গত কয়েকমাস যাবৎ পশ্চিমবঙ্গের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর কর্তৃত্ব নিয়ে রাজ্যপালের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যে লড়াই চলছে তাতে ওই পুরোনো সনাতনী প্রবাদ ‘ভাগের মা গঙ্গা পায় না’ মনে পড়ছে, অবশ্য এক্ষেত্রে ভাগের মা, উচ্চশিক্ষা, গঙ্গাযাত্রা করেছে। সারা দেশজুড়েই বিজেপি তাদের রাজ্যপাল দিয়ে অবিজেপি রাজ্য সরকারের কাজে নাক গলাচ্ছে, সে কেরালা, তামিলনাড়ু, পশ্চিমবঙ্গ যেখানেই হোক না কেন। দিল্লীতে নির্বাচিত সরকারকে মোটামুটি মিউনিসিপ্যালিটির নিম্নস্তরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কেরলে আরিফ খান, তামিলনাড়ুতে সি টি রবি রাজ্য সরকারের বিধানসভায় পাশ করা কোনো বিলেই অনুমোদন দিচ্ছেন না, পশ্চিমবঙ্গেও পূর্বে ধনখড় ও পরে আনন্দ বোস মহাশয় একই রাস্তায় হাঁটছেন।
অন্য রাজ্যের রাজ্য সরকারগুলির তুলনায় এ’রাজ্যের সরকারের সমস্যা কিছুটা ভিন্নতর। সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়গুলি পরিচালিত হয় নির্বাচিত কোর্ট-কাউন্সিল, সেনেট-সিন্ডিকেট দ্বারা। সামগ্রিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান হন উপাচার্য মহাশয়। এরাজ্যের রাজ্য সরকারের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য হন রাজ্যপাল। রাজ্য সরকার সেই আইন পাল্টে মুখ্যমন্ত্রীকে আচার্য হিসেবে নিযুক্ত করতে চাইছেন। কিন্তু পূর্বতন ও বর্তমান রাজ্যপাল তাতে স্বাক্ষর করেননি।
আইনমাফিক গঠিত সার্চ কমিটির মাধ্যমে ও সুপারিশক্রমে আচার্য উপাচার্যকে নিযুক্ত করেন। সার্চ কমিটিতে আচার্যর একজন প্রতিনিধি থাকতেন, একজন ইউজিসি’র প্রতিনিধি থাকতেন, একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি থাকতেন। পরবর্তীতে বর্তমান রাজ্য সরকার ইউজিসি’র প্রতিনিধিকে বাদ দিয়ে রাজ্য সরকারের প্রতিনিধি রাখার বন্দোবস্ত করেন। আদালতের রায়ের ফলে ইউজিসি’র প্রতিনিধিকে রাখা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে। রাজ্য সরকারের পছন্দমাফিক উপাচার্য নিয়োগও বাঁধাপ্রাপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়, কারণ ইউজিসি এবং আচার্যের প্রতিনিধি প্রকারান্তরে বিজেপির নিয়ন্ত্রণে থাকবেন। এমতাবস্থায় রাজ্য সরকার অর্ডিনান্স জারি করে উপাচার্য নিয়োগের জন্য সার্চ কমিটিকে ৫ সদস্যে রূপান্তরিত করে, আচার্যের, ইউজিসি’র, রাজ্য উচ্চশিক্ষা দফতর, রাজ্য উচ্চশিক্ষা পর্ষদ এবং মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিনিধি। পরবর্তীতে অর্ডিনান্সের বদলে আইন পেশ করা হয়। ওই আইন বলবত হলে ৫ সদস্যের মধ্যে ৩ জন রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগে রাজ্য সরকারের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ হবে। কিন্তু এক্ষেত্রেও