ব্রিকস গোষ্ঠীতে এ’যাবৎ ছিল ৫টি দেশ। চিন, রাশিয়া, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভারত। এরসঙ্গে যুক্ত হল আরো ছ’টি দেশ — সৌদি আরব, ইরান, সংযুক্ত আরব আমীরশাহী, আর্জেন্টিনা, ইথিওপিয়া ও মিশর। এই সংযুক্তির মধ্যে দিয়ে ব্রিকস সদস্যভূক্তদের মোট জনসংখ্যা দাঁড়াল প্রায় ৩৭০ কোটি। সৌদি আরব বা সংযুক্ত আরব আমীরশাহীর অংশগ্রহণ ব্রিকসের নিজস্ব ব্যাঙ্কিং অর্থনীতিকে নিঃসন্দেহে অনেক বেশি পুষ্ট করবে। এতদিন অবধি ব্রিকস ব্যাঙ্ক চিনের ওপরেই বেশি পরিমাণে নির্ভরশীল ছিল।
নয়া সংযুক্তিতে সবচেয়ে বেশি চমক নিঃসন্দেহে রয়েছে ইরানকে ঘিরে। ইরানকে আমেরিকা নানাভাবে কোণঠাসা করে রেখেছে এবং বাকি বিশ্বের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক এতদিন অবধি অনেকটাই আমেরিকার মর্জির ওপর নির্ভর করত। ইরানের প্রতিবেশি দেশ সৌদি আরবের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক কয়েক দশক ধরেই অত্যন্ত তিক্ত এবং এর পেছনেও আমেরিকার ভূমিকা যথেষ্ট। বিশ্ব রাজনীতিতে সৌদি আরবকে আমেরিকার পক্ষভুক্ত ও ঘনিষ্ট মিত্র বলেই মনে করা হয়। সৌদির অস্ত্রসম্ভারের সিংহভাগই আসে আমেরিকার থেকে। সম্প্রতি ইরানের সঙ্গে সৌদির একটি বৈঠক হয় চিনের রাজধানী বেইজিংএ। সেই বৈঠকের পর থেকে পরিস্থিতি দ্রুত বদলাতে শুরু করে, যার পরিণতি দেখা গেল ব্রিকসের এই সম্প্রসারণে।
ব্রিকসের সম্প্রসারণ একদিকে যেমন মধ্যপ্রাচ্যে নতুন বিন্যাসের সূচনা করতে চলেছে, তেমনি এর মধ্যে দিয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে আমেরিকার প্রভাব আরো খর্ব হওয়া ও চিনের আরো প্রভাব বৃদ্ধির ইঙ্গিৎ দিচ্ছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আমেরিকার নেতৃত্বাধীন একমেরু বিশ্বকে চিন বেশ কিছুদিন ধরেই চ্যালেঞ্জ জানাতে শুরু করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ন্যাটোকে নিজেদের ইচ্ছেতে চালনা করার চেষ্টা করেও চিনের ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক প্রভাবকে আমেরিকার পক্ষে ঠেকানো সম্ভব হয়নি। এশিয়া ও আফ্রিকায় ক্ষমতার ভারসাম্য এখন অনেকটাই চিনের দিকে ঝুঁকে আছে এবং তা ক্রমশ বাড়ছে। ব্রিকসে ব্রাজিলের পর লাতিন আমেরিকার আর এক শক্তিশালী দেশ আর্জেন্টিনার অন্তর্ভুক্তি লাতিন আমেরিকাতেও চিনের প্রভাব বৃদ্ধির সহায়ক হবে। কিউবা, ভেনেজুয়েলা সহ বেশ কিছু দেশ, যারা ব্রিকসের অন্তর্ভুক্ত নয়, তাদের ওপর চিনের প্রভাব যথেষ্টই। চিনের সহায়তাতেই ভেনেজুয়েলায় মার্কিন কলকাঠিতে সৃষ্ট আর্থিক সঙ্কট ধীরে ধীরে কাটছে। গোটা বিশ্বে যে আবার নতুন এক ভূ-রাজনৈতিক বিন্যাস তৈরি হতে যাচ্ছে, সেটা অনেকদিন থেকেই বোঝা যাচ্ছিল। ব্রিকসের প্রসার তাকে আরো স্পষ্টতা দিল।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সশরীরে এই সম্মেলনে হাজির ছিলেন না কিন্তু রুশ বিদেশমন্ত্রী লাভরভ এতে রাশিয়ার প্রতিনিধিত্ব করেন। ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য রাশিয়ার অর্থনীতি সঙ্কটে পড়েছে। রাশিয়ার ওপর আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের আর্থিক নিষেধাজ্ঞা থাকায় রাশিয়া তার কাছাকাছি থাকা দেশগুলোকেই এই সময় সস্তায় তেল বিক্রি করছে এবং তাতে তারা যথেষ্ট লাভবান হচ্ছে। এর অন্যতম ভারত। ব্রিকসের এই সম্প্রসারণ চিনকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করলেও ভারত এই সম্প্রসারণে সম্মতি দিয়েছে।
ব্রিকস ছাড়াও ভারত কোয়াডের সদস্য। কোয়াডের চারটি দেশ হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত। কোয়াড ও ব্রিকসের ভূ-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক আকাঙ্ক্ষা সম্পূর্ণ আলাদা ও অনেকক্ষেত্রেই বিপ্রতীপ এমনকী সাংঘর্ষিক। কোয়াড ও ব্রিকসের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে চলাটাই ভারতের বিদেশনীতির কাছে বড় পরীক্ষা হতে চলেছে।
- সৌভিক ঘোষাল