ভারতের বিস্তীর্ণ ও বহুবিচিত্র শহরগুলির একটা থেকে অন্যটায় ঘুরে ঘুরে জি-২০র দীর্ঘ এক বছর ধরে চলা কর্মসূচীর সমাপনী সম্পন্ন হল দিল্লিতে গত ৮-১০ সেপ্টেম্বর অষ্টাদশ জি-২০ বৈঠকে। ১৯৮৩ সালের জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের সম্মেলন এবং ২০১০ সালের কমনওয়েলথ গেমসের পর যেহেতু এটাই ছিল ভারতের আতিথেয়তায় সংগঠিত প্রথম একটা এত বড় আন্তর্জাতিক কর্মসূচি, তাই, বলাই বাহুল্য, একে ঘিরে মানুষের আগ্রহ ছিল তুঙ্গে, শুধু ভারতে নয়, আন্তর্জাতিক স্তরেই।
জি-২০ মোটেই বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশগুলির আয়েসী ক্লাব জি৭-এর মতো কোনো গোষ্ঠী নয়। এতে আছে বেশ কয়েকটি বিকাশমান দেশ, অথবা বৈশ্বিক দক্ষিণের কিছু উদীয়মান অর্থনীতি। ৫৫টি আফ্রিকী দেশের এক মহাদেশীয় জোট আফ্রিকী সংঘের অন্তর্ভুক্তির মধ্যে দিয়ে জি-২০ প্রসারিত হয়ে জি-২১ রূপ নেওয়ায় আন্তর্মহাদেশীয় মঞ্চটিতে বৈশ্বিক দক্ষিণের প্রতিনিধিত্ব কার্যত অনেকখানি বাড়ল এই দিল্লি বৈঠকে এসে। ভারত নিজেকে প্রায়শই বৈশ্বিক দক্ষিণের নেতৃত্বকারী কন্ঠস্বর হিসেবে তুলে ধরে। দিল্লি বৈঠক সুতরাং বৈশ্বিক দক্ষিণের মূল মূল সমস্যাগুলিকে সামনে নিয়ে আসবে এমনটাই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সেরকম কোনো ফোকাস দেখা গেল না।
প্রকৃতপক্ষে ভারতের নিজের দারিদ্র লুকাতেই চরম কসরৎ চালালো মোদি সরকার। দিল্লি ও তার আসপাশে এক ব্যাপক গরিব-বিরোধী অভিযান উন্মুক্ত করল এই বৈঠক। সরকার সম্ভবত এটাই বিশ্বাস করে যে শহুরে দরিদ্র ও খেটে খাওয়া মানুষের অস্তিত্বটাই এক চক্ষুপীড়া যাকে যেকোনো আন্তর্জাতিক বৈঠকের সময় বা বিদেশী মেহমানের পরিদর্শনকালে ঢেকে-ঢুকে অদৃশ্য করে রাখা দরকার, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর তার পশ্চিমা সহযোগিদের দৃষ্টি থেকে। কোভিড-১৯ মহামারী ছড়াতে শুরু করার সময় ট্রাম্পের আগমনকালে আহমদাবাদের বস্তিগুলিকে যেভাবে দেয়াল তুলে আড়াল করা হয়েছিল তেমনই এবারও দিল্লির গরিবদের ঠেলে দেওয়া হল লোকচক্ষুর আড়ালে, বেশ কিছু বসতিকে গুঁড়িয়ে দিয়ে, রাস্তার হকারদের তাড়িয়ে দিয়ে এবং রাস্তা বরাবর পর্দার দেওয়াল তুলে। রাস্তার কুকুরদেরও নিষ্ঠুরভাবে তুলে নিয়ে গিয়ে ফেলে দেওয়া হল অনেক দূরের আস্তানায়। গণপরিবহন থামিয়ে দেওয়া হল। এবং শেষ পর্যন্ত গোটা দিল্লিকেই, জি-২০ মিটিঙের সমগ্র সময়টা জুড়ে, একেবারে বন্ধই করে দেওয়া হল।