সেই বিলে রাজ্যপাল সই করেননি। ফলে সার্চ কমিটি গঠন ও উপাচার্য নিয়োগ বিশ বাঁও জলে। ওদিকে রাজ্য সরকার যে অস্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ করেছিল, আচার্যের সম্মতি বা নিয়োগ ব্যতিরেকেই, সেগুলি বেআইনি বলে আদালত রায় দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলি চলছিল উপাচার্য ছাড়াই। প্রথমে আচার্যই উপাচার্য নিয়োগ করবেন রাজ্য সরকারের সাঙ্গে পরামর্শ করে এমনটা ঠিক হয়েছিল। রাজ্যপালের সঙ্গে ভাবভালোবাসা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু বিজেপির রাজ্যপাল তাদের দলের কথা না শুনে অন্য কারুর কথায় চলবেন এমনটা ভাবা অন্যায়। তাছাড়া বয়স হলেও তো রাজ্যপালের একটা ভবিষ্যত আছে। তাই রাজ্যপাল রাজ্য সরকারের শিক্ষা দফতরের দেওয়া তালিকাকে পাত্তা না দিয়ে নিজে থেকেই এ্যাক্টিং উপাচার্য নিয়োগ শুরু করে দিয়েছেন। সেইসব উপাচার্য যে বিজেপির লোক হবে তা বলাই বাহুল্য। যারা ছিলেন না তাঁরা পদত্যাগও করেছেন। অপরদিকে যাদবপুর বা বর্ধমানের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে খোদ আরএসএস শিক্ষা সেলের নেতাদের নিযুক্ত করা হয়েছে, তাঁদের উপাচার্য হওয়ার নির্ধারিত যোগ্যতা থাক বা নাই থাক।
ইতিমধ্যে রাজ্যপাল, থুড়ি আচার্য মহাশয় ঘোষণা করেছিলেন যে, তিনিই উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করবেন। অর্থাৎ ওই এক দেশ এক ভাষা এক ধর্ম এক নির্বাচন... ... অনুসরণ করে এক রাজ্য এক আচার্য এক উপাচার্য। তিনিই ছাত্রদের শংসাপত্রে সই করবেন বললেন, এবং ছাত্রদের অভাব অভিযোগ শোনার ও সমাধানের জন্য রাজভবনের দ্বার উন্মুক্ত বলে জানালেন। তার পরেই অবশ্য ধাই ধপাধপ সকাল বিকেল মাঝরাতে গন্ডা গন্ডা উপাচার্য নিযুক্ত করা শুরু হল। প্রাক্তন বিচারপতি, সেনাবাহিনির প্রাক্তন আমলা সমেত আঙুলে কড় গুনে শেষ করা যাবে না এত এত উপাচার্য, সবগুলিই এ্যাক্টিং, নিযুক্ত হয়েছে। এমনকি কারুর কারুর হাতে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জমিদারি ন্যস্ত হয়েছে, পূর্বে যেমন রাজারা সামন্তদের জাগির বা জমিদারি দিতেন তেমনি আর কী। আচার্য বলেছেন পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাকে তিনি উত্তম করেই তুলবেন। বোঝা যাচ্ছে যে, শিক্ষা প্রশাসনে শিক্ষকের প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ আচার্যের মতে, শিক্ষা একটি অত্যন্ত অপেশাদারি বিষয়, যেকোনো পেশা থেকে আসা কর্তারাই শিক্ষা প্রশাসনের দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম।
