বলতে আর কেউ নেই! স্বামী, ছেলে, জামাই, নাতি কেউ বেঁচে নেই। সেই কান্না কি প্রশাসনকে এতটুকু নড়াতে পারব?
ঐ দুর্ঘটনার পরের দিনের খবর — মুর্শিদাবাদের বড়েঞা-কল্যাণপুরের বাসিন্দা নজরুল মল্লিক মুম্বইয়ের এক বহুতল নির্মাণের কাজের সময় চারতলা থেকে পড়ে মারা গেছেন। এখানেই শেষ নয়। মুর্শিদাবাদের ধুলিয়ানের গোকুল মণ্ডল, শুভঙ্কর রায় এবং ফরাক্কার ইস্রাইল শেখ দিল্লীর এক বাড়ির প্লাস্টারিং’এর কাজের সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান। গতকালের খবর — পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে চেন্নাই’তে সোনার কাজে যাওয়া ১৩টি শিশুকে চাইল্ডলাইন ও চেন্নাই পুলিশ উদ্ধার করে মেদিনীপুরে ফিরিয়ে এনেছে।
মালদা’র আরেক পরিযায়ী শ্রমিক ছোট্টু খান অসমের জোড়হাটে টাওয়ার থেকে পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন। প্রতিদিন দীর্ঘ হচ্ছে এই তালিকা।
পশ্চিমবঙ্গ থেকে কত শ্রমজীবী মানুষ ভিনদেশে, ভিনরাজ্যে কাজের জন্য যান, তার একটা উদ্বেগজনক ছবি ধরা পড়েছিল কোভিডের সময়, আর তখনই ধরা পড়েছে ‘পরিযায়ী’ শব্দের সঙ্গে কতটা বিপন্নতা, অনিশ্চয়তা আর বিপদ জড়িয়ে আছে। তবুও কেন লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবী মানুষকে বছরভর ভিনরাজ্যে পাড়ি দিতে হয় পেটের তাগিদে? কেন চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে মর্মান্তিক ভাবে প্রাণ হারাতে হয় কর্মস্থলে? রাজ্য সরকার এ’ব্যাপারে কতটুকু ওয়াকিবহাল? পরিযায়ীদের নিরাপত্তার জন্য কী তার পদক্ষেপ? এ’প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে সেই ভয়ঙ্কর ঘটনাটিতে আসব, যেখানে অন্য বহুকিছুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে সেই পরিযানের করুণ আলেখ্য।
গত রবিবার সকাল দশটা নাগাদ দত্তপুকুর থানার মোচপোল গ্রামে ঘটেছে এক ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা — এক বেআইনি বাজি কারখানায়। মারা গিয়েছেন এ’পর্যন্ত ৯ জন। আহত বহু। নিহতদের মধ্যে ৩ জন স্থানীয়, বাকি ৬ জন মুর্শিদাবাদের সূতী থানার বাসিন্দা। মৃতদের মধ্যে এক মহিলা সহ একাধিক নাবালক আছে।
বিস্ফোরণের অভিঘাত এতটাই বেশি যে প্রায় দুশো মিটার দূরের এক পুকুরে মৃতদেহ ছিটকে গিয়ে পড়েছে। কাটা আঙুল উড়ে গিয়ে পড়েছে দেড়শো মিটার দূরের এক বাড়ির উঠোনে। বিস্ফোরণ ঘটেছে যে বাড়িতে তার ছাদ দু’তিনটি বাড়ি টপকে ৫০ ফুট দূরে উড়ে গিয়ে পড়েছে অন্য এক বাড়ির ওপর। ধ্বংসস্তুপ দেখলে মনে হয় যুদ্ধবিধ্বস্ত এক ক্ষেত্র, যেখান থেকে এখনও দেহাবশেষ মিলছে।
সেখানে পরিত্যক্ত ইটভাঁটায় মিলেছে ল্যাবরেটরি, যেখানে বিস্ফোরক সহ রয়েছে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি। রয়েছে মজুত বিস্ফোরকের অবিশ্বাস্য বিশাল ভাণ্ডার। বাঁশবাগানের নিরালায় প্লাস্টিক ছাউনির নিচে অনেক ছোট ছোট কারখানা যেখানে কাজ করতেন মহিলা, নাবালক ও শিশুসহ প্রায় ১০০ জন। দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকা। অভাবী স্থানীয় মহিলারা অনেকেই সন্তানসহ কাজ করতেন বিপদ জেনেও।