সাধারণ নাগরিকদের বলপূর্বক অপসারণের পরিপূরক হিসেবে ছিল রাজতান্ত্রিক যুগের জাঁকজমকের দাম্ভিক পুনঃপ্রদর্শন। ভারতীয় পরম্পরার বিলাসী নৈশাহারের নামে সোনা ও রুপার কাজ করা বিশেষ টেবিলঢাকা ডিজাইন করা হয়েছিল জি-২০র অতিথিদের আপ্যায়ন করতে। কিন্তু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সুযোগ দেওয়া হল খুব সামান্যই। সংবাদ সম্মেলন না করার এবং কেবল “মন কি বাত” প্রসব করার স্বভাবসিদ্ধ হীনতা বজায় রেখে শুধুমাত্র একক ভাষণ ও বাছাই করা প্রশ্ন ও পূর্বনির্ধারিত ছকে ইন্টারভিউ দিয়ে নরেন্দ্র মোদি আন্তর্জাতিক এই কর্মসূচিকে একটি একমুখী বার্তায় পর্যবসিত করলেন। এটা হল ভারতকে বিশ্ব দরবারে “দ্য মাদার অব ডেমক্রেসি” হিসেবে তুলে ধরার গল্প। অন্যদিকে, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের বিদেশ দপ্তর থেকে বারংবার আবেদন জানানো সত্ত্বেও লাইভ মিডিয়া ইনটার্যাকশন নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। আর, জি-২০ প্রতিনিধিদের দেখানো হয় নরেন্দ্র মোদির বিকট আত্মপ্রচারণার কিছু কিছু ঝলক, যে প্রচারণা মোদি শাসনের সবচেয়ে প্রকট পরিচিতি হয়ে উঠেছে।
বুঝতে কারো বাকি নেই যে হঠাৎ ঘোষিত বিশেষ সংসদ অধিবেশনের মতোই এই জি-২০ বৈঠকটিও যতটা না অর্থপূর্ণ আন্তর্জাতিক কূটনীতি তার থেকে অনেক বেশি আসন্ন বিধানসভা ও লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে দেশীয় দর্শকের সামনে তুলে ধরা ফানুস বিশেষ। চীন ও রাশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানদের অনুপস্থিতি এই কর্মসূচিকে এমনিতেই অনেকটা ম্লান করে দিয়েছিল, এবং একটি সম্মিলিত যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করা সম্ভব হবে কি না তা নিয়েই প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল। শেষমেস এক ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়। ‘জি২০ নেতৃত্বের ৮৩ পয়েন্ট ঘোষণা’ গৃহীত হয়। এবং তা, যা আশঙ্কা ছিল, সাধারণ কিছু গোলগোল কথাতে ভর্তি।
জি-২০ ঘোষিতভাবেই অর্থনীতিকে ফোকাসে রাখা একটি ফোরাম। বৈশ্বিক দক্ষিণ বর্তমানে যে অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক সমস্যাটির সম্মুখীন তা হল ঋণ সংকট, যে সংকট মহামারীর অর্থনৈতিক ধাক্কায় গভীরতর হয়ে উঠেছে। ভারতের দক্ষিণ দিকের প্রতিবেশি শ্রীলঙ্কা এই ঋণ সংকটের সবচেয়ে ভয়াবহ নজির। অথচ জি-২০র ঘোষণায় কোনো দিশাই দেওয়া হয়নি যাকে ওরা সাধারণত বলে থাকেন “বৈশ্বিক ঋণদৌর্বল্য সামাল দেওয়া” তা করতে। এই গ্রহের অস্তিত্বের সামনে জলবায়ু সংকট আজ ব্যাপক স্বীকৃত এক বিপদ। শক্তিউৎস হিসেবে কয়লার ওপর নির্ভরতা কমানো এবং জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসাটাই এখন মূল চ্যালেঞ্জ। প্রাণ বিনাশি এই বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় কোনোরকম তৎপরতার বোধ বা ন্যূনতম দায়বদ্ধতা এই ঘোষণায় পাওয়া গেল না।