অপর প্রান্তে রয়েছে তৃণমূল শাসনাধীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার। ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পরে যে দ্রুততার সঙ্গে শিক্ষাক্ষেত্রে অরাজকতা শুরু করা হয়েছিল তার পরিণাম রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্র ভুগেই চলেছে। যারা শুরুতে তাদের সঙ্গে ছিল তাদের অনেকে ঘাসফুলে পানি না পেয়ে পদ্মফুলে গিয়েছেন। যেমন তৎকালীন তৃণমূল ছাত্র পরিষদ নেতা শঙ্কুদেব বা স্কুল সার্ভিস কমিশনের সভাপতি চিত্তরঞ্জন মন্ডল। অস্থায়ী উপাচার্যের রাস্তাটা রাজ্য সরকারই দেখিয়েছে। স্থায়ী উপাচার্যের পদ খালি হলে সেখানে নিজ দলের নিয়ন্ত্রানাধীন ব্যক্তিকে স্থায়ী উপাচার্য হিসেবে নিয়োগের ক্ষেত্রে আচার্যের সঙ্গে দ্বৈরথের সম্ভাবনায় সরকারের শিক্ষা দফতর একতরফাভাবে অস্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ করতে থাকে। আচার্য রাজ্যপাল যেমন উপাচার্য পদের জন্য নিয়মবিধি অনুযায়ী যোগ্য অধ্যাপক খুঁজে (?) না পাওয়ায় একই ব্যক্তিকে দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত করে পদটির গুরুত্বকেই জলাঞ্জলি দিচ্ছেন, তেমনি তৃণমূল সরকারও একই ব্যক্তিকে কলেজের অধ্যক্ষ ও সহ-উপাচার্য করেছিল, একই ব্যক্তিকে অধ্যক্ষ ও উপাচার্য বা উপাচার্য ও স্কুল সার্ভিস কমিশনের সভাপতি, উপাচার্য ও কলেজ সার্ভিস কমিশনের সভাপতি এরকম অভাবনীয় সব কাজ করেছিল। তাঁবেদার অধ্যাপকদেরই উপাচার্য করতে হবে, যারা অনায়াসে জার্সি বদল করতে পারেন এবং জানেন যে রুটির কোন দিকটায় মাখন লাগানো আছে।
ফলে ঝগড়া বেশ পেঁকে উঠেছে। কোনো রীতিনীতি সভ্যতা ভদ্রতার ধার ধারছে না কেউ। মুখ্যমন্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ বন্ধের হুমকি দিচ্ছেন। জানি না রাজ্যপালের হাতে কোনো তহবিল আছে কিনা বিশ্ববিদ্যালয়গুলির জন্য। একথা মনে রাখতে হবে যে, জনগণ যে দলকে নির্বাচিত করেছে তারাই শাসন করে থাকে। মানুষ তার বিরুদ্ধে বলতে পারে, রাস্তায় নামতে পারে। শিক্ষা যৌথ তালিকায় থাকলেও রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি মূলত রাজ্য সরকারি টাকায় চলে। ফলে স্বশাসন থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপরে ঘুরপথে রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকে, যেমন কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপরে থাকে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ। যেহেতু সেই সরকার নিরঙ্কুশ ভাবে ক্ষমতাশালী তাই কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠানগুলিতে বিজেপি আরএসএসের তাঁবেদার নিয়োগ বহাল তবিয়তে চলছে, কোনো সমস্যা নেই। ইউজিসি’তে জেএনইউ’র কুখ্যাত ভিসি জগদীশ কুমার, বিশ্বভারতীতে নিম্নমানের ভিসি বিদ্যুত চক্রবর্তী, আইআইটি মান্ডির ডিরেক্টর লক্ষ্মীনারায়ণ বেহেরা (যিনি মাংস খাওয়াকে হিমাচল প্রদেশের ভয়ঙ্কর বন্যার জন্য দায়ী করেন বা কোনো ফ্ল্যাটে ভুত আছে বিশ্বাস করে ভুত তাড়াতে যান।) নামগুলি স্মরণ করা যেতে পারে। কিন্তু যাই হোক না কেন, বিজেপিকে