বিস্ফোরণের অভিঘাত, ল্যাবরেটরিসহ বিস্ফোরকের মজুত ভাণ্ডার, উচ্চ অভিঘাতের বিস্ফোরকের উপস্থিতি — এসব দেখে বিরোধী রাজনৈতিক দলসহ স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ — ঐ কারখানায় সবুজ বাজি দূরে থাক, শব্দবাজির সঙ্গে সম্ভবত বোমাও তৈরি হত। এবং সেটা হত শাসকদলের স্থানীয় নেতৃত্ব ও স্থানীয় প্রশাসনের জ্ঞাতসারে। শুধু তাই নয়, প্রত্যক্ষ মদতে। না হলে এই জনবহুল এলাকায় এতটা বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে, লাইসেন্স ছাড়া, অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা সহ ন্যূনতম নিরাপত্তাবিধির তোয়াক্কা না রেখে কী করে রমরমিয়ে চলছিল এই কারবার? এই প্রশ্ন স্থানীয়দের। এমনকি, তারা এই অভিযোগও করেছেন, প্রতিবাদ জানাতে গেলে প্রশাসন মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়েছে। শুধু তাই নয়, এক যুবক ও এক ইমাম স্থানীয় মহিলাদের বিপজ্জনক বাজি কারখানার সংশ্রব ছাড়তে বলায় কারবারিরা সামাজিকভাবে তাদের অপদস্থও করে।
এই মৃত্যমিছিল আর ধ্বংসলীলা প্রমাণ করে, মাত্র কয়েক মাস আগের এগরার ঘটনা থেকে সরকার ও তার পুলিশ প্রশাসন কোনো শিক্ষাই নেয়নি। যদিও তারপর ভুল স্বীকার, মার্জনা চাওয়া ও বহু প্রতিশ্রুতিও ছিল। তৃণমূল সুপ্রিমো বাজি তৈরিকে ‘কুটির শিল্প’ অভিহিত করে ‘সবুজ বাজির ক্লাস্টার’ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তা কথার কথাই থেকেছে। রাজ্যে এখনও পর্যন্ত একটিও সবুজ বাজির কারখানা নেই।
একটু পিছিয়ে ভাবা যাক। ‘মৌর্যবংশ ধ্বংস করার’ মতো তারও প্রতিজ্ঞা ছিল সাড়ে তিন দশকের একটি শাসনের মহীরুহকে উপড়ে ফেলা। যথেষ্ট পরিশ্রম অধ্যবসায় কৌশলে সেটা সম্পন্ন করার পর রাজ্যে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার ব্যাপারে কার্যত তিনি দিশাহারা এবং তৃতীয় মেয়াদে এসে সম্পূর্ণ হালছাড়া। তৃণমূল সরকারের জনমোহিনী প্রকল্পের প্রসাধন চর্চিত আপাত মানবিক মুখ বিকৃত হয়ে যাচ্ছে দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের কালিমায়। আক্ষরিক অর্থে জনজোয়ারে ভাসতে ভাসতে যেদিন প্রশাসনিক প্রধানের দায়িত্ব নিয়েছিলেন সেদিন কি তার মনে কোনো সুদূরপ্রসারী স্বপ্ন ও পরিকল্পনা ছিল না! তাহলে মানুষের গণতান্ত্রিক চেতনার ওপর ভরসা না রেখে, সন্ত্রাসকেই কেন ভরসা করলেন ক্ষমতা দখলের জন্য? ক্ষমতায় টিঁকে থাকার জন্য কেন দুর্নীতিকে আশ্রয় করলেন? আজ তিনি রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী হয়ে নিচুতলার পুলিশকে দুষছেন, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছেন এবং কার্যত নিজের দপ্তরের প্রশাসনিক অপদার্থতাকে স্বীকার করে নিলেন। কিন্তু এই পুলিশের দুর্নীতিগ্রস্ত, অকর্মণ্য তথা দলদাসে পরিণত হওয়ার ব্যাপারে নিজের তথা দলের ভূমিকাকে অস্বীকার করবেন কীভাবে? দলের নিচুতলার পুরোপুরি দুর্নীতি সন্ত্রাসে ডুবে থাকার প্রতি তিনি ‘ধৃতরাষ্ট্র’ হয়ে থাকলেও রাজ্যবাসী তো দৃষ্টি হারায়নি! আর এ’ভাবেই তিনি বাংলার এই ‘দুর্জয় ঘাঁটি’কে একটা ফ্যাসিস্ট দলের লুঠ ও আগ্রাসনের জন্য উন্মুক্ত করে দিচ্ছেন যারা গোটা দেশটাকেই কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য গণতন্ত্র হত্যার সার্বিক আয়োজন করে ফেলেছে!