আঠারো মাসের বেশি সময় ধরে ইউক্রেনে যুদ্ধ চালাচ্ছে রাশিয়া। এত বড় একটা ভূরাজনৈতিক সংঘর্ষের কোনো উল্লেখই ঘোষণায় থাকবে না এমন তো হতে পারে না। বালিতে গতবারের জি-২০ বৈঠকে গৃহীত ঘোষণায় ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনকে জোরালো ভাষায় ধিক্কার জানানো হয়েছিল। কিন্তু দিল্লি ঘোষণা এই ধিক্কারকে লঘু করে দিয়ে “ইউক্রেনে যুদ্ধ” সম্পর্কে কেবল এক সাধারণ উদ্বেগ, ভূখণ্ড দখলে বলপ্রয়োগ বিষয়ে সাধারণ অননুমোদন এবং আবছা কিছু শান্তির কথা দিয়ে এক বাক্যের একটি প্যারাগ্রাফ (১৪নং পয়েন্ট) লিখে দেওয়াতেই ঐকমত্য অর্জন করেছে : “আজকের যুগ কোনোভাবেই যুদ্ধের যুগ হতে পারে না”। একইভাবে, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে, গণতান্ত্রিক অধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতা অস্বীকারের বিরুদ্ধে, সাধারণ কিছু মামুলি কথা বলেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এই বিষয়গুলিতে আরো নির্দিষ্টভাবে কিছু বললে জি-২০ ভুক্ত বেশ কয়েকটি দেশের, সবচেয়ে বেশি ব্যবস্থাপক দেশটির, ব্যাপক উল্লঙ্ঘনের বাস্তবতা কিছুটা স্বীকার করা হত।
জি-২১এর সভাপতিত্ব এবার ব্রাজিলের ওপর অর্পন করা হল। সঙ্ঘ পরিবারের জি-২০র উল্লাস এবার দেশের অভ্যন্তরের কঠোর বাস্তবতার সম্মুখীন হবে। কয়েক ঘন্টার ভারী বৃষ্টিতে ‘ভারত মণ্ডপম’ জলমগ্ন হয়ে যাওয়াটা উন্নয়ন প্রশ্নে মোদি সরকারের লম্বা চওড়া বাতেলার পেছনকার প্রকৃত বাস্তবতার এক প্রতীকি ছবি হাজির করেছে। ৫ সেপ্টেম্বর উপনির্বাচনের ফলাফলে এনডিএ’র ঊর্ধ্বে ইণ্ডিয়ার উঠে আসা, যার সবচেয়ে জোরালো অভিব্যক্তি মোদি-শাহ-যোগির ‘ডাবল ইঞ্জিন’ চালিত ইউপি থেকেই এল, সেটাও নির্বাচনী ক্ষেত্রে প্রকৃত বাস্তবতার আরেক স্পষ্ট ইঙ্গিত। দেশ এখন সংসদের রহস্যময় বিশেষ অধিবেশনের অপেক্ষা করছে। এবং সংঘ-বিজেপির কায়েমী ক্ষমতা সেখানে যা এজেন্ডা নিয়েই আসুক না কেন, ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য ওরা যত মরিয়া পদক্ষেপই নিক না কেন, উই দ্যা পিপল অব ইন্ডিয়া, দ্যাট ইজ ভারত – আমরা সেই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করতে সদা প্রস্তুত থাকব এবং মোদি সরকারের বিপর্যয়কর শাসনের অবসান ঘটাব।
- এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ১২-১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ সংখ্যা, ভাষান্তর: দেশব্রতী