যখন রাষ্ট্র (জনগণ!) ক্ষমতায় এনেছে তখন এই অপকর্মগুলি সইতে হচ্ছে। ঠিক তেমনই তৃণমূলকে রাজ্যের মানুষ ক্ষমতায় রেখেছেন তাদের শত অপকর্ম সত্ত্বেও। তৃণমূল একইভাবে বিজেপির মত নিজদলের তাঁবেদার খুঁজছে উপাচার্য পদে নিযুক্ত করার জন্য। অপরদিকে রাজ্যে ভোটে পরাস্ত হলেও বিজেপি-আরএসএস তাদের তস্কর মানসিকতার কারণে পিছনের দরজা দিয়ে রাজ্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে, যার প্রতিফলন হরেক কেন্দ্রীয় এজেন্সির অতিসক্রিয় কাজে হচ্ছে, এরাজ্যে ও অন্যত্র। ঠিক এভাবেই উচ্চশিক্ষায় রাজ্যপাল তথা আচার্য একটি কেন্দ্রীয় এজেন্সির ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। এই সমস্যার সমাধান কেবলমাত্র স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ করার বন্দোবস্ত করেই করা যেতে পারে। বলা হচ্ছে সার্চ কমিটি গঠনের প্রস্তাবিত নতুন আইনে রাজ্য সরকারের হাতেই উপাচার্য নিযুক্তি ক্ষমতা থাকছে, এবং সেটা সত্যি। কিন্তু বিকল্প তো মনে হচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে সেই নিয়ন্ত্রণ থাকা যেখানে সার্চ কমিটিতে আচার্য (বিজেপি নিয়োজিত রাজ্যপাল) ও ইউজিসি (কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রিত)র প্রতিনিধিরা সংখ্যাগরিষ্ট হবে। অন্যতর কোনো গণতান্ত্রিক বিকল্প রাজ্য সরকারকেই খুঁজতে হবে। মনে রাখা দরকার আমাদের পছন্দ অপছন্দ যাই থাক না কেন রাজ্য সরকারটি নির্বাচিত সরকার, কিন্তু রাজ্যপাল কেন্দ্রীয় সরকার মনোনীত, তিনি বিজেপি আরএসএসের এজেন্ডা রূপায়িত করতে চাইবেন। একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় নির্বাচিত রাজ্য সরকারের যদিওবা নিজ এজেন্ডা রূপায়িত করার অধিকার থাকে, নির্বাচনে পরাজিত কেন্দ্রীয় শাসক দলের সেটা থাকতে পারে না।
তবে গত কয়েক বছরে শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতির প্রকাশে ও স্বদলপোষণের কারণে রাজ্য সরকার শিক্ষা প্রশাসনে হস্তক্ষেপের নৈতিক বৈধতা হারিয়েছে বললেই চলে। সেই দুর্বলতাকেই রাজ্যপালের মতো বিজেপি আরএসএসের তাঁবেদার কাজে লাগাতে চাইছে। সেই তুই বেড়াল আর মুই বেড়ালের ঝগড়া চলছে। শেষে না পশ্চিমবঙ্গের উচ্চশিক্ষার ল্যাজের ডগাটাই পড়ে থাকে। এই লেখার দিনটিতে (সেপ্টেম্বর ১০) সুকুমার রায় মারা গিয়েছিলেন। তার সেই ছড়াটি দিয়েই শেষ করি।
খিল্খিল্লির মুল্লুকেতে থাকত নাকি দুই বেড়াল,
একটা শুধায় আরেকটাকে, “তুই বেড়াল না মুই বেড়াল?”
তাই থেকে হয় তর্ক শুরু, চিৎকারে তার ভূত পালায়,
আঁচড় কামড় চর্কিবাজি ধাঁই চটাপট চড় চালায়
খাম্চা খাবল ডাইনে বাঁয়ে হুড়মুড়িয়ে হুলোর মতো,
উড়ল রোঁয়া চারদিকেতে রাম্-ধুনুরীর তুলোর মতো
তর্ক যখন শান্ত হল, ক্ষান্ত হল আঁচড় দাগা,
থাকত দুটো আস্ত বেড়াল, রইল দুটো ল্যাজের ডগা।
- অমিত দাশগুপ্ত