রাজ্যের সার্বিক উন্নয়নের ব্যাপারে প্রথম থেকেই এই সরকার উদাসীন। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে পঞ্চায়েতকে সুষ্ঠুভাবে সামিল করে জনগণের সহযোগিতায়, কৃষি, কুটির শিল্প, কৃষিজাত পণ্যের প্রক্রিয়ণ, মৎস্য, পশুপালন, রেশম শিল্প, তাঁত শিল্প ইত্যাদির উন্নয়নের ব্যাপারে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে তার ধারাবাহিক রূপায়ণের মধ্য দিয়ে গ্রামীণ অর্থনীতির পুনরুজ্জীবনের কোনো লক্ষ্য ছিল না। একশো দিনের কাজসহ অন্যান্য গ্রামীণ প্রকল্পগুলির রূপায়ণে শাসকদলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের ‘করে খাওয়ার’ নীতির দরুণ ব্যাপক দুর্নীতির ফলে অনেক ক্ষেত্রে তার সুফল মানুষের কাছে ঠিকমতো পৌঁছাতে পারেনি। তাদের অনৈতিক উপার্জন যত বেড়েছে, সমানতালে বেড়েছে রাজনৈতিক ‘প্রতাপ’। তারসঙ্গে, স্থানীয় কিছু সাধারণ মানুষকেও সামিল করে গড়ে উঠেছে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের একেকটি বলয়। আর সেই বলয়ের ঘেরাটোপেই গড়ে উঠেছে বগটুই; প্রশ্রয় পেয়েছে এগরা, মোচপোল। আর তার করুণ পরিণতি চোখের সামনেই দেখছি! সাধারণ মানুষ এই লুঠ, এই বেনিয়ম এই অনৈতিকতা নিশ্চয়ই মেনে নিতে চাননি। কিন্তু প্রতিবাদ জানাবেন কোথায়? সর্ষের মধ্যেই তো ভূত! জনপ্রতিনিধি, আইনরক্ষক সবাই তো সেই দুর্বৃত্তায়নের ঘেরাটোপে ঢুকে পড়েছেন, প্রতিবাদী মানুষকে নানাভাবে ভয় দেখিয়ে তারা নিরস্ত করছেন। ওদিকে অসদুপায়ে কম সময়ে কম পরিশ্রমে রকেট উত্থানের মূল্য দিয়েছেন, দেবেন জিরাত শেখ, কেরামত আলির মতো মানুষেরা। সন্তানের জীবন কেড়ে, নিজে মরে! আর মুর্শিদাবাদের চাঁদরার মাসুমের মতো কিশোররা, দু’টো বাড়তি আয়ের আশায় নবম শ্রেণির পড়া ছেড়ে বা ঘরে বসে বিড়ি বাঁধা ছেড়ে, জিরাতের মতো আড়কাঠিদের হাত ধরে অজান্তেই পৌঁছে যাবে ভুলভুলাইয়ায়, কিছু জানা বোঝার আগেই কচি শরীরটা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাবে। ২০১৫’র ৬ মে মেদিনীপুরের পিংলায় বাজিকারখানার বিস্ফোরণে যে ১৩টি প্রাণ বলি হয়েছিল তার ১২ জনই ছিলেন চাঁদরা গ্রামের। বেশিরভাগই নাবালক। মাসুমের মা সন্তানকে কোনক্রমে শনাক্ত করে কান্নারও সময় পেলেন না। কারণ মাথায় তখন দুশ্চিন্তা — হাতে ফুটো পয়সা নেই, ঐ দেহ তিনি কীভাবে গ্রামে নিয়ে যাবেন?
বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য কৃষি উৎপাদন ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ঝুঁকি বাড়ছে কিন্তু আয় কমছে। ফলে কৃষির সঙ্গে যুক্ত পরিবারগুলোর অনেক সদস্যই উপার্জনের জন্য শহরমুখী। গ্রামীণ শিল্পগুলো উপযুক্ত উপকরণের অভাবে, উৎপাদন ব্যয়ের সংস্থান না থাকায়, বিপণনের উপযুক্ত ব্যবস্থার অভাবে ধুঁকছে। গ্রামীণ শিল্পী বা বৃত্তিজীবীরা আজ পেটের তাগিদে বংশপরম্পরার শিল্প, পেশা বা বৃত্তি ছেড়ে শহরমুখী। কিন্তু শহরে কাজ কোথায়? বস্ত্র, চট, ইঞ্জিনীয়ারিং কারখানাগুলোয় তালা পড়েছে। নতুন কারখানা গড়ে ওঠেনি। ফলে শহরের মানুষই আজ কর্মহীন। তাই কয়েক দশক ধরেই দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে, মহারাষ্ট্রে, কাশ্মীরে পশ্চিমবঙ্গ থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষের স্রোত অব্যাহত। কাশ্মীরে জঙ্গিহানার দরুণ এখন মানুষ যাচ্ছেন উত্তর পূর্বাঞ্চলে। কিন্তু তার সঙ্গে মৃত্যুমিছিলও অব্যাহত। কেন?
চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যেই কাজ করতে হয় বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকদের। কখনও তারা বিদ্বেষের শিকার হন, যেমন মাত্র কিছুদিন আগে আমরা হরিয়ানার নুহ’তে দেখেছি কীভাবে তাদের সন্ত্রস্ত করে আশ্রয়চ্যুত করা হল। হেনস্থা করা হল। ২০১৭-তে রাজস্থানে আফরাজুলকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। কখনও তারা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার হন। যেমন ২০২১-এ কেরলের বন্যায়। কখনও তারা ঠিকাদারের চুক্তিভঙ্গের বা মালিকের উৎপীড়নের শিকার হন। উপযুক্ত পরিচয়পত্র না থাকায় ঘর ভাড়া পেতেও অসুবিধা হয়। ফলে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর ও ঠিকানাবিহীন ঝুগগি ঝোপড়িতে মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজতে হয়। এজন্য অনেক সময়েই তারা সরকারি বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন। সরকারিভাবে নাম নথিভুক্ত না থাকায় দুর্ঘটনা বা মালিকের অন্যায়ের শিকার হলেও দ্রুত জানানোর উপায় থাকে না। তাদের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে মালিক ন্যূনতম নিরাপত্তাবিধিটুকুও লঙ্ঘনের সাহস পায় যে কারণে দুর্ঘটনা এত বেড়ে গেছে।
ভারতে আন্তঃরাজ্য পরিযায়ী শ্রমিক আইন (১৯৭৯) চালু আছে। কিন্তু কোন রাজ্য সরকারই তার শর্তগুলো পালন করেনি। পরিযায়ী শ্রমিক বা ঠিকাদার — কারোরই নথিভুক্তির সঠিক তথ্য ভাণ্ডার তৈরি করা হয়নি। ২০২০-২১এ এক জনস্বার্থ মামলায় সুপ্রিম কোর্ট সব রাজ্যকে পরিযায়ী শ্রমিকের নিরাপত্তার জন্য কী পদক্ষেপ নিয়েছে সেই মর্মে এক হলফনামা জমা দিতে বলে।
অন্ধকারে ক্ষীণ আলোর রেখার মতো একটা ভরসা তৈরি করেছে রাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিক সুরক্ষা বোর্ড। ভারতে প্রথম। বোর্ডের তরফে কয়েকটি আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। যথা, একটি তথ্যভাণ্ডার গড়া হবে; ২৪ ঘণ্টার সহায়তা কেন্দ্র খোলা হবে; কেরল, দিল্লী, মহারাষ্ট্রে আঞ্চলিক অফিস খোলা হবে; দুর্ঘটনার শিকার হয়ে কর্মক্ষমতা হারালে ৫০ হাজার থেকে ১ লক্ষ টাকা সাহায্য করা হবে। মৃত্যুর ক্ষেত্রে ২ লক্ষ টাকা।
এই বোর্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজ্যসভার সাংসদ অধ্যাপক সামিরুল ইসলাম মালদা’র নিহত শ্রমিকদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের হাতে রাজ্যসরকারের তরফে সাহায্য তুলে দেন। তিনি জানিয়েছেন পরিযায়ী শ্রমিকদের সম্পর্কে তথ্য ভাণ্ডারের পরিকাঠামো গড়ে তোলা হচ্ছে। তিনি আরও জানান, পরিযায়ী শ্রমিকদের সুরক্ষা ও বিমার জন্য রাজ্য সরকার ‘কর্মসাথী পরিযায়ী শ্রমিক পোর্টাল ও অ্যাপ’ চালু করেছে। সরকারি প্রকল্পে পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য ৫ লক্ষ টাকা ঋণেরও ব্যবস্থা করা হচ্ছে যার জন্য ‘দুয়ারে সরকার’ শিবির থেকেই তারা আবেদন করতে পারবেন।
আমরা পরিযায়ী শ্রমিকদের চিকিৎসা, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, নিরাপদ মাতৃত্ব, সন্তানের শিক্ষা, সামাজিক সুরক্ষা যা প্রতিটি নাগরিকের প্রাপ্য তারজন্য সরকারের যথাযথ উদ্যোগ দাবি করছি! সেই সঙ্গে এইসব মর্মান্তিক দুর্ঘটনার যথাযথ তদন্ত, দ্রুত আর্থিক ক্ষতিপূরণ ও পরিবারগুলির আর্থিক পুনর্বাসন দাবি করছি!
- জয়ন্তী দাশগুপ্ত